ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

নতুন বাংলা বর্ষে করোনার বিরুদ্ধে লড়াই

ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী  

প্রকাশিত : ০৯:৪৮ পিএম, ১৬ এপ্রিল ২০২১ শুক্রবার

গত পহেলা বৈশাখ ছিল বাঙালীর মহা উৎসবের দিন। অথচ এবারের পহেলা বৈশাখ কেটেছে নিরানন্দে। সরকার মানুষকে বাঁচানোর জন্য সর্বাত্মক লকডাউনের ব্যবস্থা করেছে। আর বৈশ্বিক মহামারী কত লোকের আপনজনের জীবনহানি ঘটিয়ে চলেছে। অদৃশ্য ভাইরাসের সঙ্গে লড়তে গিয়ে নতুন করে দরিদ্র হচ্ছে মানুষ পৃথিবীজুড়ে। জঠরের জ্বালা আবার মারাত্মক হয়ে উঠেছে। খরতপ্ত বৈশাখ আনন্দময় হওয়ার বদলে এ বছর মানুষের মধ্যে সৃষ্টি করছে উৎকণ্ঠা।

আমরা গত একটি বাংলা বছরে হারিয়েছি প্রথিতযশা শিল্পী-সাংবাদিক-সাহিত্যিক-শিক্ষাবিদ-রাজনীতিবিদ-উদ্যোক্তাসহ প্রায় দশ হাজার মানুষ। যে পরিবারে মৃত্যুর হিমশীতল ছোবল নেমে এসেছে সেখানে কেবল দুঃখ-বেদনা একাকার হয়ে গেছে। প্রত্যেক মানুষ তার পরিবারের কাছে অত্যন্ত প্রিয়। প্রিয় ব্যক্তিকে হারানো অনেক কষ্টের। মানুষকে জরুরী সেবা দিতে গিয়ে পুলিশ-আর্মি-ব্যাংকাররাও প্রাণ হারিয়েছেন। অন্যদিকে ফ্রন্টলাইনার ডাক্তার-নার্সরা মানুষকে সেবা প্রদান করতে গিয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। মৃত্যু যেন আজ ভাইরাসের মাধ্যমে দেখিয়ে দিচ্ছে ইচ্ছা করলেই যে কাউকে যখন-তখন নিয়ে চলে যেতে পারে পরলোকের পাড়ে। পরিচ্ছন্নকর্মীরাও পেশাদারিত্বের সঙ্গে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুকেবরণ করেছেন। এটি এক মর্মন্তুদ বিষয়। মৃত্যুর যে হিমশীতল ছায়া তা ১৪২৮ বাংলা সন কেটে যাক এটি মনে-প্রাণে প্রত্যাশা করি। আমাদের এগিয়ে যেতে হবে নানা চড়াই-উতরাই পার করে। 

এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ছিল ‘কালা ভয়ঙ্করের বেশে এবার ওই আসে সুন্দর।’ প্রতীকী আয়োজনে নববর্ষকে যে বরণ করে নেয়া হলো সেখানে কেবল ভয়ঙ্করের কথাটির মাধ্যমে রুদ্র বেশে দানবীয় শক্তিতে মানবের ওপর নানামুখী ঝড়-ঝাপ্টার কথাটি উচ্চারিত হয়েছে। আর সুন্দর তখনই হবে যখন ধ্বংস-তা-বলীলা থেকে মানুষ সামলে উঠবে। অদৃশ্য শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে পরাস্ত হওয়ার বদলে যেন আবার বিজয়ীর বেশে নতুনের অভিধায় অভিষিক্ত হয়ে মানুষ সামনে এগিয়ে যেতে পারে। নতুনের আধিপত্যে ধ্বংসযজ্ঞের বদলে মানুষ আবার সৃষ্টির মাহাত্ম্য বুঝতে পারবে দুঃখ-দৈন্য-দুর্দশা কেটে যাবে। স্বাস্থ্যবিধি মেনে এবার মঙ্গল শোভাযাত্রা পালন করা হলো। করোনায় অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের মধ্যেও রবীন্দ্র সঙ্গীতশিল্পী মিতা হককে সম্প্রতি আমরা হারিয়েছি। রবীন্দ্রনাথের গান আমার বড্ড প্রিয়। তার অনবদ্য কণ্ঠে ‘পুরনো জানিয়া চেয়ো না, চেয়ো না আমারে/’-শুনলে মনে পড়ে যায় মানুষের মধ্যে যে অপরিসীম সৃষ্টি স্রষ্টা দিয়েছেন তা মানুষকে সম্মুখে এগিয়ে যেতে সহায়তা করে। যা কিছু জীর্ণ, ভুল, অসাধু তা থেকে বাঙালী জাতি তথা বাংলাদেশ মুক্ত হোক। মুজিব শতবর্ষ এবং বিজয়ের পঞ্চাশ বছর চলমান সময়ে পৃথিবীর অন্য দেশগুলোর মধ্যেও সরকারপ্রধান ‘জীবন ও জীবিকা’র মধ্যে একটি ভারসাম্য তৈরির প্রয়াস নিয়েছিলেন। কিন্তু করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আবার বিষাক্ত ছোবলে আক্রান্ত করেছে। এ বিষ দেশের সর্বস্তরের মানুষের আয়, জীবনমানে বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করছে। অথচ কয়দিন আগেও আমরা করোনার প্রথম ঢেউ কাটিয়ে উঠতে চেষ্টা করেছি। অর্থনীতিতে আবার পুনরুজ্জীবন ঘটছিল। করোনার জন্য নববর্ষে হালখাতা খোলা হলো না। অর্থনীতিতে নববর্ষ নিয়ে যে ব্যবসা-বাণিজ্য তাতে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকার ক্ষতি। তবে আমাদের বড় সমস্যা আমরা নিজেরাই তৈরি করেছি। সরকারপ্রধান বারবার সতর্ক করা সত্ত্বেও ঠিকমতো স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলিনি। এটি এক ধরনের মারাত্মক অপরাধ। মনে হয় দেশে টিকা তৈরি করার প্রস্তুতি নেয়া উচিত। বঙ্গবন্ধুর নাম জড়িয়ে আছে যে টিকা ‘বঙ্গোভ্যাক্স’ সেটি বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল মেনে হিউম্যান ট্রায়াল করার জন্য দেশের ন্যূনতম পক্ষে ১২ কোটি লোকের জন্য টিকার ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারপ্রধানের আন্তরিক প্রয়াসে চল্লিশ ও তদুর্ধের জন্য আমরা টিকা পেয়েছি। এখন কথা চলছে ভারত থেকে টিকা আনার পাশাপাশি ভিন্ন কোন দেশ থেকে টিকা আনার জন্য। কিন্তু নিজস্ব টিকা নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় যদি উৎপাদন করা যায় তবে তা দীর্ঘমেয়াদে ফলপ্রসূ প্রভাব ফেলবে। করোনার টিকা যত দ্রুত উৎপাদন প্রক্রিয়া প্রটোকল বজায় রেখে তৈরি হয় সেজন্য প্রধানমন্ত্রীর দফতরের তদারকি প্রয়োজন। 

