ঢাকা, সোমবার   ২৫ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১১ ১৪৩১

বিলুপ্তির পথে মক্তব শিক্ষা

আ নে য়া র কা জ ল 

প্রকাশিত : ০৩:৩৪ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৩:৩৬ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার

চিরায়ত বাংলা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে শত সহস্র বছরের জ্ঞানের আলো বিতরণকারী কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র মক্তব। চিরচেনা সেই মক্তব শিক্ষার কথা এখনও মনে পড়ে। স্মৃতির পাতায় এখনও অপকটে দাগকাটে সেই সকাল বেলার মধুর সুরে আওয়াজ করে কোরআন তেলাওয়াত করার শৈশবের দিনগুলোর কথা। আগের মত এখন আর কঁচি-কাঁচা, শিশু-কিশোরদের কোরআন শিক্ষার জন্য মক্তবে যেতে দেখা যায় না। কালিমা তায়্যিবা আর আলিফ, বা, তা -এর শব্দে মুখরিত হয়ে উঠে না জনপদ। 

গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ছিল কোরআন শুদ্ধ করে জানে এমন একটি মেয়েই হবে ঘরনী। যাতে বাড়ি-ঘর কোরআনের শব্দে বরকতময় হয়ে উঠে। এখন সেই ঐতিহ্য মুছে যাচ্ছে মুসলিম সমাজ থেকে। একসময় বাংলার পথে-ঘাটে ভোরের পাখিদের সঙ্গে সঙ্গে মক্তবগামী কোরআনের পাখিদের দেখা মিলত। মুসলিম পরিবারে শিশুদের ধর্মীয় শিক্ষা কালিমা, নামাজ, রোজা, হজ, যাকাতসহ ধর্মীয় মাসয়ালা-মাসায়েল শেখার অন্যতম ব্যবস্থা ছিলো এটি। ইহকালে শান্তি ও পরকালের নাজাতের শিক্ষার শুরু এই মক্তব থেকেই।

এ শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালনা করতেন স্থানীয় গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ, মসজিদের ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা। কিন্তু ইদানিংকালে বিভিন্ন বেসরকারি স্কুল, কিন্ডার গার্টেন ও ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে মর্নিং শিফট চালু হওয়ায় একটি বৃহৎ জনগোষ্ঠী মক্তবের শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে।

ভোর থেকে কিন্ডার গার্টেন শিক্ষা চালু হ্ওয়ায় শিশুরা মক্তবের এই ন্যূনতম শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এটি তাদের কোরআন শেখা তথা দ্বীন শেখার অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। এর প্রভাবে তৈরি হচ্ছে ধর্মীয় জ্ঞানশূন্য একটি বিশাল জনগোষ্ঠী। ধর্মীয় জ্ঞানের অভাবে নীতি-নৈতিকতাহীনতার দিকে ধাবিত হচ্ছে সমাজ। যার ফলে প্রাত্যহিক জীবনে ঘটছে অনাচার-অবিচার, জুলুম, অন্যায়সহ নানাবিদ স্খলনের ঘটনা।

মক্তবের অর্থ কী
মক্তব আরবি শব্দ। এর শাব্দিক অর্থ পাঠশালা বা বিদ্যালয়। শিশুদের কোরআন শিক্ষার তথা ইসলাম সম্পর্কে প্রাথমিক বা মৌল জ্ঞানার্জনের শিক্ষা কেন্দ্র হলো মক্তব। যেখানে মুসলিম পরিবারের শিশুদেরকে আরবী হরফ, কোরআন পড়া-শেখা তথা কোরআনের তেলাওয়াত শেখার পাশাপাশি নামাজ-রোজার নিয়ম কানুন, জরুরি মাসয়ালা-মাসায়িল, দোয়া-কালাম, আদব-কায়দা, ধর্মীয় রীতিনীতি শিক্ষার একমাত্র ভরসা ছিলো মক্তব।

