সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলো
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১২:০৩ পিএম, ১ মে ২০২১ শনিবার
সত্যজিৎ রায়। প্রখ্যাত চলচ্চিত্রকার। শুধু চলচ্চিত্রকার নয়, তিনি শিল্প-সাহিত্যের সক্রিয় সারথি, বহুমুখী ব্যক্তিত্বের প্রতিভূ। কালান্তরের চিত্রনাট্যকার, শিল্প নির্দেশক, সঙ্গীত পরিচালক, লেখক, সঙ্গীত স্বর লিপিকার, সম্পাদক, প্রকাশক ও প্রচ্ছদ শিল্পী। বাংলা চলচ্চিত্র তো বটেই এমনকি পুরো উপমহাদেশের চলচ্চিত্রকে এক ভিন্ন মাত্রায় নিয়ে গিয়েছিলেন তিনি। ২ মে তার জন্মদিন। তবে এবারের জন্মদিনটা বিশেষ। কারণ শতবর্ষে সত্যজিৎ।
চলচ্চিত্র শিল্পে সত্যজিৎ রায়ের যাত্রা শুরু ‘পথের পাঁচালি’ সিনেমা নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এরপর তিনি একের পর এক অসাধারণ সব সিনেমা নির্মাণ করেছেন। চলচ্চিত্র নির্মাতা হিসেবে সত্যজিৎ রায়ের ছিল বহুমুখী সৃজনশীলতা। তার কাজের পরিমাণ বিপুল। তিনি ৩৭টি পূর্ণদৈর্ঘ্য কাহিনীচিত্র, প্রামাণ্যচিত্র ও স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।
জন্মশত বর্ষের আয়োজনে সত্যজিৎ রায়ের বিখ্যাত সিনেমাগুলো নিয়ে তৈরি করা হয়েছে এই প্রতিবেদন -
অপু ট্রিলজি
সত্যজিৎ রায়ের তিন পর্বে তৈরি অপুর কাহিনী পঞ্চাশের দশকে চলচ্চিত্র জগতে আলোড়ন ফেলে দিয়েছিল। শিশু অপুর বাল্যজীবন নিয়ে এর প্রথম খণ্ড পথের পাঁচালি ছিল সত্যজিৎ রায়ের প্রথম ছবি। পথের পাঁচালির পরবর্তী পর্ব ‘অপরাজিত’তে দেখানো হয়েছে বালক অপুর কিশোর হয়ে ওঠার কাহিনী। তৃতীয় ও শেষ পর্ব ‘অপুর সংসার’।
মহানগর
নরেন্দ্রনাথ মিত্রের ‘অবতরণিকা’ গল্প অবলম্বনে ১৯৬৩ সালে ‘মহানগর’ নির্মাণ করেন সত্যজিৎ রায়। নগরায়নের ফলে ষাটের দশকে বাঙালি মধ্যবিত্তের জীবনে সৃষ্ট নানা জটিলতা এবং তাদের মানসিক জগতের পরিবর্তন নিয়ে নির্মাণ করা হয়েছে ছবিটি।
চারুলতা
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের উপন্যাস ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’ বা ‘দ্য লোনলি ওয়াইফ’। সামাজিক বেড়াজালের মধ্যে ‘চারুলতা’র এগিয়ে যাওয়াকে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে ছবিতে।
অরণ্যের দিনরাত্রি
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস ‘অরণ্যের দিনরাত্রি’ অবলম্বনে নির্মাণ করা হয়েছে এই সিনেমা। চারজন যুবককে নিয়ে তৈরি হয়েছে ছবির কাহিনী। শহরের বন্দিজীবন থেকে বের হয়ে চার বন্ধুর অরণ্যের আদিমতায় নিজেদের আবিষ্কারের গল্প এটা।
হীরক রাজার দেশে
হীরক রাজার দেশে একটি রাজনৈতিক চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের প্রতিটি চরিত্রই প্রতীকী। রাজসভার সবাই রাজার কথার সাথে সুর মেলায়। দেখানো হয় সামাজিক বৈষম্য। ‘হীরক রাজার দেশে’ সিনেমার বিপ্লবী চরিত্র হচ্ছে উদয়ন পণ্ডিত। উদয়ন পণ্ডিত হচ্ছে রাজার সবচেয়ে বড় শত্রু।
আগন্তুক
সত্যজিৎ রায়ের ক্যারিয়ারের সর্বশেষ ছবি ‘আগন্তুক’। হালকা মেজাজের চলচ্চিত্র এটি। ছবিটি সত্যজিৎ রায় নির্মাণ করেন তার ছোটগল্প ‘অতিথি’ থেকে। ছবির প্রধান চরিত্র মনোমোহন মিত্র পুরো বিশ্বে ঘুরে বেড়িয়েছেন। কিন্তু তার বরাবরই পছন্দসই বন্য জীবন।
সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালী’ মোট ১১টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার লাভ করে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাওয়া ‘বেস্ট হিউম্যান ডকুমেন্ট’ পুরস্কারটি। তার পরের দুটি সিনেমা ‘অপরাজিত’, ‘অপুর সংসার’ আর ‘পথের পাঁচালী’—এ তিনটি চলচ্চিত্র একত্রে অপু ট্রিলজি হিসেবেই পরিচিত। ‘অপরাজিত’ সিনেমার সাফল্য সত্যজিৎ রায়কে আন্তর্জাতিক মহলে আরও পরিচিত করে তোলে। ভেনিসে গোল্ডেন লায়ন পুরস্কারও জেতে সিনেমাটি। অপু ট্রিলজি শেষ করার আগে সত্যজিৎ রায় আরও দুটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এর প্রথমটি ছিল ‘পরশপাথর’ নামের হাস্যরসাত্মক একটি সিনেমা। আর পরেরটি ছিল জমিদারি প্রথার অবক্ষয় নিয়ে নির্মিত ‘জলসাঘর’। এর বাইরে বিভিন্ন সামাজিক সমস্যা নিয়ে সত্যজিৎ রায়ের সিনেমাগুলো হচ্ছে ‘দেবী’ (১৯৬০), ‘তিন কন্যা’ (১৯৬১) ও ‘অভিযান’ (১৯৬২)।
১৯৬২ সালে সত্যজিৎ ‘কাঞ্চনজঙ্ঘা’ নামে প্রথম মৌলিক চিত্রনাট্যনির্ভর রঙিন চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। দার্জিলিংয়ের এক পাহাড়ি এলাকায় একটি উচ্চবিত্ত পরিবারে কাটানো এক বিকেলের কাহিনী নিয়ে জটিল ও সঙ্গীতনির্ভর এই সিনেমাটি বানিয়েছিলেন তিনি। ১৯৬৪ সালে সত্যজিৎ নির্মাণ করেন ‘চারুলতা’। যেটি ছিল তার কর্মজীবনের সফল সিনেমা। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছোটগল্প ‘নষ্টনীড়’ অবলম্বনে নির্মিত সিনেমাটিতে উনিশ শতকের এক নিঃসঙ্গ বাঙালি বধূ চারু ও ঠাকুরপো অমলের প্রতি তার অনুভূতির কাহিনী বাস্তব জীবনের নিরিখে নির্মাণ করা হয়েছে। ‘নায়ক’ (১৯৬৬), ‘প্রতিদ্বন্দ্বী’ (১৯৭০), ‘সীমাবদ্ধ’ (১৯৭১) ও ‘জন অরণ্য’ (১৯৭৫) সিনেমাও তার উল্লেখযোগ্য কাজের মধ্যে অগ্রগণ্য।
বাংলা চলচ্চিত্রের বাইরে সত্যজিৎ রায় ১৯৭৭ সালে ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ নামের হিন্দি ও উর্দু সংলাপ নির্ভর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন। এটিই ছিল বাংলা ভাষার বাইরে অন্য ভাষায় নির্মিত সত্যজিৎ রায়ের প্রথম চলচ্চিত্র। শুধু তা-ই নয়, ‘শতরঞ্জ কি খিলাড়ি’ হচ্ছে সত্যজিৎ রায় নির্মিত সবচেয়ে ব্যয়বহুল ও তারকাসমৃদ্ধ সিনেমা। এতে অভিনয় করেছিলেন সঞ্জীব কুমার, সাইদ জাফরি, আমজাদ খান, শাবানা আজমি, ভিক্টর ব্যানার্জি ও রিচার্ড অ্যাটেনবরোর মতো তারকা অভিনয়শিল্পীরা। পরবর্তীকালে সত্যজিৎ প্রেমচাঁদের গল্পের ওপর ভিত্তি করে হিন্দি ভাষায় এক ঘণ্টার একটি সিনেমা বানিয়েছিলেন ‘সদ্গতি’ নামের।
১৯৮৩ সালে সিনেমার কাজ করার সময় সত্যজিৎ হৃদরোগে আক্রান্ত হন। এরপর তার কাজের গতি একেবারে কমে আসে। স্বাস্থ্যের অবনতির ফলে ছেলে সন্দ্বীপ রায়ের সহায়তায় ১৯৮৪ সালে সত্যজিৎ রায় ‘ঘরে বাইরে’ সিনেমাটির নির্মাণকাজ সমাপ্ত করেন। ১৯৮৭ সালে সত্যজিৎ তার বাবা সুকুমার রায়ের ওপর একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেন। তার শেষ তিনটি সিনেমা প্রথম দিকের সিনেমাগুলোর চেয়ে অনেক বেশি সংলাপ নির্ভর ছিল। সিনেমাগুলো হচ্ছে ‘গণশত্রু’ (১৯৮৯), ‘শাখাপ্রশাখা’ (১৯৯০) ও আগন্তুক’ (১৯৯১)।
১৯৯২ সালে হৃদযন্ত্রের জটিলতা নিয়ে সত্যজিৎ হাসপাতালে ভর্তি হন। তারপর সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার। ২৩ এপ্রিল সত্যজিৎ রায় মৃত্যুবরণ করেন।
এসএ/