নিজের দেশের ঘাটতি না মিটিয়ে কেউ তো ইচ্ছা থাকলেও রফতানি করতে পারবে না। এজন্যই বারবার স্থানীয় অর্থনীতিকে শক্তিশালী করার জন্য বলি। স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা একদিনের কাজ নয়। স্বাধীনতা উত্তরকালে বঙ্গবন্ধু দেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীসহ সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতের চেষ্টা করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর দুঃখজনক মৃত্যুর পর এদেশের স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতির যে আবরণ ঢুকে গেছে, বিভিন্ন সময় বেনিয়ারা ছোবল দিয়েছে তাতে দেশে ভাল চিকিৎসক, দক্ষ নার্সের সংখ্যা কমতে থাকে। স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একুশ বছর যে ধরনের দুর্নীতি প্রসারিত হয় তা প্রশমন করা কষ্টসাধ্য হয়েছিল। সত্য-মিথ্যা জানিয়ে, চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে যে দুর্নীতির বিবরণ গত ১২ এপ্রিল প্রকাশিত হয়েছে গণমাধ্যমে এটির সঙ্গে যারা জড়িত তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশন আইনানুগ ব্যবস্থা নেবে আশা করি। সরকার যেখানে ভালর জন্য সীমিত পরিসরেও নানা পদায়নের ব্যবস্থা করে স্বাস্থ্যসেবা দিতে চাচ্ছে এ ধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি দেশের জন্য চাকরিপ্রার্থীর জন্য অত্যন্ত বেদনাবহ। আশা করি বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে তদন্ত করে যারা দোষী তারা অবশ্যই আইনের আওতায় আসবে। সিন্ডিকেট তৈরি করে যারা উপযুক্ত চাকরিপ্রার্থীকে কর্ম থেকে বঞ্চিত করে তারা মানবরূপী পশুসম। এদিকে ধর্মের নামে যে হিংস্রতা ধর্ম ব্যবসায়ী করেছেন তাদের ধীরে ধীরে আইনের আওতায় আনতে সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে সেটি অবশ্যই প্রশংসনীয়। পাশাপাশি চুয়াত্তরের মতো যারা এই ধর্মান্ধ গোষ্ঠীকে ব্যবহার করার জন্য ব্যবস্থা করেছিল, নানামুখী প্রোপাগা-া করে এদের নিজেরাও উস্কানি দিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ যদি দোষী থাকে তবে তাদেরও ধরা দরকার।

আজকের বাংলাদেশ অর্থনীতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু কোভিড এসে রুদ্র ভৈরবীর এত সব ভেঙ্গেচুড়ে ধ্বংসের তা-বলীলা সৃষ্টি করেছে। একটি মূল্যায়নে দেখা যায় যে, করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা খাতে ব্যয় ২৮ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। এই মূল্যায়ন তথ্যটি সঠিক হলে এটি মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। দেশে করোনাকালে মানুষের উপার্জন অনেকাংশে কমে গেছে। গাড়ির চাকা না ঘুরলে যেমন হেলপার-ড্রাইভারের দূরপাল্লার বাস-ট্রাকের খাতে টাকা পায় না, তেমনি দোকান না খুললেও তাদের আয়-রোজগার বন্ধ থাকে। অন্যদিকে ছোট ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীদের পক্ষে তাদের পণ্য ক্রয়-বিক্রয়, বিপণন এবং বাজারজাতকরণে সমস্যার সৃষ্টি হয়। সরকার বারবার স্বাস্থ্যবিধি মানতে বললেও যারা মানেনি তাদের কারণে অন্যদের আজ সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এটি দুর্ভাগ্যজনক। কারণ যখন স্বাস্থ্য সম্পর্কিত বিজ্ঞপ্তি দেয়া হয় সেটি দেশের নাগরিক হিসেবে পালন করা অবশ্যই কর্তব্য। দেশের আইন মান্যকারী মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকে চলতে হবে। যারা দুর্নীতি করে, হিংস্র-তা-বলীলা চালায় তাদের বিরুদ্ধে কঠোর হওয়া প্রয়োজন। জঙ্গীবাদের স্থান ইসলামে নেই। তাই যারা জঙ্গীবাদী চেতনায় উদ্দীপ্ত হয় তারা অবশ্যই মূল ইসলামিক চেতনা থেকে দূরে সরে গেছে। আবার যারা মাদক গ্রহণ করে তারা বুঝতে পারে না সমাজের অন্ধকারতম স্থানে তাদের ঠেলে দেয়া হচ্ছে। করোনাকালে নারী ও শিশু নির্যাতন বেড়েছে। এটি মোটে গ্রহণযোগ্য নয়।

সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে একবার রফতানিমুখী বাজার হারালে সেটি পুনরুদ্ধার করা সম্ভব নয়। আর তাই লকডাউনের সময় রফতানিমুখী শিল্প-কলকারখানা খুলে রাখার ব্যবস্থা হয়েছে। আশা করব স্বাস্থ্যবিধি বজায় রাখার পাশাপাশি পোশাক শ্রমিকদের যদি কারখানায় রাখা যায়, তাদের খাবার ও থাকার ব্যবস্থা করে তিন শিফটে কাজ করানো হয়, তা হলে করোনা বাড়ার কথা নয়। করোনাকালীন জনপরিবহন যাতে ব্যবহার করতে না হয় এবং সামাজিক দূরত্ব যাতে পোশাক শ্রমিকরা মেইনটেইন করে তার জন্য অনুরোধ থাকবে। আর দেশের সব ১৮ বছর এবং তদুর্ধদের জন্য টিকা দেয়ার ব্যবস্থা করা জরুরী হয়ে পড়েছে। টিকা যাতে বেসরকারী খাতে আমদানি করা যায় সেজন্য জরুরী উদ্যোগ নেয়া দরকার। কেননা টিকার জন্য অপেক্ষা করে যেন কোন পরিবারের কোন সদস্যকে হারাতে না হয় সেজন্য সরকারী খাতের পাশাপাশি বেসরকারী খাতকে দায়িত্বশীলতার সঙ্গে কাজ করতে হবে। এক্ষেত্রে ব্র্যাকও গুরুত্বের সঙ্গে তাদের স্বাস্থ্য বিভাগকে কাজে লাগাতে পারে। আবার আমাদের ওষুধ খাতের যারা বড় মাপের আমদানিকারক আছেন তারা বিদেশের বিভিন্ন টিকা উৎপাদনকারী সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ করে, দেশের আইন মান্য করে টিকা আমদানি করতে পারেন। করোনার সময় স্বাস্থ্যসেবা সুনিশ্চিত করা দরকার। জনকণ্ঠে বছরখানেকের বেশি আগে লিখেছিলাম যে, ওয়ালটনকে ভেন্টিলেটর তৈরির উদ্যোগ গ্রহণ করার জন্য। 

পরবর্তীতে দেখলাম যে, প্রবাসী বাংলাদেশী ওমর ঈশরাকের সহায়তায় ওয়ালটন-মেডট্রনিক ভেন্টিলেটর প্রস্তুত করেছে। এই ভেন্টিলেশন মেশিনগুলো বিভিন্ন জেলা-উপজেলা হাসপাতালে বিত্তশালীরা যাতে ক্রয় করে দান করে সেজন্য সম্মিলিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করতে পারে। সরকার তার কাজ করে যাচ্ছে। এক্ষণে বেসরকারী খাতকেও সামনে এগিয়ে আসতে হবে। করোনাকালে বাংলা নববর্ষে অন্তত মানুষের মধ্যকার লোভ, পশুত্ব দূর করতে হবে। ছোট ব্যবসায়ী, শ্রমজীবী, কৃষিজীবীসহ যারা নিম্ন আয়ের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর তাদের সহায়তা করতে পিকেএসএফ তার সহযোগী প্রতিষ্ঠানসমূহের মাধ্যমে এগিয়ে আসতে হবে। প্রয়োজনে সরকারী অনুদান পিকেএসএফের মাধ্যমে দেয়া যায়। আবার বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে অর্থ বিতরণ করে ছোটখাটো ব্যবসায়ী এবং উৎপাদনকারীরা যাতে বেঁচে থাকে তার ব্যবস্থা করতে হবে। বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক এবং বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংক যাতে সিএমএসএমই সেক্টরে সরকারপ্রধানের নির্দেশিত প্রণোদনা প্যাকেজ অনুযায়ী কাজ করে, কৃষি, কৃষিনির্ভর শিল্প এবং ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের এ্যাপ্রোপ্রিয়েট ফাইন্যান্সিংয়ে কাজ করে, সেজন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংকের কার্যাবলীতে ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্পের প্রণোদনা দেয়ার জন্য ব্যবস্থা নিতে হবে। কৃষিনির্ভরতা এখন বাড়াতে হবে। আমদানি বিকল্পায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারকে আরও বেশি উদ্যোগী হতে হবে। এজন্য বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করে বাস্তবায়নে উদ্যোগী হতে হবে বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংককে। দেশের মানুষ করোনার বৈরী প্রভাব থেকে মুক্ত হোক এই প্রত্যাশা থাকল বাংলা নববর্ষে।

লেখক : ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট এবং আইটি এক্সপার্ট

pipulbd@gmail.com