মক্তব শিক্ষার উদ্দেশ্য ও ভারতীয় উপমহাদেশে সূচনা
মানবজাতির হেদায়েতের জন্য আল্লাহপাক নাজিল করেছেন মহাগ্রন্থ আল-কোরআন। এ কোরআন বিশ্বমানবতার কল্যাণ ও মুক্তির সনদ। এটি বিশ্বময় শান্তি প্রতিষ্ঠা ও নিরাপত্তা বিধানের সংবিধান। এই গ্রন্থের ধারক-বাহক হওয়ার জন্য আল্লাহ তায়ালা আমাদের মনোনীত করেছেন। এরশাদ হয়েছে, ‘আমি আমার বান্দাদের থেকে তাদেরই এ কিতাবের উত্তরাধিকারী করেছি, যাদের পছন্দ করেছি।’ (সূরা ফাতির : ৩২)।

রাসুলুল্লাহ (সা.) কোরআন তেলাওয়াতের প্রতি অত্যধিক গুরুত্বারোপ করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমাদের মধ্যে সে-ই উত্তম, যে কোরআন শিখে ও অন্যকে শিখায়।’ (বোখারি : ৫০২৮)। রাসুলুল্লাহ (সা.) আরও বলেন, ‘কোরআনের একটি হরফ পড়লে একটি নেকি।’

জ্ঞান অর্জন করা প্রত্যেক মুসলমানের ওপর ফরজ। বিশেষত ধর্মীয় জ্ঞান না থাকলে ধর্ম মোতাবেক জীবন যাপন করা সম্ভব নয়। যে ব্যক্তি সঠিকভাবে অজু করতে জানে না বা ফরজ গোসল করতে জানে না, সে নামাজ পড়বে কিভাবে? অনন্ত নামাজ পড়ার জন্য শুদ্ধভাবে কোরআন পড়তে  জানা প্রয়োজন।  একজন মুসলমান হিসেবে সেগুলো শিক্ষা করা জরুরি। আর শৈশবেই এ আলোকে সন্তানদের গড়ে তুলতে  হবে, এমন চিন্তা থেকেই তৎকালীন ভারতবর্ষের মসজিদে মসজিদে চালু হয় মক্তব ব্যবস্থা, যার মাধ্যমে প্রতিটি মুসলিম শিশুকালেই ইসলামের মৌলিক জ্ঞানগুলো অর্জন করতে পারত।

৭১১ সালে মুহাম্মদ বিন কাসিমের সিন্ধু বিজয়ের পরপরই ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষার সূচনা হয়। তবে শুরুর দিকে এর কোনো প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ছিল না। মুহাম্মদ ঘোরি দ্বাদশ শতকের শেষ দিকে ভারতবর্ষে তুর্কি সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। ১১৯১ সালে আজমিরে একটি ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। তবে ভারতবর্ষে মক্তব ও মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থার বিস্তার ঘটে মূলত মোগল আমলে। সেই শিক্ষা ব্যবস্থা ব্যাপক জনপ্রিয় ও গ্রহণযোগ্য ছিল সব মহলে। ভারতবর্ষে মুসলিম শাসকদের শাসনামলে শিক্ষাব্যবস্থা ও ধর্ম অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল।

ইতিহাসবিদ এ আর মল্লিক লিখেছেন, ‘বাংলার মুসলমানদের অতীত ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায় যে, যখন কোনো সন্তানের বয়স চার বছর চার মাস চার দিন পূর্ণ হতো তখন তার বিদ্যা শিক্ষার সূচনা হতো। একটি বিশেষ অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পবিত্র কোরআনের কিছু অংশ শিশুকে পাঠ করে শোনানো হতো। শিশু তা পুনরাবৃত্তি করত। এ ছিল প্রতিটি মুসলিম পরিবারের অপরিহার্য প্রথা।’ 
সেই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের মসজিদগুলোতে সকালবেলা শিশুদের মক্তব খুলে দ্বিনি শিক্ষা দেওয়ার রেওয়াজ যুগ যুগ ধরে চলে আসছে। 

