ঢাকা, রবিবার   ২২ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৭ ১৪৩১

বুক রিভিউ: গুলদহ

এম সানাউল হক

প্রকাশিত : ০৫:৩৯ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৬:০৬ পিএম, ২৯ এপ্রিল ২০২১ বৃহস্পতিবার

'গুলদহ' লেখক জাহিদ রহমানের প্রথম প্রকাশিত বই। বইমেলা ২০২১'এ পেন্সিল পাবলিকেশনস বইটি প্রকাশ করেছে। মো. সাদিতউজজামানের করা সুন্দর প্রচ্ছদে মোড়া ১৩৬ পৃষ্ঠার বইটিতে আগমন প্রিন্টার্সের মুদ্রণ ও বাঁধাই উন্নত মানের। মূল্য ৩২৫ টাকা মাত্র।

বাংলাদেশের সীমান্তবর্তী এক প্রত্যন্ত এলাকায় গুলদহ নামের এক বিলকে ঘিরে বিরাজমান গ্রামীন জনপদের সাধারণ মানুষ ও তাদের যাপিত জীবন এ উপন্যাসের পটভূমি। অভাব-অনটন, আর্থিক টানা-পোড়েন, বেকারত্ব ইত্যাদির প্রেক্ষাপটে মানুষের বেঁচে থাকার বাস্তব সংগ্রামকে উপজীব্য করে এ উপন্যাস বেড়ে উঠেছে। এ জীবন-মুদ্রার এক পিঠে মানব মনের আশা-আকাঙ্খা, ভালোবাসা, অতি সাধারণ স্বপ্ন সাধ-আহ্লাদ ইত্যাদির শ্বাশত দেশজ চিত্র। আরেক পিঠে অন্যায়, অত্যাচার, কুশিক্ষা, কুসংষ্কার, পুরুষতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায় নারী নির্যাতন, শ্রেণীবৈষম্য, সবল কর্তৃক দুর্বলের এক্সপ্লয়টেশনের চিত্র। 

লেখকের নির্মোহ চরিত্রায়ণে সীমান্তবর্তী এলাকার প্রান্তিক অনগ্রসর সমাজের রূঢ় বাস্তবতা নগ্নভাবে উঠে এসেছে। এ জনপদে কতিপয় মানুষ এখনো কৃষিজীবী। কিন্তু অধিকাংশই ড্রাগ ও গরু চোরাচালানী চক্রের কাজে জড়িত। এখানে শিক্ষার আলো এখনো পৌঁছেনি। মদ, জুয়া, ড্রাগ, মেয়েমানুষ হলো পুরুষের আনন্দ। আর মুখ বুজে স্বামীর নানা অত্যাচার, শারীরিক নির্যাতন, সমাজের লোলুপ দংশন, এমনকি নিতান্ত বেঁচে থাকার দায়ে দেহদান পর্যন্ত যেন নারীর অবধারিত ভাগ্যলিখন। 

লেখক অত্যন্ত মুন্সিয়ানার সাথে উপন্যাসের প্রতিটি চরিত্র গড়ে তুলেছেন। লাইলি, কাজেম, মানিক, আলকেস, মেম্বার, কারেন্ট - এরা প্রত্যেকে ব্যক্তি হিসাবে জীবনের নানা আশা-নিরাশা, সুখ-দুঃখ, দোষ-গুণ পাঠকের সামনে সরাসরি তুলে ধরে। আবার সামষ্টিকভাবে এদের মাধ্যমে প্রতিফলিত হচ্ছে সেই সমাজের ভালো মন্দ, আলো-আঁধার। 

লেখক উপন্যাসের প্রেক্ষাপটকে যথাযথভাবে পাঠকের সামনে তুলে ধরার জন্য পুরো বইটিতে আঞ্চলিক কথ্য ভাষা ব্যবহার করেছেন, যার যথার্থতা প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার সম্ভাবনা বেশী। কারণ, শুদ্ধ ভাষার ব্যবহারে সমাজের প্রতি দায় ঔপন্যাসিকগণ অস্বীকার করতে পারেন না। তাই শুধুমাত্র সংলাপে কথ্য বা আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার করা হলেই সম্ভবতঃ সমালোচনার তীর এড়ানো যেত। হয়তো এ কারণেই বইটির প্রথম অধ্যায়েই গুলদহ বিলের কচুরিপানার ভিতর পাওয়া লাশকে 'একটা মেয়েমানুষের লাশ' ভাষায় উল্লেখ করা হয়েছে, যে ভাষা একাধারে লাশের প্রতি তথা নারীর প্রতি অবমাননাকর। এক্ষত্রে 'একজন নারীর লাশ' অনেক বেশী সামাজিক শিষ্টাচারবদ্ধ হতো। 

উপন্যাসটিতে ঘটনার বিস্তার ও চরিত্রের বিকাশ বেশ সাবলীল ও গতিময়। গল্পটি কোথাও তেমন ঝুলে যায় নি। পাঠককে গল্পের প্রতি আকৃষ্ট করার জন্য লেখক রহস্য উপন্যাসের স্টাইলে শেষ অধ্যায় থেকে ক্লাইম্যাক্সকে বেশ সাফল্যের সাথে প্রথম অধ্যায়ে টেনে এনেছেন। এটি একটি কার্যকরী কৌশল, যা পৃথিবীর বহু বিখ্যাত থ্রিলার বা রহস্যোপন্যাস লেখক যুগে যুগে ব্যবহার করেছেন। কিন্তু সেই একই মাপকাঠিতে এক্ষেত্রে শেষ অধ্যায়টিকে বাহুল্য মনে হয়েছে। এ অধ্যায়টির আগেই উপন্যাসটি শেষ হয়ে গেলে পাঠক বাকিটুকু ভেবে নিতে পারতো। কিন্তু এখন পড়া শেষে আর ভাবার কোনো রেশ রইলো না!

সামগ্রিক বিচারে উপন্যাসটি পাঠকপ্রিয়তা অর্জন করবে বলেই আমার বিশ্বাস, যদিও সাহিত্য সমালোচকদের বিশ্লেষনী পোস্টমর্টেম সম্পর্কে অনিশ্চয়তা রয়ে যাচ্ছে। 

বই- গুলদহ
ধরণ- উপন্যাস 
লেখক- জাহিদ রহমান 
প্রকাশনী- পেন্সিল পাবলিকেশনস

এসি