ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

এ সময় সুস্থ্য থাকতে নিজেকে ভালোবাসুন

সাইফুল ইসলাম

প্রকাশিত : ০৪:৪২ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:৫৭ পিএম, ৮ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

এ সময়ে ভালো থাকার জন্য সবচেয়ে বড় প্রয়োজন নিজেকে ভালোবাসা। নিজের প্রতি ধারাবাহিক যত্নই আসলে নিজেকে ভালোবাসা। ভালোবাসা মানে নিজের যত্ন নেয়া। যত্ন না নিলে সৌন্দর্যের কিছুই থাকে না। একজন প্রকৃত বিচক্ষণ মানুষ জানে মানুষের জীবনে সবচেয়ে বড় সম্পদ সুস্থ্য সুখী জীবন। আপনার সোনার প্রাসাদ ‘ছাই’ হয়ে যেতে পারে। আপনার বাপ-দাদা আপনার জন্য যে সম্পদ রেখে গিয়েছিলেন তা নিঃশ্বেষ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু আপনি যদি সুস্থ্য থাকতে পারেন, তাহলে ছাইকেই আপনি সোনায় রূপান্তরিত করতে পারেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও প্রত্যেককে স্বাস্থ্য সুরক্ষা মেনে চলার পরামর্শ দিয়েছেন। মাস্ক পরিধান করে, স্বাস্থ্যবিধি মেনে সবাইকে কাজ করার পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, অফিস-আদালত বা জনসমাগম থেকে ফিরে অবশ্যই গরম পানির ভাপ নেবেন।

আমরা সাধারণত মনে করি, ডাক্তার বা ওষুধ রোগ ভালো করে দেবেন। কিন্তু আসল সত্য হচ্ছে মন সেরা ডাক্তার ও দেহ সেরা ফার্মেসি। অর্থাৎ ভালো থাকার জন্য আপনার মধ্যেই সবকিছু রয়েছে। ভালো থাকা স্বাভাবিক। অসুস্থতা অস্বাভাবিক। করোনাকালে জীবনযাত্রায় আতঙ্কিত না হয়ে সতর্কতায় সচেতন জীবনদৃষ্টি আপনাকে নিরাপদ রাখতে পারবে। নিজেকে ভালোবাসলে আপনাকে অবশ্যই মেনে চলতে হবে কোথায় লাভ আর কোথায় ক্ষতি? মনে রাখতে হবে শুধুমাত্র রোগব্যাধির অনুপস্থিতিই সুস্বাস্থ্য নয়। সুস্বাস্থ্য হচ্ছে ভালো থাকার এক অন্তর্গত অনুভূতি যা আপনাকে সবসময় আনন্দোচ্ছল করে রাখে। কী খাবেন, কেন খাবেন বা এসব খাবারে কী আছে সেটা জানার চেষ্টা করতে হবে। শুধু সুস্বাদু বা সুন্দর মোড়কে বড় কোম্পানির প্যাকেট বা দামী বিজ্ঞাপনের ভালো মজাদার হলেই হবে না- স্বাস্থ্যসম্মত খাবার কী না সেটা বোঝার চেষ্টা করতে হবে আপনাকেই। সামনে রোজার মাস। এ মাসে আমরা সাধারণত ভাজাপোড়া খাওয়ার প্রতিযোগিতায় নামি। কিন্তু রোজাকে বলা হয় সংযমের সময়। মনে রাখতে হবে নিজের শরীরের যত্ন নেয়া সবচেয়ে বড় ইবাদত। অর্থাৎ খাবার এবং চাল চলনের ক্ষেত্রে সবাইকে প্রথমেই সতর্ক হতে হবে। 

সুস্থ্য থাকতে প্রথমে প্রয়োজন প্রশান্তি। সদা সর্বদা কৃতজ্ঞচিত্র বা গ্রাটিচুড, ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি। বিজ্ঞানসম্মত আহার, সতর্কতা এবং নিয়মিত যোগব্যায়াম, মেডিটেশনে দৃষ্টিভঙ্গির চ্যানেলটা পরিবর্তন করে দেয়। চিকিৎসকেরা বলছেন এ সময় ফুসফুসের যত্ন নিতে প্রাণায়াম বা দমচর্চা, মেডিটেশন বা ধ্যান করা বিশেষ উপকারী। আপনার খাওয়া-দাওয়া, চলাফেরা, চিন্তা-চেতনা সবকিছু বিজ্ঞানসম্মত পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন হচ্ছে কিনা সেটা আপনাকেই জানতে হবে। সবাই খায় আমিও খাই, সবাই করে আমিও করি এই প্রচলিত ধারণা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।

