একুশ শতকের বড় চ্যালেঞ্জ- মানবজাতি ও জীববৈচিত্র্য রক্ষা
রিয়াদুল হাসান নিপু
প্রকাশিত : ০৯:৫৯ এএম, ৫ জুন ২০২১ শনিবার | আপডেট: ১০:০২ এএম, ৫ জুন ২০২১ শনিবার
আজ ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। সারা পৃথিবীতে পরিবেশ বিষয়ক নানা সচেতনতার জন্য যে কয়টি দিবস রয়েছে তার মধ্যে এটিই সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। ১৯৭৪ সাল থেকে পৃথিবীব্যাপী এই দিবসটি ব্যাপকভাবে পালিত হয়ে আসছে।
এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য বিষয় হলো- Ecosystem Restoration বা বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার। অর্থাৎ দীর্ঘদিন ধরে নানা পরিবেশগত বিপর্যয় বা দূষণের কারণে বাস্তুতন্ত্রের যে ক্ষতি হয়েছে তা পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে আনা। আর এবারের স্বাগতিক দেশ হলো পাকিস্তান।
ইতোমধ্যে ২০২১-২০৩০ পর্যন্ত সময়কালকে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারের দশক (UN decade for ecosystem restoration) হিসেবে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘ। এমন ঘোষণার আরেকটি কারণ হচ্ছে- ২০৩০ সালের মধ্যে জাতিসংঘ ঘোষিত এসডিজি (SDG) বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করার কথা।
জৈব ও অজৈব উপাদান, উদ্ভিদ, প্রাণী, অনুজীব এবং এর পারস্পরিক সম্পর্ক নিয়ে বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম গঠিত। যে কোনও এক বা একাধিক উপাদানের অসামঞ্জস্যতা সমগ্র বাস্তুতন্ত্রে বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে।
বাস্তুতন্ত্র বা ইকোসিস্টেম সমূহ সকল জীবনের টিকে থাকার জন্য সহায়ক হিসেবে কাজ করে। ইকোসিস্টেম যত সমৃদ্ধ হবে পৃথিবী ও মানুষ ততো সমৃদ্ধ হবে।
সাধারণভাবে ইকোসিস্টেম দুই প্রকার। অর্থাৎ স্থলজ (Terrestrial) এবং জলজ (aquatic) ইকোসিস্টেম। জীবন ধারণের অপরিহার্য উপাদান বায়ু, পানি ও খাদ্য সবই আসে প্রকৃতি ও পরিবেশ থেকে। আসলে মানুষ, প্রকৃতি ও জীব জগত পারস্পরিক সম্পর্কযুক্ত।
বিগত শতাব্দী ও সাম্প্রতিক সময়ে মানুষের নানা কর্মকাণ্ডের জন্য ভারসাম্য হারিয়েছে প্রকৃতি ও পরিবেশ। বর্তমান কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিককেও পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য তথা বাস্তুতন্ত্রের উপর মানুষের আগ্রাসী আচরণের ফলাফল বলেই ধারণা করা হয়। এমন ভয়াবহ পরিস্থিতি যাতে না আসে সেজন্যেই বাস্তুতন্ত্রের গুণাগুণ ফিরিয়ে আনা প্রয়োজন।
বিগত কয়েক দশকে আশঙ্কাজনকভাবে হ্রাস পেয়েছে জীববৈচিত্র্য। যা বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান। বহু প্রাণী পৃথিবীর বুক থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এভাবে চললে আগামী দশ বছরের মধ্যে আমাদের চেনা প্রাণীদের ২৫% বিলুপ্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
স্থলজ ইকোসিস্টেমের জীববৈচিত্র্যের ৮০% এর উৎসই হলো বনভূমি। তাই বনভূমি সংরক্ষণ ও বৃক্ষরোপণের কোনও বিকল্প নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাই এক কোটি গাছ লাগানোর জন্য নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে আহ্বান জানিয়েছেন। পাশাপাশি মুজিববর্ষ উপলক্ষে ব্যাপক বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি চলছে। কিন্তু এর মধ্যেও থেমে নেই বনখেকো ও বনদস্যুদের কার্যক্রম।
