সচেতন হলেই থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধ সম্ভব
ডা. গুলজার হোসেন উজ্জল
প্রকাশিত : ০৮:৪০ এএম, ৮ মে ২০২১ শনিবার
বাংলাদেশের প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ জ্ঞাতে বা অজ্ঞাতে থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। এদের অধিকাংশ বাহকেরা জানতেও পারেনা যে তারা বাহক। দুজন বাহকে বিয়ে হয়ে গেলে সর্বনাশ। সম্ভাবনা থাকে এদের পঁচিশ শতাংশ বাচ্চা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত হবে, পঞ্চাশ শতাংশ হবে বহনকারী। তবে একজন বাহক আর একজন বাহক নন এমন ব্যক্তির মধ্যে বিয়ে হলে কোন ভয় নেই।
বাংলাদেশে প্রতিবছর দেড় হাজার বাচ্চা থ্যালাসেমিয়া নিয়ে জন্ম গ্রহণ করছে। নিয়ন্ত্রণ না করতে পারলে আগামি পঞ্চাশ বছরে থ্যালাসেমিয়ার রোগী দ্বিগুন হয়ে যাবে। ব্যাপারটার ভয়াবহতা কি আমরা বুঝতে পারছি?
এখন আমাদের করণীয় কি?
একটা প্রোগ্রাম হাতে নিলেই বড় একটা কাজ হয়ে যাবে। সেটা হলো দেশের সব মানুষকে বিনামূল্যে হিমোগ্লোবিন ইলেক্ট্রোফোরেসিস করার একটা ব্যাবস্থা করা যায়। অথবা শুধু স্কুলগুলোতে রক্তের রুটিন পরীক্ষার ব্যাবস্থা করা। তাহলেই কাদের নিরব এনিমিয়া আছে দেখে নেওয়া যাবে। এভাবে সবাইকেই জানানোর বিষয়টা ব্যবস্থা করতে হবে। ব্লাড গ্রুপের মত সব মানুষ জানুক তার হিমোগ্লোবিনের খবর। সে কি ক্যারিয়ার (বাহক) নাকি নিরব সাফারার?
এইটুকু কাজ হলেই হবে। যখন মানুষ জানতে পারবে, তখন দু’জন ক্যারিয়ার (বাহক) বিয়ে করবেনা। বা যদি করেই ফেলে বাচ্চা পেটে আসলে ভ্রুনের পরীক্ষা করিয়ে নেবে। বাচ্চা যদি থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত হয়, পৃথিবীতে তাকে এনে কষ্ট দেওয়ার থেকে ভ্রুণেই বিদায় জানানো। এর জন্য সরকার, এনজিও, দাতা গোষ্ঠী সাহায্য দেবে।
আমার দাবীটা একটু বেশিই মনে হতে পারে। কিন্তু বিশ বছর পর থ্যালাসেমিয়া একটা জাতীয় দু:খ হয়ে যাবে। সাইপ্রাসে এরকম হয়েছিল। বিশ্বের সবচেয়ে বেশি থ্যালাসেমিয়া রোগী ছিল তাদের দেশে। তারা ঠিক উপরের পদ্ধতিতে কাজ করে এখন থ্যালাসেমিয়াকে নিয়ে এসেছে প্রায় শূন্যের কোঠায়। বাংলাদেশেও সম্ভব।
বিষয়টা সবার জানা দরকার। সেই সাথে সবাইকে জানানো দরকার। বাংলাদেশ ইপিআইতে সাফল্য পেয়েছে, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও। যদি আমরা চাই, তাহলে এখানেও পাওয়া সম্ভব। সেই একই পদক্ষেপ। বিজ্ঞাপন বানানো, প্রচার করা। কোন একজন সেলিব্রেটিকে দিয়ে বিষয়টা বলানো। স্কুল প্রোগ্রাম বা কলেজে শিক্ষকদের দিয়ে বলানো। এইসব আরকি। শুধু একটা সমন্বিত উদ্যোগ দরকার। আসুন, থ্যালাসেমিয়াকে জানুন, অন্যকে জানান। ঐক্যবদ্ধ হোন, একটা সুন্দর আগামি গড়ে তুলুন।
আজ ৮ মে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। প্রতিবছরের মতো এ বছরও ৮ মে পালিত হচ্ছে বিশ্ব থ্যালাসেমিয়া দিবস। থ্যালাসেমিয়া রক্তের এক বিশেষ ধরনের অসুখ। এটা ক্যানসার নয়, ছোঁয়াচেও নয়। থ্যালাসেমিয়া একটি জিনগত রোগ। মানুষের শরীরে কোষের ভেতর যে জিন থাকে, সেই জিন এই রোগের বার্তা বহন করে।
