যোগ ব্যায়াম নিরাময়ের একটি প্রক্রিয়া
আহমেদ শরীফ
প্রকাশিত : ০৮:৩১ পিএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৯:১৮ পিএম, ৯ জুন ২০২১ বুধবার
এই করোনাকালেও যোগ মেডিটেশনের ভূমিকা অত্যন্ত জোরালো বলেই প্রমাণিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের চেয়েও যা মানুষকে বেশি কাবু করে দিয়েছে তা হলো করোনা-আতঙ্ক। আতঙ্ক মানুষের স্নায়ুতন্ত্রকে দুর্বল করে দেয়। আর উল্টোদিকে যোগ মেডিটেশন স্নায়ুতন্ত্রকে শান্ত ও কর্মক্ষম রাখে। মেডিটেশন নামক মনের ব্যায়াম মনের ভেতর থেকে রাগ ক্ষোভ দুঃখ হতাশা আতঙ্ক দূর করে। যোগ মেডিটেশনের ভেতর দিয়ে দেহ-মনের যে শিথিলতা ও স্থিরতা আসে তা আর কোনোভাবেই অর্জন করা সম্ভব না।
পাশাপাশি মনোদৈহিক রোগ থেকে পরিত্রাণ দেয় এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায় যোগ মেডিটেশনের নিয়মিত চর্চা। এ সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা এখন সারা বিশ্বেই মানুষকে টেনে আনছে হাজার বছরের এই প্রাচীন সাধনার পথে।
২০১৪ সালে জাতিসংঘের ৬৯তম অধিবেশনে ১৭৫টি সদস্য দেশের অনুমোদনে সিদ্ধান্ত হয়েছে প্রতিবছর ২১ জুনকে বিশ্ব যোগ দিবস হিসেবে পালনের। সেই থেকে পৃথিবীজুড়ে এটি পালিতও হচ্ছে সাড়ম্বরে। উদযাপনে অংশ নিয়েছেন খোদ জাতিসংঘের মহাসচিব এবং বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়কেরা।
একমাত্র নিরাময়কারী পরম প্রভু। মানুষ শুধু তার প্রতিনিধি। নিরাময়ের বহু প্রক্রিয়া বা ধারা পরম প্রভু মানুষের জন্যে রেখেছেন। যেমন, ব্যায়াম, মেডিটেশন, প্রার্থনা, চিকিৎসা বিজ্ঞান, আয়ুর্বেদীয়, হোমিওপ্যাথি ইত্যাদি। সে রকম ব্যায়াম নিরাময়ের অন্যতম একটি প্রক্রিয়া। শত শত অংশগ্রহণকারী যোগ ব্যায়ামের কোর্সে সরাসরি প্রশিক্ষণ নিয়ে চর্চা করে তাদের ব্যাকপেইন, স্পন্ডিলাইটিসসহ বহু মনোদৈহিক রোগ থেকে মুক্ত হয়েছেন। নিয়মিত ব্যায়ামে ডায়াবেটিস, মেরুদন্ডের সমস্যা, স্থূলতা, হাঁটু ব্যথাসহ রোগগুলো অনেক সহজেই এড়ানো সম্ভব। আগামী ২১ জুন সারা বিশ্বের ন্যায় বাংলাদেশেও বিশ্ব যোগ দিবস পালন করা হবে। নিচে যোগ ব্যায়ামের আরও কিছু সুবিধা তুলে ধরা হলোঃ
অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের সুস্থতা: ফুসফুস থেকে শুরু করে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের কর্মতৎপরতা সুন্দরভাবে বজায় রাখা, খাবারের পুষ্টি উপাদানগুলোর সুষম বণ্টন এবং শরীরে যেসব হরমোন নিঃসরণ হয় সেগুলো যাতে ভারসাম্য বজায় রেখে আমাদের শরীরে কাজ করে সেজন্যে যোগব্যায়ামের উপকারিতা অনেক। অন্য কোনো ব্যায়ামে শরীরের অভ্যন্তরীণ এক্সারসাইজ হয় না। আর দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গকে সুস্থ এবং গতিশীল রাখতে না পারলে দেহের পেশী শক্তি এক সময়ে বিপর্যস্ত হতে বাধ্য। দেহের আভ্যন্তরীণ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সুস্থ এবং গতিশীল রাখার জন্যে যোগ ব্যায়ামের কোনো বিকল্প নেই।