পরিবেশ বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থা গ্লোবাল ফরেস্ট ওয়াচ থেকে প্রকাশিত বিশ্বের বনভূমি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০০১ থেকে ২০১৮ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ৩ লাখ ৭৮ হাজার একর বনভূমি উজাড় হয়েছে, যা দেশের মোট বনভূমির প্রায় ৮ শতাংশ। বনভূমির বিনাশ এবং একে অন্যান্য কাজে ব্যবহার করা বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতেই জীববৈচিত্র্য হ্রাস ও স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের গুণাগুণ বিনষ্টের অন্যতম কারণ।
শুধু তাই নয়, সংরক্ষিত বনকে মৌলভীবাজার পৌরসভা কর্তৃক ময়লার ভাগাড় হিসেবে ব্যবহার করার মতো ন্যাক্কারজনক ঘটনাও ঘটেছে (দৈনিক দেশ রুপান্তর, ৯ এপ্রিল ২০২১)। এসব কর্মকাণ্ড অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। অতি সম্প্রতি সোহরাওয়ার্দি উদ্যানের গাছ কাটার ঘটনাও খুবই দুর্ভাগ্যজনক।
গত বছরের ২৩ জুলাই ইত্তেফাকে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, টাঙ্গাইলের মধুপুরের বনে ভূমি দস্যুদের নেতৃত্ত্বে ১০ হাজারের ওপর গাছের চারা কেটে ও কুপিয়ে নষ্ট করা হয়। শুধু তাই নয়, বনবিভাগের কর্মীদের মারধোর করারও অভিযোগ আছে।
সাম্প্রতিক এক খবরে দেখা যায় যে, দেশের পৌনে তিন লাখ একর বনভূমি অবৈধ দখলদারদের নিয়ন্ত্রণে। শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীতেই বনভূমি ধ্বংস একটি বড় সমস্যা। পৃথিবীতে প্রতি ৩ সেকেন্ডে একটি ফুটবল মাঠের সমান বনভূমি মানুষ ধ্বংস করছে (সূত্র: ইউএনইপি)
স্থলজ বাস্তুতন্ত্রের অন্যতম প্রধান উপাদান হলো- মাটি। কৃষিতে রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের ব্যাপক ব্যবহার, বনভূমি উজাড় এবং কারাখানার বর্জ্য মাটির গুণাগুণকে নষ্ট করেছে বহুলাংশে। ফলে খাদ্যচক্রে ঢুকে যাচ্ছে ক্ষতিকারক ভারি ধাতুসহ নানা বিষাক্ত পদার্থ। সারা পৃথিবীর প্রায় ৮০% প্রাণীই জীবনচক্রের কোনও না কোনও পর্যায় স্থলজ পরিবেশে অতিবাহিত করে। তাই মাটির দূষণ এবং ক্ষয়রোধ করা খাদ্য নিরাপত্তা ও সমগ্র জীব জগতের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
আমরা অনেকেই হয়ত জানিনা যে, ভূমির ওপর প্রাকৃতিকভাবে এক ইঞ্চি পরিমাণ মৃত্তিকা গঠিত হতে ৫শ থেকে এক হাজার বছর পর্যন্ত সময় লেগে যায়। অথচ নানা কারণে ভূমির উপরিভাগের মাটি যা চাষাবাদ ও বৃক্ষ জন্মাবার মাধ্যম, তা নষ্ট হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে জলবায়ু পরিবর্তন এর ভয়াবহ প্রভাবে সিডর, আইলা, ফনি এবং সর্বশেষ ইয়াস ছাড়াও একাধিক সাইক্লোন, ঘুর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাস এবং ফারাক্কা বাধের কারণে আমাদের উপকূলীয় জেলাগুলোতে লবনাক্ততা ব্যাপকভাবে মাটির গুণাগুণ তথা বাস্ততন্ত্রের ভারসাম্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে।
আসলে উন্নয়ন আর আগ্রাসী শিল্পায়নের থাবায় মানুষ ভুলে গিয়েছিল যে, সে প্রকৃতিরই অংশ। যার চূড়ান্ত পরিণতি কোভিড-১৯ প্যান্ডেমিক আর একের পর এক পরিবেশ বিপর্যয়। জাতিসংঘের মতে, পৃথিবীর প্রায় ৩৪০ কোটি মানুষ কেবল পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে স্বাভাবিক জীবন অর্থাৎ সুপেয় পানি, বিষমুক্ত খাবার, নির্মল বায়ু ইত্যাদি থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কাজেই প্রকৃতির কাছে ফিরে যেতেই হবে।
