সাভারে জঙ্গিদের ভয়াবহ ব্যাংক ডাকাতির ৬ বছর...
মো: রিয়াদুল আহসান নিপু
প্রকাশিত : ০৭:২৭ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৮:৫৩ পিএম, ২১ এপ্রিল ২০২১ বুধবার
টিভি সিরিয়াল বা সিনেমায় ব্যাংক ডাকাতির নানা রোমাঞ্চকর ঘটনার সাথে আমরা সবাই কমবেশি পরিচিত। আজ ২১ এপ্রিল। ঠিক ছয় বছর আগে ২০১৫ সালের আজকের এই দিনে তেমন ই এক দুর্ধর্ষ ঘটনা ঘটেছিল সাভারের আশুলিয়ায় এক ব্যাংকের কাঠগড়া শাখায়। যা হার মানিয়েছিল ভয়াবহ কোন দু:স্বপ্নকেও।
সেদিন দুপুরের খাবার অর্থাৎ নিয়মিত লাঞ্চ ব্রেকের পর লেনদেন শুরু হয়েছে মাত্র, এমন সময় গ্রাহকের ছদ্মবেশে ব্যাংকের ভেতর জঙ্গি ডাকাতদলের ৩ সদস্য প্রবেশ করেন। বাইরে মূল ফটকের সামনে আরও তিন ডাকাত পাহারায় নিযুক্ত ছিল। ডাকাতরা ভেতরে প্রবেশের পর ব্যাংকের কেউ কিছু বুঝে ওঠার আগেই চাপাতির আঘাতে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে গুরুতর আহত করে শাখার নিরাপত্তা কর্মী বদরুল ইসলামকে।
ডাকাত দলের বাকি সদস্যরা তখন ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ওয়ালিউল্লার কক্ষে প্রবেশ করে টেবিলের ওপর একটি বোমা রেখে ভল্টের চাবি কোথায় জানতে চান। ওয়ালিউল্লাহ ভল্টের চাবি দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ডাকাত সদস্যরা তাকে এলোপাথাড়ি কুপিয়ে ও গুলি করে ক্যাশ কাউন্টারে থাকা নগদ টাকা লুট করে নেন।
এসময় ব্যাপক গোলযোগের মধ্যে স্থানীয়রা মসজিদে মাইকে ঘোষণা দিয়ে ডাকাত প্রতিরোধের আহ্বান জানালে ডাকাতরা গুলি ও বোমার (পুলিশের ভাষ্যমতে ককটেল ও হ্যান্ড গ্রেনেড) বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে। ডাকাতদের গুলিতে ঘটনাস্থলেই ব্যাংকের শাখা ব্যবস্থাপক ওয়ালিউল্লাহ, নিরাপত্তা কর্মী বদরুল ইসলাম, ব্যাংকের গ্রাহক ব্যবসায়ী পলাশ, ব্যাংকের নিচে অবস্থিত ওয়ার্কসপ মালিক জিল্লুর রহমান নিহত হন।
পালানোর সময় তিন ডাকাত সদস্যকে আটকে স্থানীয় জনতা গণপিটুনি দিলে একপর্যায়ে এক ডাকাত সদস্য ঘটনাস্থলেই মারা যান। পালানোর চেষ্টাকালে ডাকাত সদস্যদের শটগানের গুলি ও বোমা বিস্ফোরণে গুরুতর আহত হয়ে কাঠগড়া বাজারের দর্জি দোকানের কর্মচারী জমির উদ্দিন, স্থানীয় বাসিন্দা নুর মোহাম্মদ ও আইয়ূব আলী সাভার এনাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।
পরবর্তীতে এই নারকীয় ঘটনার প্রেক্ষিতে মামলা করা হয় এবং তদন্তে ডাকাতদের জংগি সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ মেলে। পুলিশ লুট হয়ে যাওয়া প্রায় ৭ লাখ টাকার পুরোটাই উদ্ধার করে।
জঙ্গি কর্মকাণ্ডের তহবিল সংগ্রহের উদ্দেশ্যে এই হামলা করা হয় বলে গ্রেপ্তারকৃতরা আদালতে জবানবন্দি দেন। ব্যাংক ডাকাতি এবং আটজনকে হত্যার ঘটনায় ছয় জঙ্গিকে মৃত্যুদণ্ড দেয় আদালত। একই সঙ্গে আরো একজনকে যাবজ্জীবন আর দুইজনকে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেয়া হয়। তারা সবাই জেএমবি ও আনসারুল্লাহ বাংলার সদস্য বলে জানা যায়।
দেশব্যাপী আলোচিত এই ঘটনায় দ্রুততার সাথে পুলিশ তদন্ত প্রতিবেদন প্রদান করেছিল এবং বিচার কার্যক্রমও দ্রুততম সময়ের মাঝে শেষ হয়। ভয়াবহ সে ঘটনার স্মৃতি এখনো এলাকাবাসীর স্মৃতিতে রয়ে গেছে।
এই ঘটনা ব্যাংকারদের চরম ঝুঁকির কথাই আমাদের মনে করিয়ে দেয়। যদিও বাস্তবে খুব কম সময়ই এর স্বীকৃতি মেলে। দেশে বর্তমান কোভিড-১৯ সংকটে অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে তারা গনপরিবহনের সংকট এমন কি লকডাউনের মাঝেও গতবারের মত নিরলসভাবে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন। করোনার আঘাতে প্রাণ দিয়েছেন শতাধিক ব্যাংকার। ২য় ঢেউয়ে ইতোমধ্যে মারা গেছেন অন্তত ১২ জন, আক্রান্ত ও উপসর্গ আছে প্রায় সহস্রাধিক ব্যাংক কর্মীর।
একজন ব্যাংকারের মূল দায়িত্ব হল গ্রাহকের অর্থের নিরাপত্তা ও গোপনীয়তা নিশ্চিত করা। সেদিন নিজের জীবন দিয়ে ম্যানেজার ও এক্সিকিউটিভ অফিসার ওয়ালিউল্লাহ রক্ষা করেছিলেন গ্রাহকের আমানত। তার স্মৃতি রক্ষার্থে অবশ্যই রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করা উচিত ছিল। এটি ব্যাংকারদের দায়িত্ব পালনে অনুপ্রাণিত করতো এবং উগ্রবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতো। তবে আলোচিত সেই ঘটনায় নিহতদের জন্য রাষ্ট্রীয়ভাবে কিছু করা হয়েছে কিনা আমার জানা নেই।
আজ ঘটনার ৬ বছর পূর্তিতে ২০১৫ সালের ২১ এপ্রিলে নিহত সকলের আত্নার মাগফেরাত কামনা করি। বাংলাদেশের সকল ব্যাংকার যাতে সবসময় আধুনিক নিরাপত্তা ব্যবস্থাসহ সচেতনভাবে দায়িত্বপালন করতে পারেন আর এমন মর্মান্তিক ঘটনার যাতে পুনরাবৃত্তি না ঘটে সেটাই প্রত্যাশা।
-মো: রিয়াদুল আহসান নিপু, সাধারণ সম্পাদক,অগ্রণী ব্যাংক স্বাধীনতা ব্যাংকার্স পরিষদ ময়মনসিংহ।
আরকে//