মাটির তৈরি তৈজসপত্র হারিয়ে যাচ্ছে
আনোয়ার কাজল
প্রকাশিত : ০৪:৩০ পিএম, ২ জুন ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৪:৩২ পিএম, ২ জুন ২০২১ বুধবার
মাটির তৈরি জিনিসপত্র বা মৃৎশিল্প আমাদের আবহমান গ্রাম বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য। এক সময় বাংলাদেশে মাটির তৈরি জিনিসপত্রের ব্যাপক ব্যবহার ও চাহিদা ছিল। আধুনিকতার ছোঁয়ায় কালের বিবর্তনে মাটির তৈরি অনেক নিপুণ হাতের তৈরি তৈজসপত্র হারিয়ে যেতে বসেছে।
এক সময় মাটির জিনিসপত্র তৈরিতে কুমার পাড়ার মৃৎশিল্পীরা সারাক্ষণ ব্যস্ত থাকতো। নিত্যপ্রয়োজনীয় হাঁড়ি-পাতিল, ডাবর-মটকি থেকে শুরু করে মাটির ব্যাংক, শো-পিস, গহনা, কলস, ফুলের টব, ফুলদানি, ঢাকনা, পিঠা তৈরির সাজ এবং নানা রকম খেলনা তৈরি করতেন মৃৎশিল্পীরা। কিন্তু আনুধিক যুগে কাঁচ, সিলভার, এ্যালুমিনিয়াম, প্লাস্টিক অথবা মেলামাইনের ভীড়ে মাটির তৈরি জিনিসপত্র বিলীন হতে চলছে।
আধুনিক যন্ত্রপাতিতে তৈরি নানা রঙ ও বর্ণের দৈনন্দিন ব্যবহৃত জিনিসপত্রের ভীড়ে সবুজ-শ্যামল ফসলের মেঠো পথের গ্রামীণ বাংলা থেকে মৃৎশিল্প আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে।
মাটির ব্যাংক
‘মাটির ব্যাংক’ নামটির সাথে কম বেশি সবাই পরিচিত। ছোটবেলায় মাটির ব্যাংকে টাকা জমানোর স্মৃতি কম বেশি সবারই আছে। ধাতব মুদ্রার প্রচলন হওয়ার পর থেকেই মানুষ এ ব্যাংক ব্যবহার করছে। সঞ্চয়ী মনোবৃত্তি এবং শখের বসে এখনও মানুষ এ ব্যাংক ব্যবহার করে। এতে আগে শুধু ধাতব মুদ্রা রাখা হতো। বর্তমানে কেউ কেউ এতে কাগজের টাকাও জমায়।
স্কুলের টিফিনের টাকা, ঈদ, পূজার সেলামি, বাবার পকেটের খুচরা টাকা, গৃহিণীরা হাস-মুরগী বিক্রি করে, হাতে তৈরি সখের জিনিসপত্র বিক্রির টাকা, বছর শেষে নতুন ক্লাসে উঠার সময় পুরাতন বই বিক্রি করে কিংবা বাবা-মা বা বড়দের কাছ থেকে পাওয়া টাকা জমা হতো মাটির ব্যাংকে। মাটির ব্যাংক নামটির সাথে জড়িয়ে আছে অনেক মিষ্টি মধুর স্মৃতিও।
বিভিন্ন আকৃতির মাটির ব্যাংক
আগে শহর ও গ্রামে বৈশাখী ও নবান্নের মেলাসহ বিভিন্ন মেলা বসতো। সেসব মেলায় কুমারের হাতে তৈরি বিচিত্র ধরনের মাটির জিনিস পাওয়া যেত। সেই মাটির জিনিসের মধ্যে মাটির ব্যাংক ছিল উল্লেখযোগ্য। নানা আকৃতির সেই মাটির ব্যাংক নজর কাটতো সবারই। অনেক কিছু কেনার মধ্যে এ ব্যাংকটিও কেনা হতো। কিছুই না কিনলেও একটি মাটির ব্যাংক কিনতে যেন ভুল হত না কারোরই। অল্প বয়স্ক ছেলেমেয়েরা বছরের বিশেষ দিন যেমন- ঈদ, পূজা ও মেলায় খরচ করতো সেই জমানো টাকা। কিনতো নতুন কাপড়-চোপড় ও নানা সখের বর্ণিল সব জিনিসপত্র।
সেই ব্যাংকগুলো বানানো হতো গোল আকৃতির, হাতি, ঘোড়া, মাছ ও নানা ধরণের ফলের আকৃতির। প্রতিটি মেলায় মাটির তৈরি বিভিন্ন রকম তৈজসপত্র, ফুলদানির পাশাপাশি মাটির ব্যাংকের বিশাল স্তূপ দেখা যেত। কিন্তু এখন মেলায় আগের মত সেই ধরনের মাটির ব্যাংক দেখা যায় না।
স্মৃতিতে মাটির ব্যাংক
