সামাজিক মাধ্যমে সমাজ বিশ্লেষণ ও ভিকটিম ব্লেমিং
মোঃ জিশান মাহমুদ
প্রকাশিত : ০৪:১২ পিএম, ২৮ এপ্রিল ২০২১ বুধবার
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে বিশ্বে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের ৫০ শতাংশ মানুষ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংযুক্ত রয়েছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের মধ্যে- ফেসবুক, ম্যাসেঞ্জার, গুগল, ইন্সটাগ্রাম, টুইটার, ভাইবার, ইউটিউব সহ অসংখ্য মাধ্যমে যুক্ত রয়েছে তারা। মানুষ তথ্যের জন্য এখন আর পত্রিকার পাতা ঘাঁটাঘাঁটি করে না। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করেই মানুষ আধুনিক জীবনের তথ্য আদান প্রদান, ভাব বিনিময় ও মতামত প্রদান করে আসছে। প্রযুক্তির বিকাশে সমাজ বিজ্ঞানের পরিধী হিসেবেও Media Sociology একটি অবস্থান তৈরী করে নিচ্ছে। বর্তমানে খুব অল্প সংখ্যক মানুষ টিভি, রেডিও বা সংবাদপত্রের মাধ্যমে সংবাদ সংগ্রহ করে থাকেন।
আমাদের ছেলেবেলায় কিংবা কিশোর বয়সে কখনো কোন হত্যা, ধর্ষণ এর মত ন্যাক্কারজনক ঘটনা ঘটলে আমরা শুধু টিভি বা রেডিওর সংবাদে শুনতাম, পরেরদিন হয়তো পত্রিকায় পাতায় পড়তাম। কিন্তু বর্তমানে প্রযুক্তির ব্যবহারে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করা ছবি, ভিডিও, মতামত ইত্যাদির ওপর মন্তব্য করা যায়। আবার চলে পাল্টা মন্তব্য।
সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে বেশ কয়েকটি হত্যা, ধর্ষণ ও যৌন নির্যাতনের মত চাঞ্চল্যকর ঘটনা সামনে আসার পর ভিকটিম ব্লেমিং নিয়ে তর্ক-বিতর্ক তৈরি হয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভিকটিম ব্লেমিং হচ্ছে এক ধরণের চর্চা। এটা সাধারণত যৌন নির্যাতন বা ধর্ষণের ক্ষেত্রেই সবচেয়ে বেশি শুনতে পাওয়া যায়। যখনই কোন ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের ঘটনা ঘটে তখন সমাজের বেশিরভাগ মানুষের নজর চলে যায় যে এটা কেন হল। অনুসন্ধিৎসু মন জানতে চায় রহস্যটা আসলে কোথায়। দুনিয়ায় এত মেয়ে থাকতে সে ই বা কেন ধর্ষণ কিংবা যৌন নির্যাতনের শিকার হল। কেউ কেউ প্রশ্ন করে বসেন, মেয়েটির পোষাক ঠিক ছিল না, শরীরে ওড়না ছিল না, এতো রাতের বেলায় মেয়েটি কেন বের হয়েছে -এগুলোর সবই হল ভিকটিম ব্লেমিং। সামাজিক মাধ্যমে ভিকটিম ব্লেমিং বেশি হলে অনেক ক্ষেত্রে ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্রের মনোযোগ আর অপরাধীর উপর থাকে না। ভিকটিমের স্বভাব চরিত্রের উপর গিয়ে পড়ে।" এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট এর আইনজীবী মমতাজ পারভীন মৌ বলেন, “ভিক্টিম ব্লেইমিং আমাদের প্রাগৈতিহাসিক কালের স্বভাব, বিশেষ করে যদি হয় সে নারী। এটা বিচারহীনতার সংস্কৃতি গড়ে তোলায় ও ন্যায়বিচারকে বাধাগ্রস্থ করার অন্যতম সহায়ক।”
হালে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসা শিক্ষার্থী নুসরাতকে মাদ্রাসার ছাদেই পুড়িয়ে মারা হয়েছে অত্যন্ত নারকীয়ভাবে৷ ওসি মোয়াজ্জেমের ছড়িয়ে দেয়া ভিডিও না থাকলে হয়তো এ নারকীয় হত্যা পাড়া গায়েঁর বাইরে বের হতেই পারতো না৷ দেশকে আলোড়িত করার প্রশ্নই ওঠে না৷ হালের অধিকাংশ অপরাধই আমরা কোন না কোনভাবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে পেয়েছি৷ যত বড় অপরাধই হোক না কেনো প্রশাসনকে চাপে ফেলতে সামাজিক মাধ্যমে ভাইরালই মোক্ষম অস্ত্র।
অন্যদিকে, রিফাত হত্যাকান্ডে আয়শা সিদ্দিকা মিন্নিকে আসামি করার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশিরভাগ মানুষের প্রতিক্রিয়া ছিল অগ্রহণযোগ্য ও অসংবেদনশীল। প্রায় হালের মুনিয়ার আত্মহত্যা বা হত্যা (তদন্ত সাপেক্ষে) এর মত। পার্থক্য হল নারী হয়ে মিন্নি ছিল সেখানে আসামী আর এখানে মুনিয়া ভিকটিম!
যে মানুষটি নুসরাত হত্যার জন্য নুসরাতের পক্ষে কলম ধরেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সে মানুষটিই আবার মুনিয়ার বিপক্ষে লিখছে। এটা কি শুধু ভিকটিম ব্লেমিং? রিফাত হত্যাকান্ডের নায়িকা মিন্নি কিংবা মুনিয়ার উপর নির্যাতন সমাজের অস্বাভাবিক দুর্ঘটনা। এখানে কি ব্যক্তির পারিবারিক শিক্ষা, মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা, সমাজ কাঠামো ও রাষ্ট্রযন্ত্র দায়ী নয়? মানুষের মাঝে বহুযুগের যে সামাজিক শিক্ষা ও সংস্কৃতি তাতে আঘাত প্রাপ্ত হলে মানুষ যদি সত্য কথা বলতে না পারে তাহলে তার শিক্ষাকে বলি দেয়া হয়। যে মানুষটি বিবেকের তাড়নায় নুসরাতের পক্ষে ছিল, তার পক্ষেই বুকের রক্ত দিয়ে মিন্নি কিংবা মুনিয়ার পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লেখা অসম্ভব হয়ে পড়ছে। তদুপরি কিছু মানুষ হয়তো কোনটা অসামাজিক, কোনটা ভিকটিম ব্লেমিং সেটা ঠিক ঠাহর করিতে পারেনা। রাতারাতি পুরো সমাজের মানুষের মন মানসিকতার পরিবর্তন হয়তো করা কঠিন৷ প্রয়োজন ঘরে ঘরে সুশিক্ষা।
মিন্নি কিংবা মুনিয়ার ঘটনা সামাজিক অবক্ষয়ের কারণেই সৃষ্ট। কেন মিন্নি কিংবা মুনিয়ার ঘটনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সংবেদশীল আকারে আসছে না বিষয়টি নিয়ে সমাজ বিজ্ঞানীদের আরো নজর দেয়ার প্রয়োজন আছে বৈকি! ধর্মীয় অনুশাসনের অনুশীলন, পরমত সহিষ্ণুতা, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ জাগ্রত করাসহ সর্বক্ষেত্রে অশ্লীলতাকে শুধু বর্জনই নয়, প্রতিরোধ করা কি সত্য যুগের শিক্ষা নয়?
লেখক : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্ট।
এসএ/