ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

মৃত মানুষের বয়স!

সমর ইসলাম

প্রকাশিত : ০৯:০৮ এএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার | আপডেট: ০২:২৯ পিএম, ২৯ মে ২০২১ শনিবার

কথাটা শুনে ক্ষেপে গেলেন পাশে বসা ভদ্রলোক। গাঁজাখোরি গল্প করার আর জায়গা পেলেন না! মৃত মানুষ গ্রামে বাস করে। তার বয়স তিরাশি বছর? এ-ও সম্ভব? চটলেন কেনো ভাই? আগে তো সবটা শুনবেন। আর কী-ই বা সম্ভব নয় আমাদের দেশে বলুন? মাছ পচে না, ফল পচে না; তরিতরকারি শাকসবজিও দেখবেন দিনের পর দিন কেমন টাকটা। কী আজব দেশ আমাদের! তাহলে মরা মানুষ গ্রামে বাস করলে সমস্যা কোথায়?

: আচ্ছা, বলেন শুনি, আপনার মরা মানুষের গ্রামে বাস করার গল্প শুনি।
: গল্প না ভাই। সত্যি কথা। শুনুন তাহলে-

বরিশালের মুলাদী উপজেলার বাহাদুরপুর গ্রাম। সে গ্রামে বাস করেন মৃত হাচেন ভানু। বয়স তার তিরাশি বছর। হাচেন ভানুর স্বামী মারা গেছেন প্রায় ত্রিশ বছর আগে। পাঁচ মেয়ে ও এক ছেলে তাঁর। সবারই বিয়ে থা হয়ে গেছে অনেক আগেই। একমাত্র কৃষক ছেলের দিন কাটে অভাব-অনটনে। তাই বৃদ্ধ মাকে দেখভাল করতে পারে না সে। পাড়া-প্রতিবেশীরাও তা জানেন, দেখেন। 

২০০৫ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান-মেম্বাররা হাচেন ভানুর কষ্ট দেখে বয়স্ক ভাতার কার্ড করে দেন। ওষুধ-পথ্য কেনাসহ এই দিয়ে মোটামুটি ভালোই কাটছিল বৃদ্ধার দিন। হঠাৎ করে তার বয়স্ক ভাতা আসা বন্ধ হয়ে যায়। অন্যদেরটা আসে, তারটা আসে না। 

উপজেলা সমাজসেবা অফিস তার কাছ থেকে ভাতা প্রদানের বই জমা নিয়ে নেয়। জানায়, নির্বাচন ওয়েবসাইটে তার কোনও তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। তাই তার বয়স্ক ভাতা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। সমাজসেবা অফিস তাকে উপজেলা নির্বাচন অফিসে যোগাযোগ করে দেখতে বলেন।

তিরাশি বছরের বৃদ্ধা হাচেন ভানু ছুটে যান উপজেলা নির্বাচন অফিসে। গিয়ে জানতে পারেন, তিনি মারা গেছেন। হাচেন ভানুর পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যেতে থাকে। বলে কি অফিসার! আমি মারা গেছি! তাহলে তার সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে কে? নিজের শরীরে চিমটি কাটেন। না, তিনি জীবিত এবং জেগেই আছেন। তাহলে! বিস্মিত দৃষ্টি অফিসারের দিকে মৃত হাচেন ভানুর।

অফিসার বলেন, ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করার সময় আপনাকে মৃত দেখানো হয়েছে।
: কিন্তু আমি তো বেঁচে আছি বাবা। এই যে দেখেন, আমি আপনার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। সরকারি কাগজে মৃত হাচেন ভানু নিজেকে জীবিত প্রমাণের চেষ্টা করেন।

অফিসারও বিস্মিত। সে তো দেখতেই পাচ্ছি। আপনি এক কাজ করেন। কিছু ডকুমেন্টসহ আবেদন করেন। দেখি কী করা যায়!

বৃদ্ধা ছুটে যান চেয়ারম্যানের কাছে। চেয়ারম্যান তাকে জীবিত প্রমাণ করে প্রত্যয়ন করে দেন। সেই প্রত্যয়নপত্রসহ নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে নির্বাচন অফিসে আবেদন করেন হাচেন ভানু। আবেদনের কয়েক মাস পরও নির্বাচন অফিস কোনও ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় তিনি নিজেকে জীবিত প্রমাণ করতে পারেন নি। যথারীতি বন্ধ বয়স্ক ভাতাও। মনে মনে ভাবেন, এটা কেমন মরণ হইলো আমার! খেতেও হয়, পরতেও হয়; ওষুধও কিনতে হয়। ভালো করে মরতে পারলে খাওয়া-পরা বা ওষুধের জন্য ভাতার দরকার হতো না।

কি করে জানি বিষয়টি স্থানীয় সাংবাদিকদের কানে যায়। সেটা কাগজে ছাপা হয়। সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে উপজেলা নির্বাচন অফিসার শওকত আলী জানান, ২০১৯ সালে ভোটার তালিকা হালনাগাদের সময় তথ্য সংগ্রহকারী জীবিত হাচেন ভানুকে হয়তো মৃত উল্লেখ করেছেন। এ কারণে হালনাগাদ তালিকায় হাচেন ভানুকে মৃত উল্লেখ করা হয়েছে। বিষয়টি দুঃখজনক ও অপ্রত্যাশিত। তিনি আবেদন করেছেন। দ্রুত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। (সূত্র- যুগান্তর; ১১ এপ্রিল ২০২১)

প্রায় দেড় মাস পর একুশে টেলিভিশনের বরিশাল প্রতিনিধি সুখেন্দু এদবরের মাধ্যমে খবর নিয়ে জানতে পারলাম, বৃদ্ধা হাচেন ভানু কাগজেপত্রেও এখন জীবিত হয়েছেন। শিগগিরই পেতে পারেন বয়স্ক ভাতাও। নইলে কোনও একদিন হয়তো হাচেন ভানুকে মরিয়া প্রমাণ করিতে হইতো যে, তিনি জীবিত ছিলেন।

এনএস/