আধুনিক সভ্যতার যে সবচেয়ে বড় অভিশাপ টেনশন। যোগব্যায়াম, মেডিটেশন করে আপনি এই টেনশন থেকে মুক্তি পাবেন। এ সময়ে আমাদের টেনশনের ধরনটা এমন যে জীবনের সাথে মিশে গেছে। অহেতুক অন্যের কথায় আতঙ্কিত না হয়ে গুজবে কান না দিয়ে আপনাকে ইতিবাচক জীবন দৃষ্টি দিয়ে বুঝতে হবে এ সময়ে কী করবেন কী করবেন না। সামাজিক দূরত্ব নয়, শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে মানুষের প্রতি মমত্ব বাড়ান। অন্যের সাহায্যে হাত বাড়িয়ে দিন।

চাপমুক্ত হতে দিনে অন্তত কয়েকবার প্রাণ খুলে হাসুন। হাসি দমকে স্বাভাবিক করে, পেশির ব্যথা দূর করে, রক্তচাপ কমায়, রোগ নিরাময়কে দ্রুততর করে। সময় পেলেই বুক ফুলিয়ে দম নিন। মেরুদণ্ড সোজা রেখে নাক দিয়ে ধীরে ধীরে দম নিন। একমুহূর্ত থামুন। এরপর ধীরে ধীরে মুখ দিয়ে দম ছাড়ুন। এভাবে প্রতি দফায় ১৫/২০ বার করে দিনে পাঁচ/ সাত দফা দম নিন। শরীরের ক্লান্তি-আলস্য-অবসাদ দূর হয়ে যেতে থাকবে। এভাবে নিয়মিত দম চর্চা করুন। প্রাণায়াম বা দমচর্চা ফুসফুসকে সুস্থ্য রাখবে।

হাঁটতে হাঁটতে প্রাণায়াম করুন। ছয় কদমে হাঁটতে হাঁটতে দম নিন, আট কদমে দম ছাড়ুন। এভাবে ধীরে ধীরে দম নেয়া-ছাড়ার সময় কদমের সংখ্যা বাড়াতে থাকুন। দিনে পূর্ণ আহারের তিন/ চার ঘণ্টা পরে ২০/২৫ মিনিট কোয়ান্টাম (যোগ) ব্যায়াম করুন। শুরু করুন উজ্জীবন দিয়ে। বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নিয়ে কমপক্ষে ১০/১২টি আসন করুন। শেষ করুন শবাসনে শিথিলায়ন করে। আপনি সুস্থ ও প্রাণবন্ত থাকবেন। এছাড়াও খুব সহজে করতে পারে বঙ্গাসন, দন্ডাসন।

যখনই সময় পান, হাঁটুন। চলাফেরা করুন। সহজেই হেঁটে যাওয়া যায় এমন দূরত্বে বাহনে উঠবেন না। মেরুদন্ড সোজা রেখে পা মাটিতে স্পর্শ করে চেয়ারে বসুন। ঘাড় ও মাথা সোজা রাখুন। অহেতুক শারীরিক টেনশন হবে না। দু’পায়ে সমান ভর দিয়ে সোজা দাঁড়ান। কুঁজো হয়ে দাঁড়ালে মেরুদন্ডে চাপ পড়ে, রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়। 

ঠাণ্ডাজনিত রোগ বা সাইনুসাইটিসের সমস্যা মোকাবেলায় একনাগাড়ে প্রতিদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে এবং রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে ২০ বার কুসুমগরম পানি দিয়ে গার্গল করুন। এ সময়ে গরম পানি গার্গল নিয়মিত করুন।  