আসুন থ্যালাসেমিয়াকে জানি
আমাদের রক্ত কেন লাল? কারণ, আমাদের রক্তে লোহিত রক্তকণিকা থাকে। এখানে হিমোগ্লোবিন নামে বিশেষ ধরনের রঞ্জক পদার্থও থাকে। এই হিমোগ্লোবিনের কাজ কী? হিমোগ্লোবিনের কাজ হলো শরীরের বিভিন্ন অংশে অক্সিজেন সরবরাহ করা।
থ্যালাসেমিয়া বলে এক ধরনের বংশগত রোগ আছে। এটি শরীরে বিশেষ ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লেবিন তৈরি করে। স্বাভাবিক লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল ১২০ দিন। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনের কারণে অথবা বলা যায় হিমোগ্লোবিন ঠিকমতো তৈরি না হওয়ায় লোহিত কণিকার আয়ুষ্কাল কমে যায় এবং লোহিত কণিকাগুলো সহজেই ভেঙে যায়। এ অবস্থায় অস্থিমজ্জার পক্ষে একই হারে লোহিত কণিকা তৈরি সম্ভব হয়ে ওঠে না। এতে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। সেখান থেকে দেখা দেয় নানা রকম উপসর্গ। এই হলো থ্যালাসেমিয়া।
থ্যালাসেমিয়ার প্রকারভেদ
থ্যালাসেমিয়া অনেক রকমের আছে। ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিনেরও রকমফের আছে। তবে মোটামুটিভাবে বলা যায়, থ্যালাসেমিয়া প্রধাণত দুই প্রকার: ১. আলফা থ্যালাসেমিয়া। ২. বিটা থ্যালাসেমিয়া।
বিশ্বে বিটা থ্যালাসেমিয়ার চেয়ে আলফা থ্যালাসেমিয়ার প্রাদুর্ভাব বেশি। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে আলফা থ্যালাসেমিয়া তীব্র হয় না। অনেক ক্ষেত্রে এর উপসর্গও বোঝা যায় না, রোগী স্বাভাবিক জীবনযাপন করে। বিটা থ্যালাসেমিয়া আবার দুই রকমের হতে পারে। একটি বিটা থ্যালাসেমিয়া মাইনর। এদের থ্যালসেমিয়া ট্রেইট বা ক্যারিয়ার বলে। অপরটি থ্যালাসেমিয়া মেজর।
থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট আর থ্যালাসেমিয়া এক নয়। কারণ, এরা মূলত রোগটির বাহক। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এদের শরীরে থ্যালাসেমিয়ার লক্ষণ প্রকাশ পায় না। অনেকে হয়তো অজান্তেই সারাজীবন এই রোগ বহন করে চলে। অল্প কিছু ক্ষেত্রে মৃদু রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। বাবা ও মা উভয়ে থ্যালাসেমিয়া ট্রেইট হলে ভূমিষ্ঠ শিশুর শতকরা ২৫ ভাগ থ্যালাসেমিয়া রোগে আক্রান্ত হয়।
উপসর্গ
থ্যালাসেমিয়ার উপসর্গগুলো মূলত রক্তস্বল্পতার কারণে সৃষ্ট উপসর্গ। অর্থাৎ ক্লান্তি, অবসাদগ্রস্ততা, শ্বাসকষ্ট, ফ্যাকাসে হয়ে যাওয়া এসব। রক্ত অধিক হারে ভেঙে যায় বলে জন্ডিস হয়ে ত্বক হলদে হয়ে যায়। প্রস্রাবও হলুদ হতে পারে। প্লীহা বড় হয়ে যায়। যকৃতও বড় হয়ে যেতে পারে। অস্থি পাতলা হয়ে যেতে থাকে। চেহারার বিশেষ পরিবর্তন হয়। নাকের হাড় দেবে যায়। মুখের গড়ন হয় চীনাদের মতো। একে বলে ‘মংগোলয়েড ফেইস’। আস্তে আস্তে দেখা দেয় বিশেষ কিছু জটিলতা।
রোগীকে ঘনঘন রক্ত দিতে হয় বলে শরীরে আয়রনের মাত্রা বাড়তে থাকে। এই আয়রন জমা হয় হৃৎপিণ্ডে, যকৃতে, অগ্ন্যাশয়ে। এই পর্যায়টি মারাত্মক। দেখা যায়, অতিরিক্ত আয়রন জমে যাওয়ার কারেণে অঙ্গগুলো বিকল হতে শুরু করে। এ রকম পরিস্থিতিতে সঠিক চিকিৎসা না পেলে রোগী মারা যেতে পারে। বারবার রক্ত পরিসঞ্চালনের কারণে রোগীরা সহজেই রক্তবাহিত সংক্রামক রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়ে।
