ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

একজন আজিম উদ্দিন ও তাঁর ছাত্রত্ব

সমর ইসলাম

প্রকাশিত : ০৭:৪৪ এএম, ১১ জুন ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৪৯ এএম, ১৪ জুন ২০২১ সোমবার

দুই হাজার চৌদ্দ সালের ছাব্বিশ ডিসেম্বর। নেত্রকোণা আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের শতবর্ষপূর্তি। অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয় একাশি বছরের এক বৃদ্ধকে। তাঁর নাম আজিম উদ্দিন। বয়সের কারণে তাঁর শরীরে আগের সেই তাকত নেই। চোখেও ঝাপসা দেখেন। কিন্তু প্রাণের স্কুল প্রাঙ্গণে আয়োজিত অনুষ্ঠানে যোগ দেন তিনি। অনুষ্ঠানে একটি ঘোষণা শুনে হকচকিয়ে যান আজিম উদ্দিন। 

অনুষ্ঠানের সঞ্চালক বলছেন, আজ বৃদ্ধ আজিম উদ্দিন এই স্কুলের ছাত্রত্ব ফিরে পেয়েছেন। ঝাপসা চোখে তাকান ঘোষকের দিকে। কান খাড়া করেন। শুনেন, তিনি এখন এই স্কুলের ছাত্র। আঙুলের ডগায় বছর গুনেন আজিম উদ্দিন। বাষট্টি বছর। ঠিক বাষট্টি বছর আগে তাঁর ছাত্রত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছিল। অপরাধ, তিনি ভাষা আন্দোলন করেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে কবিতা লেখেন। 

মুহূর্তের মধ্যে তার মন চলে যায় বাষট্টি বছর আগে। তখন টগবগে কিশোর। তারুণ্যের ছোঁয়া দেহমনে। স্কুল আঙ্গিনায় বন্ধুদের সাথে আড্ডা। পড়া নিয়ে, পাকিস্তানী শাসকদের অনিয়ম, শোষণ-বঞ্চনা নিয়ে। কত স্মৃতি আজ চোখে ভাসে।

১৯৫২ সালের কথা। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে উত্তাল সারা পূর্ব পাকিস্তান। ১৯৪৮ সালে আন্দোলন ঢাকাতে শুরু হলেও তার ঢেউ আছড়ে পড়ে সর্বত্র। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষার দাবিতে মিছিলে গুলি চালায় পুলিশ। শহীদ হন সালাম, রফিক, শফিক, বরকত, জব্বারসহ অনেকে। এ ঘটনায় পুরো পূর্ব পাকিস্তান শাসকের বিরুদ্ধে ফুঁসে ওঠে। ভাষার দাবি আরও সোচ্চার হয়। আন্দোলন হয় বেগবান।

আজিম উদ্দিন তখন অষ্টম শ্রেণির ছাত্র। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন ঢাকার গণ্ডি ছাড়িয়ে সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে। নেত্রকোণা তখন ময়মনসিংহ জেলার মহকুমা শহর। এখানেও আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে। এই আন্দোলনে শরীক হন আজিম উদ্দিন। সে বছর ডিসেম্বর মাসে নেত্রকোণা মহকুমা আয়োজিত বৃহত্তর ময়মনসিংহের সাহিত্য সম্মেলন হয়। সম্মেলনে স্বরচিত কবিতা আবৃত্তি করেন আজিম উদ্দিন। রবীন্দ্রনাথের বিখ্যাত সোনার তরী কবিতার স্যাটায়ার টাইপ প্যারোডি করেন তিনি। 

কবিতার শিরোনাম ‘আজব ভুঁড়ি’। কবিতাটি এই রকম-
‘ঢাকার গগনে মেঘ ঘন বরষা,
মিলিটারি ছাড়া আর নাহি ভরসা’
রাশি রাশি ভারা ভারা ঘুষ খাওয়া হলো সারা,
ক্রোধভরা জনমত খরপরশা।
খাইতে খাইতে ঘুষ এলো বরষা।

একখানি ছোট গদী, আমি একেলা,
চারদিকে এমএলএ-রা করিছে খেলা।
সন্মুখে দেখি আঁকা, জনতার দাবি মাখা,
আঁধার কুয়াশা ঢাকা প্রভাত বেলা,
বাঙলার মসনদে আমি একেলা।
ঢাকার গগনকুলে কালো মেঘ নেচে চলে
শূন্য প্রাসাদ পুড়ে রহিনু পড়ি
সবকিছু নিয়ে গেল আজব ভুঁড়ি।

কবিতা আবৃত্তির পর রাজরোষে পতিত হন আজিম উদ্দিন। নেমে আসে ভয়ানক রাজদণ্ড। যার আঘাতে স্বপ্নবাজ এক কিশোরের স্বপ্ন পুড়ে ছাই হয়ে যায়। আজিম উদ্দিনের ভাষায়- কবিতা পাঠের কয়েকদিন পর আমার কাছে রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কবিতা লেখার কারণ জানতে চাওয়া হয়। জবাবে আমি লিখেছিলাম, যা সত্য তাই লিখেছি। জবাব সন্তোষজনক না হওয়ায় পর পর তিনবার আমাকে নোটিশ দেওয়া হয়। আমার একই জবাব। যা বিশ্বাস করি তাই লিখেছি।