বিশ্বের দেশে দেশে  মক্তব শিক্ষা
সাধারণত ভারতীয় উপমহাদেশ ছাড়াও আফ্রিকা, দক্ষিণপূর্ব ইউরোপসহ পৃথিবীর রিভিন্ন প্রান্তে এ মক্তব ব্যবস্থা প্রচলিত ছিলো। দিনে দিনে  জনপ্রিয় হচ্ছে ঐতিহ্যবাহী মক্তব স্কুল। বিশেষ এ ধর্মীয় স্কুলকে কুত্তাব ও মক্তবও বলা হয়। আরবি মক্তব শব্দ দ্বারা প্রাথমিক বিদ্যালয় বোঝানো হয়। যেখানে শিশুরা পড়তে, লিখতে ও ব্যাকরণ শিক্ষালাভ করে। এ ছাড়া শিশুরা ইসলামের মৌলিক বিষয় ও কোরআন পাঠ করতে শেখে মক্তবে। 

বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা
দক্ষিণপূর্ব ইউরোপের দেশ বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনায় এখনো মক্তব ব্যরস্থা প্রচলিত আছে। এটাকেই দেশটির ইসলামী শিক্ষার মূল ভিত্তি মনে করা হয়। বসনিয়ায় মক্তব স্কুল চালু হয় উসমানীয় শাসনামলে, যা অস্টো-হাঙ্গেরিয়ান সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার আগ পর্যন্ত চালু ছিল। বর্তমানে প্রথম থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত সব শিক্ষার্থী মক্তবে অংশগ্রহণ করতে পারে। ইসলামিক ইউনিয়ন অব বসনিয়া অ্যান্ড হার্জেগোভিনা স্কুলগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিচালনা করে থাকে। মসজিদের ইমামরা সাপ্তাহিক ছুটির দিন শিশুদের কোরআন পাঠ ও মৌলিক ধর্মীয় বিষয়গুলো শিক্ষা দিয়ে থাকে।

তিউনিসিয়া
মক্তব শিক্ষার ঐতিহ্যকে এখনও গুরুত্বের সাথে ধরে রেখেছে তিউনিসিয়া। তিউনিসিয়ার শিক্ষার ব্যবস্থায় ‘মক্তব’ শিক্ষাকে এখনো বেশ গুরুত্ব দেওয়া হয়। মসজিদ ছাড়াও বিভিন্ন অবস্থাসম্পন্ন ব্যক্তিরা মক্তব শিক্ষার পৃষ্ঠপোষকতা করে থাকেন। তিউনিসিয়ার শিশুদের কোরআন পড়ার হাতেখড়ি মক্তবেই হয়। মক্তবে হাতেকলমে কোরআন শেখানো ও মুখস্ত করানো হয়। নির্দিষ্ট একটা বয়স পর্যন্ত মক্তবে শিক্ষা শেষে মাদ্রাসা কিংবা স্কুলে ভর্তি হয়। অনেক সময় দেখা যায়, মক্তবে পড়ার সময়ই কোরআনে কারিমের বড় একটা অংশ মুখস্ত হয়ে যায় শিক্ষার্থীদের। দেশটিতে মক্তবের শিক্ষকদের বেশ সম্মানের চোখে দেখা হয়। দেশটিতে এমনও দেখা গেছে, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা সকালে মক্তবের শিক্ষক হিসেবে কোরআন শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তিউনিসিয়ায় মক্তব শিক্ষাকে আরও আধুনিক করতে নানা ধরনের গবেষণা চলছে।

রাষ্টীয় পৃষ্ঠপোষকতা-সীমিত পরিসর থেকে  হারিয়ে যাওয়ার পথে
ভারতীয় উপমহাদেশ মুসলিম সুলতানি যুগ থেকে মোগল আমল পর্যন্ত দীর্ঘ ৮০০ বছর র্পর্যন্ত মুসলমানদের প্রধান শিক্ষা ব্যবস্থা ছিল ধর্মীয় শিক্ষা। সেসব প্রতিষ্ঠানের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন শাসকরা। কিন্তু ইংরেজরা ছলে-বলে-কৌশলে এদেশের রাজ্য ক্ষমতা নিছিয়ে নিয়ে বন্ধ করে দেয় মুসলমানদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলো। তদস্থলে চাপিয়ে দেয় পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণাপ্রসূত আধুনিক শিক্ষা নামে কোরআন-হাদীসবিহীন দ্বীন শিক্ষা তথা ধর্মীয় শিক্ষাহীন শিক্ষা ব্যবস্থা। কিন্তু ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা তাদের সন্তানদের ইংরেজ প্রবর্তিত ও পরিচালিত স্কুল-কলেজে পাঠাতেন না, বরং তারা মসজিদ ও কাচারি ঘরে উস্তাদ রেখে সীমিত পরিসরে হলেও সন্তানদের শিক্ষা-দীক্ষার ব্যবস্থা করতেন।

