বাজেটে খাতওয়ারি ব্যয় ও প্রণোদনা দ্রুত কার্যকরে প্রস্তাবনা
এম জি আর নাসির মজুমদার
প্রকাশিত : ০৬:৪২ পিএম, ২৭ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০৮:৪৪ পিএম, ২৭ মে ২০২১ বৃহস্পতিবার
নাসির মজুমদার
মহামারী করোনার ভয়াবহ আঘাতে জর্জরিত অর্থনীতি। পুরো বিশ্বজুড়েই চলছে কভিড-১৯ এর তাণ্ডব। ফলে বহির্বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও বাড়ছে দারিদ্র। বিশ্বব্যাংক আভাস দিয়েছে চলতি অর্থ বছরে জিডিপি প্রবৃদ্ধি নেমে যাবে শূন্যের কোঠায়। এরূপ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনীতির গতি প্রকৃতি কি হবে তার হিসাব নিকাশ এখন সময়ের দাবি। কৃষি ছাড়া আমাদের অর্থনীতির অন্যান্য খাতে ভীষণ স্থবিরতা বিরাজ করছে।
পোষাক শিল্পের রফতানি আয় হ্রাস পাচ্ছে। রেমিটেন্সও দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে। ভারী ও ক্ষুদ্র শিল্পগুলো লকডাউনের কবলে অনেকটাই নিশ্চল। প্রাণহীন হয়ে পড়েছে সেবা খাত। লাখো মানুষের বিচ্যুতি শহর থেকে গ্রামে। অনাড়ম্বর কাজে নিয়োজিত অধিকাংশ মানুষ হয়ে পড়েছে কর্মহীন। দারিদ্রসীমার নিচে চলে যেতে পারে কয়েক কোটি মানুষ। সুচিকিৎসা থেকে বঞ্চিত হবে অনেকেই। হবে ব্যধি ও ক্ষুদার শিকার।
এমন একটি প্রেক্ষাপটেই প্রণীত হচ্ছে আসন্ন বাজেট। আমি মনে করি এবারের বাজেট হতে হবে গতানুগতিকতার বাহিরে। ধারাবাহিকতার ছেদ ঘটিয়ে সম্পূর্ণ ভিন্ন ও নতুন আঙ্গিকে প্রণয়ন করতে হবে এবারের বাজেট। বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং মানুষের জীবন বাঁচানো ও জীবিকার পথ খুলে দেয়াই হবে বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য।
জীবন বাঁচানোর জন্য চিকিৎসা ও খাদ্যের সংস্থান জরুরি। জীবিকার জন্য প্রয়োজন কর্মসংস্থান। নিম্ন আয়ের মানুষদের সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ জরুরি। দেশের নাগরিকদের মানবিক উন্নয়নের জন্যও থাকতে হবে প্রয়োজনীয় অগ্রাধিকার। এমন প্রেক্ষাপটে বাজেটে স্বাস্থ্য, কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা, সামাজিক সুরক্ষা বেষ্টনীর সম্প্রসারণ, কর্মসংস্থান ও শিক্ষাখাতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
এ বাজেটকে সামনে রেখে ব্যবসায়ী সংগঠনের নির্বাচিত সদস্য হিসেবে আমার প্রস্তাবনা হচ্ছে –
উচ্চ হারের কর্পোরেট কর হ্রাস করে নূন্যতম দশ শতাংশ করতে হবে। স্বাস্থ্য খাতে সরকারি বিনিয়োগ বৃদ্ধির অপরিহার্যতা এখন অতীব জরুরি। পুঁজি বাজারে তালিকাভুক্ত ও অতালিকাভুক্ত কোম্পানির কর হার হ্রাস করতে হবে। করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানোর বিষয়টিও উপেক্ষিত থাকার সুযোগ নেই। চলমান উন্নয়ন ধারার গতি বাড়াতে নতুন নতুন খাতে অপ্রদর্শিত অর্থের বিনিয়োগ আবশ্যকতা এখন সময়ের দাবি।
বিনিয়োগে করমুক্ত সুবিধায় নবাগত উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি করমুক্ত সুবিধা অর্থনীতিকে আরও গতিশীল করবে। নতুন উদ্যোক্তাদের বিনিয়োগের টাকা দুই কোটি পর্যন্ত অর্থের উৎস প্রশ্নমুক্ত রাখতে হবে।
মজিব শতবর্ষে সকল তরুণদের জন্য কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও তাদের কর্মঠ হাত কাজে লাগিয়ে ’৪১ সালের মধ্যে উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে হবে। তরুণ উদ্যোক্তা নীতি প্রণয়ন ও বাস্তব রূপদানের মাধ্যমে একটি দক্ষ ও কর্মঠ যুব সমাজ তৈরীর লক্ষ্যে প্রতিটি উপজেলায় যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিতে হবে।
