ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

করোনা ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছে রাসনা শারমিন 

জামাল হোসেন, বেনাপোল প্রতিনিধি:

প্রকাশিত : ১০:৫৫ এএম, ১৭ মে ২০২১ সোমবার

ভয় করে বাইরে যেতে, ঝুঁকির মধ্যেই কাজ করে যাচ্ছে অকুতোভয় রাসনা শারমিন মিথি। রাসনা শারমিন মিথি নিবার্হী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে কর্মরত যশোরের সীমান্তবর্তী শার্শা উপজেলায়। ৩৫তম বিসিএস ক্যাডারের এই কর্মকর্তা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে হবিগজ্ঞ জেলায় যোগদান করেন। এর পর যশোর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে বদলি হয়ে চলে আসেন। যশোরে থাকার সময় ২০২০ সালের ১৩ আগস্ট শার্শায় সহকারী কমিশনার (ভূমি) হিসেবে যোগদান করেন। 

একজন সৎ ও সাহসী সৈনিক জীবনের মায়া ত্যাগ করে জীবনের মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে করোনার সম্মুখযোদ্ধা হিসেবে বেনাপোল স্থলবন্দরে ভারত ফেরত বাংলাদেশি যাত্রীদের সেবা দিয়ে আসছেন। গত ২৬ এপ্রিল সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত বেনাপোল পোর্ট এলাকায় দায়িত্ব পালন করে চলেছেন। উদ্দেশ্য হচ্ছে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত হতে আগত বাংলাদেশিদের দুই সপ্তাহের জন্য বাধ্যতামূলক প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করা। 

কোভিডি-১৯ মহামারির সাম্প্রতিক ঢেউ ভারতের স্বাস্থ্য ব্যবস্থার ওপর বিরাট আঘাত হেনেছে এবং ভারতীয় ভেরিয়েন্ট হিসেবে পরিচিতি পাওয়া ট্রিপল মিউটেন্ট করোনা ভেরিয়েন্টের সংক্রমণ থেকে দেশকে রক্ষা করার জন্য ২৬ এপ্রিল থেকে ভারতের সঙ্গে যাত্রী চলাচলে সাধারণ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে। তবে বিশেষ ব্যবস্থা হিসেবে যাদের ভিসার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাচ্ছে তারা কলকাতাস্থ বাংলাদেশের উপহাইকমিশন থেকে এনওসি সংগ্রহ করে দেশে আসতে পারবেন তবে দেশে আসার পর আবশ্যিকভাবে ১৪ দিনের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে নিজ খরচে স্থানীয় প্রশাসন কর্তৃক নির্ধারিত স্থানে থাকতে হবে। 

বিশেষ অনুমতিতে গত ২৬ এপ্রিল থেকে শুক্রবার (১৪ মে) পর্যন্ত দেশে ফিরেছেন ২ হাজার ৮০২ জন। যাদের যশোরসহ পার্শ্ববর্তী পাঁচ জেলায় প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। এর মধ্যে ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন শেষ করে ফিরে গেছেন ১১৭০ জন এবং বর্তমানে কোয়ারেন্টিনে আছেন ১৬৩২ জন।

প্রশাসনিক কর্মকর্তারা তাদের কোয়ারেন্টাইনে বাধ্য করায় মারাত্মক তোপের মুখে পড়েছেন, অকথ্য গালিগালাজ এমনকি মারতে পর্যন্ত উদ্যত হয়েছেন অনেকে। অনেকের হইচই চেঁচামেচি কান্নাকাটিতে যাদের বাড়িতে সমস্যা আছে এমন অনেকে নিজের সমস্যা প্রকাশ করার সুযোগ পাচ্ছেন না। অত্যন্ত চটপটে প্রশাসনের এই নারী কর্মকর্তা রাসনা শারমিন মিথি এ কাজটি করে গেছেন পবিত্র রমজান মাসে ৪০ ডিগ্রিরও বেশি তাপমাত্রা মাথায় নিয়ে। তাকে এ কাজে সাহায্য করছেন জেলা প্রশাসকের সহকারী কমিশনার ডা. মাহমুদুল হাসান। 

জেলা প্রশাসনের একজন এডিসির নেতৃত্বে প্রতিদিন প্রশাসনের এই দুইজনসহ একঝাঁক তরুণ কর্মকর্তারা পালাক্রমে সব যাত্রীর কোয়ারেন্টাইন  নিশ্চিত করে যাচ্ছেন। তাদের সাথে আরও  আছেন নাভারণ সার্কেলের এএসপি জুয়েল ইমরান, পোর্ট থানার ওসি মামুন খান এবং স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মীরা। সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত এ কাজটি কতটা সমস্যা এবং ক্লান্তিকর তা সরাসরি না দেখলে অনুধাবন করা যাবে না।