পাড়া-মহল্লায় পাটি, মাদুর বিছিয়ে ছোট ছোট ছেলেমেয়ের কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা করা হতো। এভাবে শহরে-বন্দরে, গ্রামে-গঞ্জে গড়ে  উঠেছিল হাজারো মক্তব-মাদ্রাসা। সময়ের পরিক্রমায় সকালবেলা শিশু-কিশোররা টুপি, পাঞ্জাবি পরে দল বেঁধে কায়দা-সিপারা হাতে নিয়ে মক্তবে যাওয়ার দৃশ্য আগের মতো আর নজরে পড়ে না। মুসলমানদের ঐতিহ্যের স্মারক মক্তবগুলোর এখন মৃতপ্রায় অবস্থা। ছাত্র-ছাত্রীদের উপস্থিতি খুবই নগণ্য। 

রোজ সকালে কোরআনের আওয়াজ কঁচিকাঁচা শিশুদের কন্ঠ থেকে বের হয় না। শিশুদের অভিভাবকদের অবহেলার কারণে মসজিদের ইমাম সাহেবরা এখন মক্তবে কোরআন পড়ানোর আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। যার কারণে এলাকার শিশু-কিশোররা কোরআন শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কোথাও কোথাও দেখা গেছে, মক্তবগুলো রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে এমনিতেই বন্ধ হয়ে গেছে। আবার কোথাও কোথাও যা-ও চালু আছে, সেগুলোতেও আগের মতো জৌলুস নেই। শিশুদের উপস্থিতি নেই বললেই চলে। 

বিভিন্ন অযুহাত দেখিয়ে এখন অভিভাবকেরা কঁচি-কাঁচা ও শিশু-কিশোরদের মক্তবে পাঠাতে চান না। বেশিরভাগ শিক্ষার্থীরা সকালে ঘুম থেকে উঠলেই স্কুল, কোচিং অথবা কিন্ডার গার্টেনে ক্লাসের সময় হয়ে যায়। এ ক্ষেত্রে মসজিদভিত্তিক শিশু ও গণশিক্ষা কার্যক্রম প্রশংসার দাবি রাখে। 

বিলুপ্তির পথে ঐতিহ্যবাহী মক্তব শিক্ষাব্যবস্থা
গ্রাম বাংলার মুসলিম পরিবারের শিশুশিক্ষার মূলভিত্তি ছিলো এই মক্তব শিক্ষা। কালের আবর্তনে হারিয়ে যাচ্ছে শিশু শিক্ষার এই অন্যতম মাধ্যম। মক্তব  শিক্ষা ব্যবস্থা এখন আর দেখা যায় না। ডিজিটালাইজেশনের ছোঁয়ায় কিন্ডার গার্টেন, ক্যাডেট মাদ্রাসা, কওমি মাদ্রাসা ও এতিমখানা, হিফজখানা, কোচিং ব্যবস্থার আড়ালেই হারিয়ে গেছে মক্তব শিক্ষা। 

এভাবে চলতে থাকলে আবহমান বাংলার আনাচে-কানাচে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ইসলামী বুনিয়াদি শিক্ষার এ অবারিত ও ঐতিহ্যগত শিক্ষা ব্যবস্থার অস্তিত্ব বিপন্ন হবে; চিরতরে হারিয়ে যাবে এবং স্থান পাবে ইতিহাসের পাতায় । 

তাই অতীব গুরুত্বপূর্ণ এ শিক্ষা ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য কোনো বিকল্প পথ বের করা সময়ের দাবি।
এএইচ/