ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

চাঁপাইনবাবগঞ্জে চাঙ্গা অনলাইন আমবাজার

ফারুক আহমেদ চৌধুরী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ

প্রকাশিত : ০৮:৪৭ পিএম, ৪ জুন ২০২১ শুক্রবার

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনেক তরুণ উদ্যোক্তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ব্যবহার করে অনলাইনে আম বিক্রি করছেন। এতে একদিকে যেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিকে চাষিরা পাচ্ছেন আমের ন্যায্যমূল্য। আর ভোক্তারা অল্প সময়ের মধ্যে পাচ্ছেন চাহিদা অনুযায়ী ক্ষতিকর কেমিকেলমুক্ত সুস্বাদু ও পরিচ্ছন্ন আম। গ্রাম-গঞ্জে অসংখ্য অনলাইনভিত্তিক তরুণ উদ্যোক্তা গড়ে ওঠায় আড়তদারদের কাছে জিম্মিদশা থেকে মুক্ত আমচাষিরা। চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম নিয়ে জেলা প্রশাসনও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার চালাচ্ছে। এছাড়াও আম সংশ্লিষ্ট পরিবহন ও আম ব্যবসায়ীদের লকডাউনের আওতামুক্ত রেখে আম ব্যবসায় সর্বাত্মক সহযোগিতা করছে জেলা প্রশাসন।

তথ্যমতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রায় ১৫০০ কোটি টাকার আমের উৎপাদন হয়। করোনার প্রাদুর্ভাব ও চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনের কারণে এ বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আম অনলাইন মার্কেটে বেচাকেনা হবে বলে মনে করছেন উদ্যোক্তরা।

করোনা ভাইরাসের কারণে দেশব্যাপি সরকারি বিধি-নিষেধ চলমান থাকায় মানুষ ঘর থেকে বের হচ্ছেন কম। আবার আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে লকডাউনের কারণে অন্য জেলার মানুষ চাইলেও আসতে পারছেন না। তবে মধুমাস জ্যৈষ্ঠে এরই মধ্যে বাজারে উঠেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জের সুস্বাদু আম। করোনা দুর্যোগে মানুষের হাতে হাতে আম পৌঁছে দিতে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে অনলাইন প্লাটফর্মে আমের ব্যবসা।

করোনার সংক্রোমণ রোধে লকডাউনের কারণে এবার আমের রাজ্যে সেই চিরচেনা কোলাহল নেই। আমের বাজারে নেই ক্রেতাদের ভিড়ও। প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের কড়াকড়ির জন্য গ্রামের আমচাষিরা ঝামেলা এড়াতে আম নিয়ে বাজারে যেতে চাইছেন না। আবার  অনেকেই করোনার ঝুঁকি এড়াতে বাগান থেকেই ব্যবসায়ীদের কাছে আম বিক্রি করে দিচ্ছেন।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ এক হাজারের বেশি তরুণ উদ্যোক্তা আম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত। অনলাইনে অর্ডার নিয়ে তারা বাগান থেকে আম পেড়ে সেখানেই প্যাকিং করে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে পৌঁছে দিচ্ছেন ভোক্তার কাছে। হাটে-বাজারে আম বেচাকেনার ফলে কয়েক হাত ঘুরে সেই আম পৌঁছাতো ভোক্তাদের কাছে। অনলাইনে কেনাবেচার জন্য এখন তা অনেকটাই কমে গেছে। এতদিন রাজধানী ঢাকার ব্যবসায়ীরা অন্য জেলার আম কিনে ‘চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম’ বলে বিক্রি করতেন। এতে প্রতারিত হতেন ভোক্তারা।

গত তিন বছর থেকে অনলাইনে আমের ব্যবসা করেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার আতাউল্লাহ খান। তিনি বলেন, ফেসবুকে শখের বসে অনলাইনে আম বেচাকেনার স্ট্যাটাস দিয়ে ফেলি। তারপর থেকেই আমার ফেসবুক ফলোয়ার ও বন্ধুরা আমাকে ম্যাসেঞ্জারে যোগাযোগ করে আমের অর্ডার দেন।  ব্যাপক সাড়াও পাই। তখন আমি বাগান ঘুরে ঘুরে দেখেশুনে গাছের আম কিনে নিই। গাছ থেকে আম কিনে সেখানেই প্যাকিং করে কুরিয়ারের মাধ্যমে পাঠাই। আবার আমের মূল্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে নিয়ে থাকি। ঢাকা, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, নোয়াখালী, সিলেটসহ সারা দেশেই আমার অসংখ্য ক্রেতা তৈরি হয়েছে।

চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনলাইন আম ব্যবসায়ী মেহেদী হাসান বলেন, আমি পাঁচ বছর ধরে অনলাইনে আম ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত আছি। কামাল উদ্দীন জাফোরী নামে আরেকজনকে সঙ্গে নিয়ে ‘জাফোরী আম ভাণ্ডার’ নামে একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছি। আমি অনলাইন আম ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘অনলাইন ম্যাংগো ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ’র সদস্য।

তিনি বলেন, আমরা আমের অর্ডার নিয়ে সরাসরি বাগানিদের কাছে যায়। বাগান থেকে সরাসরি আম পাড়া হয়। তারপর প্যাকেট করে কুরিয়ারের মাধ্যমে পৌঁছে দেয়া হয় ভোক্তাদের কাছে। এ বছর আমাদের ৫০০ মণ আম বিক্রির লক্ষ্যমাত্র রয়েছে।

মেহেদী হাসান আরও বলেন, স্থানীয় চাষীদের কাছ থেকে আম কিনে থাকি। ফলে চাষীরাও লাভবান হন। কারণ চাষীদের হাটে আম নিয়ে গেলে খাজনা দিতে হয়। রয়েছে পরিবহন খরচও। আবার দামও কম পান। আড়তদাররা আবার সেই আম বিক্রি করেন আম ব্যবসায়ীদের কাছে। সেই আম কয়েক হাত ঘুরে যেত ভোক্তার কাছে। ফলে বাধ্য হয়ে ব্যবসায়ীদের আমে ফরমালিন দিতে হয়। অনলাইনে বিক্রির ফলে সরাসরি বাগান থেকে আম প্যাকেট হয়ে ভোক্তার কাছে পৌঁছে যায়। ফলে টাটকা ক্ষতিকর কেমিকেলমুক্ত আম পেয়ে যান ভোক্তারা।

এ প্রসঙ্গে অনলাইন ম্যাংগো ট্রেডার্স অ্যাসোসিয়েসন অব বাংলাদেশ-এর আহ্বায়ক মো. ইসমাইল খান শামীম বলেন, চাঁপাইনবাবগঞ্জের অনলাইনভিত্তিক তরুণ উদ্যোক্তাদের পেশাদার ব্যবসায়ী তৈরির উদ্দেশে বাংলাদেশের ৬০০ জন সদস্য নিয়ে সংগঠনটি তৈরি করা হয়। এতে যেমন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে অন্যদিকে চাষিরা পাচ্ছেন আমের ন্যায্যমূল্য। একইসঙ্গে ভোক্তারা অল্প সময়ের মধ্যে পাচ্ছেন চাহিদা অনুযায়ী ক্ষতিকর কেমিকেলমুক্ত সুস্বাদু ও পরিচ্ছন্ন আম। তবে প্রশিক্ষণ ছাড়াই অনেকে অনলাইন আম ব্যবসায় আসছেন। যারা পণ্যের গুণগত মান নিয়ন্ত্রণ, প্যাকিং ও সরবরাহের সঠিক নিয়ম জানেন না। এটা অনলাইন প্লাটফর্মের জন্য ঝুঁকি।

শামীম খান আরও বলেন, অনলাইন উদ্যোক্তাদের পণ্য সরবরাহের জন্য সরকারি কোন পরিবহন ব্যবস্থা নেই। ফলে কুরিয়ার সার্ভিসগুলো অতিরিক্ত পরিবহন চার্জ নিচ্ছে। সরকারি ডাক বিভাগের মাধ্যমে অনলাইন উদ্যোক্তাদের পণ্য সরবরাহের ব্যবস্থা নিলে উদ্যোক্তা ও ভোক্তা উভয়ই উপকৃত হবে। করোনা মহামারির কারণে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এ বছর প্রায় ৫০০ কোটি টাকার আম অনলাইন মার্কেটে বেচাকেনা হবে বলে তিনি আশাবাদি।

আরকে//