প্রবীণদের সাথে আলাপ করলে ছোটবেলার স্মৃতিচারণ করে বলেন- ছোটবেলায় আমাদের মেলা হতো, মেলায় গিয়ে প্রথমেই মাটির ব্যাংক কিনতাম। প্রতিবছর শীতের সময় গ্রামে আমতলা বা বটতলার হাটে বা গোদারাঘাটের কাছে বসত চৈতালী মেলা, বৈশাখী মেলা, বিজয় মেলা, কারবালা মেলা, ঘোড় দৌড়সহ নানা উৎসবসহ। এসব মেলা ও উৎসবে মাটির নানা খেলনার উপকরণ পাওয়া যেতে। মেলা থেকে অন্যকিছুর সাথে মাটির ব্যাংক অবশ্যই কেনা হতো।
মাটির কলস
মাটির কলস আমাদের দেশে মাটির তৈজসপত্রের বহুল ব্যবহার ছিল। গ্রাম কিংবা শহরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই ব্যবহার করা হতো মাটির থালা, গ্লাস, সানকি কলস, পানির জগ ও মগ, মাটির হাঁড়ি ইত্যাদি। কিন্তু ঐতিহ্যবাহী এসব পাত্রের ব্যবহার বর্তমানে একেবারে নেই বললেই চলে। মাটির পাত্রে যে রান্না ও পানি রাখা হতো এর রয়েছে বেশ কিছু উপকারিতা। মাটির কলস শুধু দেখতেই সুন্দর নয়, এর কিছু গুণও আছে।
মাটির পাত্রের প্রাকৃতিকভাবেই পানি ঠাণ্ডা রাখার গুণ আছে। আবহাওয়া ও জলবায়ুর সঙ্গে এটি পানির তাপমাত্রাকে সহজেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। মাটির কলসিতে পানি ঠাণ্ডা হওয়ার কারণ মূলত বাষ্পীভবন। যখন কোন তরল পদার্থ বাষ্পীভূত হয় তখন তার উষ্ণতা হ্রাস পায়। তাপ হারানোর কারণে তরল পদার্থের উষ্ণতা কমে যায়। কলসি বানানোর সময় মাটির সঙ্গে খানিকটা বালি মেশানো হয় এবং এর গায়ে অসংখ্য ছোট ছোট ছিদ্র থাকে। সেখান থেকেই মূলত বাষ্পীভূত হয়ে পানি ঠাণ্ডা থাকে।
মাটির পাত্রের পানি ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ বজায় রাখতে সাহায্য করে। ফলে এই পানি পান করলে সানস্ট্রোকও আটকানো যায়। এছাড়া মাটির পাত্রের পানি টেস্টরন ব্যালেন্স করার ক্ষমতা রয়েছে। যা শরীরের মেটাবলিজম বাড়াতে সাহায্য করে। আমাদের লোকায়েত ঐতিহ্যের মাটির কলস হারিয়ে যাচ্ছে। হয়তো একদিন এর স্থান হবে যাদুঘরে।
মাটির চুলা
চুলার আবিষ্কার মানবজাতির গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারগুলোর অন্যতম। প্রাচীন মানুষরা কাঠ ও খড়কুটোতে আগুন জ্বালিয়ে খাবার পুড়িয়ে খেত। সে ঐতিহাসিক গল্প আমরা জানি, তার থেকে মানুষ এক ধাপ এগিয়ে যায় চুলার আবিষ্কারের পর। মাটির তৈরি চুলার কথা মনে করলেই মনে পড়ে যায় দাদি-নানি ও মায়ের হাতের রান্নার কথা। তাদের সেই রান্নার স্বাদ, যেন জিভে পানি এনে দেয়। বর্তমানে কমে আসছে এই মাটির চুলার ব্যবহার।
শহরাঞ্চলে এ চুলার দেখা মেলে না বললেই চলে। তবে গ্রামাঞ্চলে এখনও বেশিরভাগ বাসায় রান্নার কাজে মাটির চুলা ব্যবহার করা হয়। গ্রামবাংলার অনেক পরিবার হাঁড়ি-পাতিল ধুতে ছাই ব্যবহার করেন। কাঠ, বাঁশ, খড়কুটো, পাটকাঠি, শুকনো পাতা—এসবই মাটির চুলার জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এগুলো পুড়ে ছাই হয় ত পরিষ্কারের কাজে ব্যবহার করা হয়।
মাটির তৈরি তৈজসপত্র টিকে থাকুক শতাব্দীর পর শতাব্দী। টিকে থাকুক মাটির চুলার পাশে বসে গ্রাম বাংলার স্মৃতি বিজড়িত মা-চাচীদের সুখ দুঃখের গল্প।
এএইচ/