আজিম উদ্দিনের বাড়ি পূর্বধলা উপজেলার জারিয়া গ্রামে। পিতা মরহুম শেখ শমসের আলী ছিলেন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী। পিতার মৃত্যুর পর নেত্রকোণা শহরের ইসলামপুরে মামার বাড়িতে লেখাপড়ার জন্য চলে আসেন। ১৯৫০ সালে আঞ্জুমান আদর্শ সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ে ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন। ১৯৫২ সালে অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই নেত্রকোণা মহকুমা ছাত্রলীগের সদস্য হন। তখন মহকুমা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন প্রয়াত এমএলএ আব্দুল খালেক তালুকদার এবং সাধারণ সম্পাদক সাবেক সংসদ সদস্য প্রয়াত ফজলুর রহমান খান।

আজিম উদ্দিন জানান, ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তির পরই তিনি প্রগতিশীল সংগঠনের সভা-সমাবেশ ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে থাকেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে জনমত সৃষ্টি এবং আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য বিভিন্ন স্কুলে গিয়ে সংগ্রাম কমিটি গঠনে বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখেন। ছাত্রাবস্থায় স্কুলের মিটিং মিছিলে নেতৃত্ব দেন। ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তাঁর লেখা বিভিন্ন কবিতা তখনকার পত্র-পত্রিকায় প্রকাশ হতে থাকে। 

১৯৫১ ও ৫২ সালে লেখা ‘পকেট ভারি’ ও ‘ঘুষের থলি’ নামের দুটি কবিতা স্কুল ম্যাগাজিনে প্রকাশ হয়। কবিতা দুটি তৎকালীন সরকারকে বিদ্রুপ করে লেখা। কিছুদিন পরই আজিম উদ্দিনের কাছে বিদ্রুপ করে কবিতা লেখা ও আবৃত্তি করার কৈফিয়ত তলব করে তৎকালীন মুসলিমলীগ সরকার। রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে তৃতীয়বারের মতো আজিম উদ্দিনের একই জবাব।

রুষ্ট হয় সরকার পক্ষ। এই অবাধ্যকে উপযুক্ত শাস্তি দেওয়া দরকার। অবশেষে ১৯৫৩ সালে স্কুল থেকে রাসটিকেট দেওয়া হয় তাকে। স্কুল থেকে চিরতরে বহিষ্কার করায় চরম আহত হন আজিম উদ্দিন। মাথায় বজ্রপাতের মতো অবস্থা। কী করবেন দিশেহারা হয়ে পড়েন তিনি। বোবা কান্নায় গুমরে মরেন। লেখাপড়া তো দূরের কথা পালিয়ে দিন কাটে তার। ইচ্ছে ছিল ডাক্তারি পড়ে মানুষের সেবা করবেন। কিন্তু স্বপ্নভাঙার নির্মম বেদনা তাকে কুরে কুরে খায়। আর লেখাপড়াই হয়নি তার।

অনুষ্ঠান সঞ্চালকের ঘোষণার পর একনজরে ফ্লাশব্যাকে দেখে নেন তাঁর অতীতটা। আবেগে চোখে পানি চলে আসে। আজ তিনি কলঙ্কমুক্ত। রাসটিকেট উঠিয়ে নেওয়া হয়েছে। এখন তিনি ছাত্র। তাঁর প্রিয় স্কুলের ছাত্র। মন চাইছে বই নিয়ে শ্রেণিকক্ষে চলে যেতে। সহপাঠীদের সাথে খেলায় মেতে উঠতে। কিন্তু সেই সহপাঠীরা এখন কোথায়?

বাস্তবে ফিরে আসেন আজিম উদ্দিন। ইচ্ছে করে চিৎকার করে বলতে, ফিরিয়ে দাও আমার হারিয়ে যাওয়া বাষট্টিটি বছর। এতদিনে ডাক্তার হিসেবে আমি অবসরে যেতাম। আর আজ?

আজিম উদ্দিনের ভেতরের বোবা কান্না কেউ দেখতে পায় না। শুধু তাঁর চোখের পানিটা সবার নজরে আসে। আজিম উদ্দিন শুধু একজন ছাত্রত্ব হারানো ভাষাসৈনিক নন। তিনি মুক্তিযুদ্ধের একজন সংগঠক।

পুনশ্চ: সম্প্রতি একুশে টেলিভিশনের নেত্রকোণা প্রতিনিধি মনোরঞ্জন সরকারের মাধ্যমে খোঁজ নিয়েছিলাম আজিম উদ্দিনের। তাঁর বয়স এখন নব্বই বছর। বয়সের ভারে ন্যূব্জ। তাঁর ছেলে জানান, ২০১১ সালে তিনি জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে একুশে পদক পাওয়ার ইচ্ছা পোষণ করে আবেদন করেছিলেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত সাড়া পাওয়া যায়নি। তাঁর জীবনের শেষ ইচ্ছা একুশে পদক। তিনি জানান, মৃত্যুর আগে যেন এই সম্মানটুকু নিয়ে মরতে পারি।

এনএস/