রক্তদান স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী। রক্তদান করার সাথে সাথে শরীরের মধ্যে অবস্থিত ‘বোন ম্যারো’ নতুন কণিকা তৈরির জন্যে উদ্দীপ্ত হয়। নিয়মিত রক্তদান হৃদরোগ ও হার্ট অ্যাটাকের ঝুঁকি কমায়। 

প্রতিদিন একই সময়ে ঘুমাতে যান এবং একই সময়ে জেগে উঠুন। বদ্ধ ঘরে ঘুমাবেন না। পর্যাপ্ত বাতাস চলাচলের ব্যবস্থা রাখুন। রাতে ঘুমানোর আগে মুখ-হাত-পা ধুয়ে, এক গ্লাস পানি পান করে বিছানায় যান। কিছুক্ষণ বঙ্গাসন বা গোমুখাসন করুন। তারপর শবাসনে সুন্দর কল্পনা করতে করতে ঘুমিয়ে পড়ুন। সকালে ঝরঝরে অনুভূতি নিয়ে জেগে উঠতে পারবেন। 

বঙ্গাসনে পায়ের পেশি পাঁচ গুণ বেশি তৎপর থাকে ও মজবুত হয়। দাঁড়িয়ে থাকার সমান ক্যালরি খরচ হয়। বাড়তি মেদ ঝরে যায়। কোলেস্টেরল কমে। হাঁটু, কোমর, গোড়ালির অস্থিসন্ধির জড়তা দূর করে। দেহের হাড় ও পেশি দীর্ঘদিন কর্মক্ষম থাকে। পুরুষদের প্রোস্টেট ও ব্লাডার এবং মহিলাদের জরায়ু নিয়ন্ত্রণকারী স্নায়ুসমূহের ক্ষয় রোধ করে। হার্নিয়া, ডাইভার্টিকুলোসিস ও পেলভিক অর্গানগুলোর স্থানচ্যুতির সম্ভাবনা কমে। শরীরের নিচের অংশে রক্তপ্রবাহ বাড়ে। সংশ্লিষ্ট অংশে রক্তনালি ও পেশির রোগ প্রতিরোধ হয়। নিয়মিত বঙ্গাসন চর্চায় মহিলাদের স্বাভাবিক প্রসবের সম্ভাবনা বাড়ে।

সুন্দর প্রত্যাশা ও প্রত্যয় নিয়ে দিন শুরু করুন। ঘুম ভাঙতেই বলুন, শোকর আলহামদুলিল্লাহ/ থ্যাংকস গড/ হরি ওম বা প্রভু তোমাকে ধন্যবাদ, একটি নতুন দিনের জন্যে।  দিনের সমাপ্তিও ঘটবে একইভাবে। প্রাণবন্ত চোখের জন্যে ঘুম থেকে উঠেই প্রথমে ঈষদুষ্ণ ও পরে ঠান্ডা এবং রাতে শোয়ার আগে প্রথমে ঠান্ডা ও পরে ঈষদুষ্ণ পানির ঝাপটা ২০ বার করে নিন। 

এসময়ে খারাপ অভ্যাস ত্যাগ করে ফেলুন। যখন অভ্যাসের ওপর শুধু আপনারই নিয়ন্ত্রণ থাকবে, তখনই আপনি অর্জন করবেন সত্যিকার স্বাধীনতা। বদভ্যাস মনের এমন একটি জীর্ণ অবস্থা, যা একসময় নতুন ধারণার মাধ্যমে মুক্তির পথ দেখাতে চেয়েছিল, কিন্তু এখন তা নিজেই পথ হারিয়ে ফেলেছে। ধূমপান, কোমল পানীয় বা এনার্জি ড্রিংকস পান নেশার প্রথম স্তর। এর দ্বিতীয় স্তরই হচ্ছে ড্রাগ ও এলকোহল আসক্তি। 