ক্ষুদ্র শিল্প ও তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য নূন্যতম পাঁচ বছর কর অবকাশ প্রদান করা সহ বিশেষ কর সুবিধা প্রদান করতে হবে।
ক্ষুদ্র শিল্প ও নারী উদ্যোক্তাদের সমন্বয়ে খাতভিত্তিক যৌথ প্রতিষ্ঠানগুলোকে রপ্তানিভিত্তিক বন্ডেড ওয়্যারহাউস সুবিধা প্রদান করতে হবে। নতুন উদ্যোক্তাদের ক্ষেত্রে পাঁচ বছর কর অবকাশের প্রস্তাব করছি।
পেনডেমিক কারণে অর্থনৈতিক প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় বিনিয়োগ শিল্পায়নবান্ধব স্থায়ী কর ও শুল্ক ব্যবস্থা প্রবর্তন করা অপরিহার্য। সম্পূরক শুল্ক হার হ্রাস করে বিদ্যমান শিল্প প্রতিরক্ষণ হার কমানো সমীচীন হবে না। মিথ্যা ঘোষলার মাধ্যমে পণ্য আমদানি বন্ধের জন্য নিয়মিত ভাবে মূল্যের খাতভিত্তিক সঠিক ডাটা আহরণ, সে ভিত্তিতে কর আরোপ করা ও সব বন্দরে স্ক্যানার এবং স্বয়ংক্রিয় পরিমাপ যন্ত্র স্থাপন খুবই জরুরি।
ভোক্তা ও দেশের পয়তাল্লিশ শতাংশ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাতের স্বার্থ ও সামর্থ্য অনুযায়ী সকল পণ্য ও সেবা খাতের জন্য প্রযোজ্য ভোক্তাবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব ও রাজস্ববান্ধব সুনির্দিষ্ট স্তর ভিত্তিক ভ্যাট হার জাতীয় স্বার্থে অপরিহার্য।
আগামী জাতীয় বাজেটে কভিড-১৯ এর ধাক্কা মোকাবিলায় স্বাস্থ্য খাতে ব্যয় বাড়ানো এবং শিক্ষা ও স্থানীয় শিল্পে নজর আরোপের উপর জোর দিতে হবে। শুধু বরাদ্দ বাড়ানো নয়, ব্যয় যের কার্যকর হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। বাজেটে শুধু তৈরি পোষাক শিল্প বা গতানুগতিক রপ্তানি খাত নয়, অন্যান্য পণ্য উৎপাদন ও রপ্তানি, স্থানীয় বাজার ও সেবা খাতে বিশেষ নজর দিতে হবে।
করোনার প্রভাবে এখনও ব্যবসা বাণিজ্যে মন্দাভাব চলছে। এ সময়ে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, বিনিয়োগ বৃদ্ধি ও ব্যবসাবান্ধব বাজেট প্রয়োজন। করোনার সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছেন ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক ব্যবসায়ীগন। তাঁদের জন্য বাজেটে প্রণোদনা প্যাকেজের আওতায় আলাদা বরাদ্দ রাখা উচিত। তাহলে অর্থনীতি পুনরোদ্ধারের গতি বাড়বে। ক্ষুদ্র, মাঝারি ও প্রান্তিক উদ্যোক্তারা সহজে ব্যাংকের অর্থায়ন পান না। তাই তাঁদের জন্য ব্যাংকগুলোকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিতে হবে।
করোনা পরিস্থিতি ধেকে অর্থনীতি দ্রুত উত্তরণের জন্য ক্ষুদ্র, কুটির ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পে আর্থিক পণোদনা তাদের হাতে দ্রুত ও কার্যকরভাবে পৌঁছে দেওয়া একান্ত প্রয়োজন। গত অর্থ বছরে স্থানীয় ক্ষুদ্র ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পের জন্য দেয়া প্রণোদনার অর্থ পেতে অনেক সময় লেগেছে। অতি ক্ষুদ্র সময়ের মধ্যে অধিকতর কর্ম সংস্থান নিশ্চিত করতে ও গত বছর হারানো কর্ম ফিরিয়ে আনতে স্থানীয় ক্ষুদ্র, কুটির ও অতি ক্ষুদ্র শিল্পে দ্রুত প্রাণ সঞ্চারের বিকল্প নেই।
সবশেষে বলব, করোনার প্রভাব চলে গেলে আমাদের চিরায়ত বাজার পুনরুদ্ধার করতে হবে। নতুন বাজার খুঁজতে হবে। তাছাড়া পোশাক তৈরিতে আমাদের সক্ষমতা আন্তর্জাতিক বিশ্বে তুলে ধরতে হবে।
লেখক: পরিচালক, এফবিসিসিআই (২০২১-২০২৩)
এসি