আহমেদ শরীফ
হরমোন প্রবাহের গতিশীলতা রক্ষায়: যোগ ব্যায়ামে হরমোন প্রবাহ গতিশীল হয়। অন্য কোনো ব্যায়ামে হরমোন গতিশীল হয় না। আর হরমোনের অভাবে চিন্তাশক্তি কমে যায়, বুদ্ধি হ্রাস পায়, বুদ্ধির বিকাশও কমে যায়। আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ কার্যক্রম পরিচালনার একটি সিস্টেম বা মাধ্যম হচ্ছে এন্ডোক্রাইন সিস্টেম। যখন যে মাত্রায় যে হরমোন প্রবাহিত হওয়া দরকার সেই মাত্রায় যদি প্রবাহিত হয় আপনি ফিজিক্যাল ফিটনেসের তুঙ্গে থাকবেন। আপনি হালকা থাকবেন, আপনি বাতাসের সাথে চলবেন। আপনি ২২/২৪ ঘণ্টাও কাজ করতে পারবেন বিরামহীনভাবে। যেমন, ইঞ্জিনের পাগ যদি ঠিক না থাকে, পাগে যদি ময়লা থাকে, পাগে যদি কার্বন জমে যায়, ফুয়েল যদি প্রোপারলি না থাকে তাহলে ইঞ্জিন চললেও মনে হবে ধাক্কা দিচ্ছে, আবার বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। আর যদি ফুয়েল ঠিক থাকে, পাগে যদি কার্বন না জমে তাহলে গাড়িতে স্টার্ট দিলেই দেখা যাবে স্পিড নিয়ে এগুচ্ছে। কারণ সমস্ত টিউনিংগুলো ঠিক আছে। আমাদের দেহটাও সে রকম। যোগ ব্যায়ামের বিশেষত্ব হলো এটি বডির ব্যালেন্সিং করে। বডির এন্ডোক্রাইন সিস্টেম, নার্ভাস সিস্টেম, ডাইজেস্টিভ সিস্টেমসহ সবগুলো সিস্টেমকে ব্যালেন্স করে।
ওজন নিয়ন্ত্রণে: যোগব্যায়াম আপনার শরীরের জন্যে যে ওজন থাকা প্রয়োজন সেই ওজন নিয়ে আসে। বডিকে টিউনিং করার জন্যে এবং ওজন কমানোর জন্যে এটি চমৎকার ব্যায়াম। অন্যান্য ব্যায়াম করে ওজন কমালে স্কিনে ভাঁজ পড়ে যায়। আর নিয়মিত যোগব্যায়াম করলে কাক্সিক্ষত ওজনের পাশাপাশি স্কিন ভালো থাকে। আসলে থাইরয়েডের হরমোনের ভারসাম্যহীনতার কারণে কেউ কেউ এত খাচ্ছে কিন্তু বাড়ছে না। হয়তো আস্ত একটা খাসী খেয়ে ফেলছে কিন্তু বাড়ছে না। যখন হরমোনের ভারসাম্য আসবে তখন ওজনের হ্রাস/বৃদ্ধিও নিয়ন্ত্রণে চলে আসবে। যোগ ব্যায়ামের প্রয়োজনীয়তা এখানে। আপনার নরমাল ওজন বা স্ট্যান্ডার্ড ওজনের চেয়ে পাঁচ কেজি প্লাস বা মাইনাস এটা হতে পারে। কিন্তু আপনার এনার্জি লেভেল এত বাড়াবে যা অন্য কোনো ব্যায়ামে সম্ভব নয়।
তারুণ্য বজায় রাখতে: যোগ ব্যায়াম বয়স বৃদ্ধির হারকে কমিয়ে দেয়। একজন মানুষের মেরুদন্ড যত স্থিতিস্থাপক হবে তত তিনি তরুণ থাকবেন। মেরুদণ্ড যত শক্ত থাকবে তত তার বয়স বাড়তে থাকবে। যোগ ব্যায়াম মেরুদন্ডের স্থিতিস্থাপকতাকে বাড়িয়ে দেয়, মুভমেন্টটাকে বাড়িয়ে দেয়। যারা নিয়মিত ব্যায়াম করেন তারা আগের চেয়ে বেশি পরিশ্রম করতে পারেন, কাজ করতে পারেন, কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