সাধারণ জাগ্রত অবস্থায় নিজের সম্পর্কে আমাদের ধারণা হয় খণ্ডিত। ফলে আমাদের ভেতরেই শান্তি ও আনন্দের বিশাল সরোবরের অস্তিত্ব আমরা টের পাই না। মৌন থাকা বা ধ্যানের স্তরেই অন্তর্গত প্রশান্তি ও আনন্দের সরোবর আবিষ্কৃত হতে পারে। তাই দিনে দুবেলা মেডিটেশনকে অভ্যাসে পরিণত করুন। দিনের প্রথম কাজটি শুরু করুন মেডিটেশন করে বা কিছু সময় আনন্দ চিত্তে মৌনতা পালন করে। ফলে সারাদিন প্রশান্ত থাকবেন। কাজেও গাত বাড়বে। চিকিৎসকরা বলেন- রাগ, ক্রোধ, ক্ষোভ, ভয় মস্তিষ্কে সেরোটনিনের প্রবাহ কমায়। আর মেডিটেশন সেরোটনিনের মাত্রাকে বাড়িয়ে দেহ-মনে প্রশান্তি ও আনন্দ আনে। টেনশন পেশিকে শক্ত করে। মস্তিষ্কও তখন পেশিকে সজাগ হওয়ার জন্যে ক্রমাগত সতর্কবার্তা পাঠায়। ফলে দেহ ক্লান্ত হয়, প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ভেঙে যায়, নিরাময় ক্ষমতা হ্রাস পায়।

কিছুক্ষণের শিথিলায়ন বা মৌন থাকায় (রিল্যাক্স) কাজের ক্লান্তি দূর করে আপনাকে এনে দেবে ঝরঝরে সতেজ অনুভূতি ও অফুরন্ত কর্মশক্তি। আতঙ্কিত না হয়ে মৌন থেকে চোখ বন্ধ করে ৫/১০ মিনিট কল্পনায় মনোহর প্রাকৃতিক দৃশ্যে হারিয়ে যান। স্নায়ু উত্তেজক দৃশ্য বা ছবি মনের অবচেতনে গেঁথে জটিল মানসিক ব্যাধি সৃষ্টি করে। আর সুন্দর ছবি, দৃশ্য বা কল্পনা মানসিক প্রশান্তির সাথে সাথে দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। 

হরর, ভায়োলেন্স, পরকীয়াপূর্ণ টিভি সিরিয়াল ও মুভি দেখবেন না (বিশেষত ঘুমানোর তিন/ চার ঘণ্টা আগে)। এগুলো স্নায়বিক উত্তেজনা, উৎকণ্ঠা, অনিদ্রা, দুঃস্বপ্ন ও হার্ট অ্যাটাকের কারণ হতে পারে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যস্ততা কমিয়ে আনুন। এ আসক্তি আপনার শরীরে নানাভাবে প্রভাব ফেলবে।

ভালো থাকার জন্য সব সময় ভালো কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখুন। কর্মব্যস্ততা রোগ-শোককে দূরে ঠেলে দেয়। ভয়, রাগ, ক্ষোভ, ঈর্ষা, সন্দেহ শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা নষ্ট এবং দুরারোগ্য ব্যাধি সৃষ্টি করে। এগুলো ঝেড়ে ফেলুন। আপনার সুস্থ থাকার সামর্থ্য বেড়ে যাবে। আত্মকেন্দ্রিকতা ও ‘আমারটা আগে’ এ দৃষ্টিভঙ্গি জীবনকে এক ক্লান্তিকর বোঝায় পরিণত করে। আর বিনয়, সহানুভূতি ও উপকার যত ক্ষুদ্রই হোক জীবনকে প্রাণবন্ত ও হাস্যোজ্জ্বল করে তোলে। 

ভয়, আতঙ্ক, দুশ্চিন্তা, অস্থিরতা এবং ধারাবাহিক সচেতনতার অভাবে আমাদের দৈহিক অস্তিত্বের একটি বড় অংশ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যায়। পরিণামে আমরা রোগগ্রস্ত হই এবং মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ি। যখন আপনার শরীরের ওপর আপনার নিয়ন্ত্রণ অনুভব করেন, তখনই আপনি সুস্বাস্থ্যের সুপ্রভাতে উপনীত হন। এ সময়ে বিজ্ঞানসম্মত সুস্থ জীবনদৃষ্টি, রুচিশীল স্বাস্থ্যসম্মত পরিমিত আহার, পর্যাপ্ত পানি পান, মেডিটেশন, দমচর্চা ও ব্যায়াম দিতে পারে সুস্থ দেহ প্রশান্ত মন কর্মব্যস্ত সুখী জীবন।