নিরাপত্তার জন্য সার্বক্ষণিক অঙ্গীভূত আনসার সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে এবং পুলিশের বিশেষ টহল ও পাহারার ব্যবস্থাও রয়েছে। একইভাবে বেনাপোল পৌরসভার হোটেলগুলোতেও আনসার সদস্য নিয়োগ করা হয়েছে। উপজেলার বিভিন্ন বিভাগের সরকারী কর্মকর্তাগণ দায়িত্ব পালন করছেন। হোটেল ভাড়া ও নি¤œমানের খাদ্য পরিবেশনের অনিয়মের কবর পেলে সেখানেই ছুটে যাচ্ছেন এই নারী কর্মকর্তা। সমাধান না করে ফিরে আসেন না তিনি। বেনাপোলের ১৩টি আবাসিক হোটেলের মালিক ও প্রশাসনের বিভিন্ন কর্মকর্তাদের নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে অনুরোধ করা হয়েছে রুমভাড়া অর্ধেক রাখার এবং তারা তাতে সম্মতি দিয়েছেন। আগত যাত্রীদের খাবারের ব্যবস্থাও সংশ্লিষ্ট হোটেলে করা হয়েছে। যাদের আথিক সামর্থ্য কম তাদের পাঠানো হয়েছে ঝিকরগাছার গাজীর দরগাহ মাদ্রাসায়।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও সহকারি কমিশনার (ভূমি) রাসনা শারমিন মিথি বলেন, ভারতে আটকে পড়া লোকজনকে দেশে ফেরত আনার ব্যাপারে সরকার কাজ করছে। ভারতেও করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়েছে। ঝুঁকি থাকলেও তাদের নিয়ে কাজ করতে হচ্ছে। তাদেরকে প্রশাসনিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা, তাদের দেখভাল করার কারণে তাদের সঙ্গে মিশতে হচ্ছে। তাই মনে ভয় তো আছেই। করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে সর্বাধিক সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করে কাজ করছি। কারণ চাকরিতে ঢোকার পর এটা পবিত্র দায়িত্ব হিসেবে নিয়েছি। দেশের জন্য কাজ করাটাই আমার ব্রত। সত্যিই এখন আমার ভয় করে না বাইরে যেতে, ডিউটির পর বাসায় ফিরতে। তারপরও নিজেকে এই পেশায় বিলিয়ে দিতে কখনও পিছপা হব না। এই করোনা যুদ্ধে নিজের শেষটুকু দিয়ে লড়ে যেতে চাই। হয়তো জনসাধারণকে সচেতন করতে পারলেই, এ যুদ্ধে আমরা জয় হতে পারবো। তাই তিনি সকলকে নিজ ঘরে থাকতে অনুরোধ করেন। পাশাপাশি অতি প্রয়োজন ছাড়া ঘরের বাইরে বের হতে নিষেধ করেন। আর কেউ যদি বের হন, তবে নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রেখে, মাস্ক পরে বের হতে বলেন। 

প্রতিদিন করোনা বিস্তার প্রতিরোধ, ভারত থেকে আসা যাত্রীদের প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরা, হোম কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিতকরা, মোবাইল কোর্ট, বাজার মনিটরিং, শহরের মানুষদের মাঝে মাস্ক পরিয়ে দেওয়া, মানুষকে নিজ ঘরে অবস্থান নিশ্চিত করার জন্য ছুটে চলছি উপজেলার এক প্রান্ত থেকে অপর প্রান্তে। আমার নিজের খাওয়া-ঘুম বাদ দিয়ে ডিউটিতে যাই সমস্যা নেই, কিন্তু এখনকার পরিস্থিতি একদমই ভিন্ন, মানুষকে বুঝিয়ে, অনুরোধ করে, জরিমানা করেও ঘরে রাখা অনেক ক্ষেত্রেই সম্ভব হচ্ছে না।

তিনি বলেন, করোনাকালীন ভারত ফেরত যাত্রীদের সেবা দিতে রাত-দিন কাজ করেছি জাতীয় স্বার্থে। দেশকে নিরাপদ রাখতে বেনাপোল দিয়ে ১৮ জন করোনা রোগীসহ ২ হাজার ৮০২ জন ভারত ফেরত যাত্রীদের নিরাপদে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখতে পেরেছি। তবে সার্বিক কাজে সবচেয়ে বড় বাধা হয়ে পড়েছে ভিআইপিদের তদবির। বিভিন্ন ব্যক্তিকে বিভিন্ন অজুহাতে কোয়ারেন্টাইন হতে মুক্তি দেওয়ার জন্য প্রতিদিন শত শত টেলিফোন রিসিভ করে থাকেন জেলা প্রশাসন এবং জেলা পুলিশের কর্মকর্তারা। তবে এখনও পর্যন্ত মেডিকেল গ্রাউন্ডে উন্নত চিকিৎসার জন্য বড় চিকিৎসা প্রতিষ্ঠানে পাঠানো ব্যতীত কাউকেই ছাড়া হয়নি। বেনাপোল বন্দরে সব যাত্রীর পাসপোর্ট রেখে পুলিশের পাহারায় গাড়িযোগে যশোর জেলা এবং খুলনা বিভাগের অন্য জেলায় প্রতিষ্ঠিত কোয়ারেন্টাইন সেন্টারে পাঠানো হচ্ছে। 

আরকে//