জাতিসংঘের মতে, বাস্ততন্ত্রের গুণাগুণ ফিরিয়ে আনার জন্য প্রতি এক ডলার খরচের বিপরীতে অন্তত ৯ ডলার অর্থাৎ ৯ গুণ পর্যন্ত অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়া যায়। কিন্ত এর পরেও সারা পৃথিবীতেই এ ধরণের কাজে ব্যয়ীত অর্থের পরিমাণ খুবই সীমিত।
যে কারণে জাতিসংঘ ২০২১ থেকে ২০৩০ পর্যন্ত সময়কে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশক ঘোষণা করেছে। যা গোটা পৃথিবীর মানুষকে আরও একবার পরিবেশ নিয়ে কাজ করার জন্য একটি ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। এই কাজে বিশ্বপরিবেশ সংস্থা (UNEP) এবং বিশ্ব কৃষি সংস্থা (FAO) মূল সমন্বয়কারী হিসেবে কাজ করবে।
সম্প্রতি ২৭ মে, জাতিসংঘের UNEP, World Economic Forum এবং The economics of land Degradation কর্তৃক যৌথভাবে প্রকাশিত State of finance for Nature রিপোর্ট অনুযায়ী জলবায়ু পরিবর্তন, জীব বৈচিত্র্য রক্ষা এবং ভূমিক্ষয় রোধের মাধ্যমে পৃথিবীর সুরক্ষার জন্য ২০৫০ সাল নাগাদ মোট ৮.১ ট্রিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে।
ভিত্তি বছর ২০২০ অনুযায়ী বর্তমানে পরিবেশ সুরক্ষায় বৈশ্বিক বিনিয়োগ ১৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। যা ২০৩০ সাল নাগাদ কমপক্ষে তিনগুণ এবং ২০৫০ সাল নাগাদ প্রতি বছর ৫৩৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করার কথা বলা হয়েছে। জাতিসংঘের বিজ্ঞানীদের মতে, প্রিয় পৃথিবীকে চূড়ান্ত পরিবেশ বিপর্যয় থেকে বাঁচানোর জন্য এটাই সর্বশেষ প্রচেষ্টা।
এবারের বিশ্ব পরিবেশ দিবস (৫ জুন, ২০২১) থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধার দশকের কার্যক্রম শুরু হবে। UNEP-এর মতে এইকাজে কেবল সরকার বা এনজিও নয়, অবশ্যই তরুণ প্রজন্ম অর্থাৎ স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী, নারী এবং আদিবাসীসহ অবশ্যই স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও এটি খুবই জরুরী। কেবল নামকাওয়াস্তে সভা-সেমিনার আয়োজন করলে হবে না। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ে পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তনকে একটি আলাদা বিষয় হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। সেই সাথে প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়ে অন্ততপক্ষে একটি কোর্স হলেও থাকা উচিত।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী, পরিবেশ সুরক্ষার দায়িত্ব স্বয়ং রাষ্ট্রের। বাংলাদেশের সংবিধান এর ১৮ক এর অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, "রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীব-বৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্যপ্রাণির সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন।" যা রাষ্ট্রের পরিবেশ বান্ধব অবস্থান হিসেবেই বিবেচনা করা উচিত।
বিশ্ব পরিবেশ দিবসে আসুন, পৃথিবীবাসীর সাথে আমরাও যার যার অবস্থান থেকে কোভিড-১৯ মুক্ত একটি সুন্দর সবুজ পৃথিবী আর নির্মল প্রকৃতির জন্য একসাথে কাজ করি।
লেখক- ব্যাংকার, সাবেক ছাত্রলীগ নেতা।
এনএস/