পরীক্ষা-নিরীক্ষা
থ্যালাসেমিয়া শনাক্ত করার উপায় হলো, রক্তের হিমোগ্লোবিন ইলেকট্রোফরেসিস পরীক্ষা। রক্তের রুটিন পরীক্ষা করলে রক্তস্বল্পতার মাত্রা বোঝা যায়। এ ছাড়া এই রোগে লোহিত কণিকার আকার ছোট হয়ে যায়। রুটিন পরীক্ষায় সেটাও বোঝা যায়। এতে প্রাথমিক সন্দেহটা এখান থেকেও আসতে পারে। এ ছাড়া ডিএনএ পরীক্ষা করেও এই রোগ ধরা যায়। মাথার এক্স-রে, পেটের আলট্রাসনোগ্রাম এগুলোও আছে।
চিকিৎসা
রক্ত পরিসঞ্চালনই থ্যালাসেমিয়ার মূল চিকিৎসা। আয়রন বেড়ে গেলে ওষুধের মাধ্যমে তা কমাতে হবে। আয়রন সমৃদ্ধ খাবার বা আয়রনের ওষুধ খাওয়া একদম নিষেধ। প্লীহা বড় হয়ে গেলে অপারেশন করে সেটা ছোট করে দিতে হয়। এতে রক্ত গ্রহণের হার কিছুটা কমে আসে। মূলত অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন হলো এর স্থায়ী চিকিৎসা। এটা খুবই ব্যয়বহুল।
পরিসংখ্যান
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সারা বিশ্বে প্রায় ১০ কোটির বেশি লোক বিভিন্ন ধরনের বিটা থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করে। প্রতিবছর প্রায় এক লাখ শিশুর জন্ম হচ্ছে জটিল থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে। বাংলাদেশে থ্যালাসেমিয়া রোগীদের সঠিক পরিসংখ্যান নেই।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, বাংলাদেশে ৪৮ লাখ মানুষ থ্যালাসেমিয়ার জিন বহন করছে। ৩ শতাংশ লোক বিটা থ্যালাসেমিয়ার বাহক, ৪ শতাংশ অন্যান্য ত্রুটিপূর্ণ হিমোগ্লোবিন রোগের বাহক। প্রতিবছর ছয় হাজার শিশু বিভিন্ন রকমের থ্যালাসেমিয়া রোগ নিয়ে জন্মগ্রহণ করছে।
থ্যালাসেমিয়া প্রতিরোধে সচেতনতা খুব জরুরি। বিয়ের আগে রক্ত পরীক্ষা করে থ্যালাসেমিয়া অনেকখানি কমানো যেতে পারে। দুজন ক্যারিয়ারের (বাহক) মধ্যে যেন বিয়ে না হয়, সেটা নিশ্চিত করতে পারলে থ্যালাসেমিয়া কমানো সম্ভব। আত্মীয়র মধ্যে বিয়ে করা যাবে না। ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্রে বাচ্চা পেটে আসার পর চিকিৎসকের পরামর্শে বিশেষ উপায়ে গর্ভস্থ শিশুর থ্যালাসেমিয়া পরীক্ষা করতে হবে। রোগ ধরা পড়লে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যাবরশন করা যেতে পারে। পৃথিবীর অনেক দেশে এ উপায়ে থ্যালাসেমিয়ার প্রকোপ কমানো গেছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা আশঙ্কা করছে, আগামী ৫০ বছরে থ্যালাসেমিয়া পৃথিবীজুড়ে একটি বড় রকমের সমস্যা হয়ে দেখা দেবে। তাই এটি রোধে ব্যাপক সচেতনতা দরকার। সরকারি, ব্যক্তিগত, সামাজিক, গণমাধ্যম সব দিক থেকেই এই সচেতনতা তৈরিতে কাজ করতে হবে। তবেই থ্যালাসেমিয়া নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে।
লেখক : রক্তরোগ বিশেষজ্ঞ ও প্রাক্তন রেসিডেন্ট, হেমাটোলজি বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়।
এসএ/