টেনশনমুক্ত সতেজ মন: ব্যায়াম এবং মেডিটেশন পরস্পরের পরিপূরক। যোগ ব্যায়াম দেহটাকে ফিট রাখছে সুন্দর মনের উপযোগী করে। আর মেডিটেশন মনটা ঠিক রাখছে সুন্দর দেহের জন্যে। কিছু কিছু ব্যায়াম আছে, যেমন অতিরিক্ত টেনশনের কারণে বা হয়তো টিভিতে থ্রিলার ছবি বা চক্রান্ত-ষড়যন্ত্র দেখে উত্তেজনায় রাতে ঘুম আসতে দেরি হচ্ছে। আপনি বসুন, কিছুক্ষণ গোমুখাসন করুন। দেখবেন আপনার ন্সায়ু আস্তে আস্তে শিথিল হয়ে আসছে। আপনি ঘুমিয়ে পড়ছেন। অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা বা হতাশায় আক্রান্তদের ক্ষেত্রে মেডিটেশনের পাশাপাশি যোগ ব্যায়াম অত্যন্ত উপকারী।
সুস্বাস্থ্য লাভ: এখন সারা পৃথিবীতে যোগ ব্যায়াম ও মেডিটেশনের সবচেয়ে বেশি প্রয়োগ হচ্ছে রোগ নিরাময়ে। পঞ্চাশের দশকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) মেডিটেশনকে বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে স্বীকৃতি প্রদান করে। ১৯৯৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব হেলথ, ন্যাশনাল ইনষ্টিটিউট অব হেলথ হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রো চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে বড় সরকারি প্রতিষ্ঠান। এর বাঘা বাঘা প্রফেসরদের নিয়ে প্যানেল করা হলো। তোমরা অনুসন্ধান করো, সার্ভে করো, জরিপ করো যে মাইগ্রেন, মাথাব্যাথা, ব্যাকপেইন, আর্থ্রাইটিস, মহিলাদের পিরিয়ডের সময় অনেকের খুব পেইন হয়, এই পেইনগুলো নিরাময়ে মেডিটেশনের কোনো ভূমিকা আছে কি না। তারা এক বছর সার্ভে করলেন এবং ১৯৯৬ সালে তারা রির্পোট দিলেন। পেইনকিলার এবং সার্জারী যতটা কার্যকারী এই অসুখগুলির নিরাময়ে মেডিটেশনও ততটাই কার্যকরী এবং ১৯৯৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রে মেডিটেশন সরকারিভাবে স্বীকৃতি লাভ করলো মাথাব্যাথা, মাইগ্রেন, আর্থ্রাইটিস এগুলোর প্রতিকার ও প্রতিষেধক হিসেবে।
তারপরে ক্রনিক ঠান্ডা, এজমা, এলার্জি, অনিদ্রা, উচ্চরক্তচাপ এগুলো থেকে মুক্তির জন্য যোগ ও মেডিটেশন চমৎকারভাবে আপনাকে সাহায্য করবে।
হৃদরোগ: ক্যালিফোর্নিয়ার কার্ডিওলজিস্ট ডা. ডিন অরনিশ প্রথম ১৯৮৭ সালে ৪০ জন হৃদরোগী নিয়ে গবেষণা করলেন। কোনো ওষুধ না, এনজিওপ্লাস্টি না বাইপাস না, শুধু মেডিটেশন, যোগব্যায়াম, লো- কোলেস্টরল ডায়েট আর কাউন্সেলিং এক বছর। ভাল হয়ে গেলেন সবাই।
লেখকঃ চিফ ইয়োগা ইন্সট্রাক্টর, ইয়োগা কার্যক্রম, কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন।
আরকে//