সিরাজগঞ্জে অর্থনৈতিক অঞ্চলের সম্ভাবনা
শেখ মনোয়ার হোসেন
প্রকাশিত : ০৪:০৮ পিএম, ২৫ জুন ২০২১ শুক্রবার
অর্থনৈতিক শোষণ থেকে দেশ ও জাতিকে মুক্ত করে মানুষের অধিকার আদায়ের প্রশ্নে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অবিস্মরণীয় নাম। এই নামের স্বাক্ষর আমরা খুঁজে ফিরি পতাকায়, স্বাধীনতায় এবং সার্বভৌমত্বের মহিমায়। ভাষার মুক্তি, শৃঙ্খলমুক্তির মাধ্যমে অর্থনৈতিক মুক্তি ঘটিয়ে স্বমহিমায় ও স্বমর্যাদায় বাঙালি জাতিকে প্রতিষ্ঠিত করাই ছিল বঙ্গবন্ধুর মূল লক্ষ্য।
এই লক্ষ্য অর্জনে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন। তিনি স্বপ্টম্ন দেখতেন, এদেশের দুঃখী মেহনতী মানুষ একদিন নিজের পায়ে দাঁড়াবে এবং সম্মানজনক জীবনযাপন করবে। সেই লক্ষ্য সামনে নিয়ে স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে শিল্প, কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসহ সকল ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিকল্পনা প্রণয়ন করেন। অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য শিল্পের সম্প্রসারণ দরকারি বিধায় বঙ্গবন্ধু আগের শিল্পনীতি রহিত করে নতুন শিল্পনীতি ঘোষণা করলেন। ব্যক্তিগত কারখানাগুলো সরকারীকরণ ছিল তার মধ্যে অন্যতম। শ্রমিক-কর্মকতা-কর্মচারীরা নব উদ্যমে, নতুন আশায় বঙ্গবন্ধুর স্বপ্টেম্নর সোনার বাংলা গড়ার কাজে মনোযোগী হলেন। দেশের সর্বস্তরের মানুষ বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে যখন দেশ গড়ায় ব্যস্ত। যুদ্ধবিধ্বস্ত একটি দেশ যখন স্বনির্ভরতার দিকে এগোচ্ছে, ঠিক তখনই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট মুক্তিযুদ্ধে পরাজিত শত্রুদের হাতে তিনি সপরিবারে নির্মমভাবে নিহত হলেন। জাতিকে ঢেকে দিল অন্ধকার।
দীর্ঘদিন পর ক্ষমতায় আসে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ। শিল্প, শিক্ষা, বাণিজ্য, গ্যাস, বিদ্যুৎ, কৃষি, যোগাযোগ, পরিবহনসহ সকল ক্ষেত্রে উন্নয়নের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে শেখ হাসিনার সরকার ইতোমধ্যেই দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। ইতোমধ্যে আমরা তার সুফল ভোগ করছি। বাংলাদেশের উন্নয়নে পরিকল্পিত শিল্পায়নের একটি অবিসংবাদিত নাম হিসেবে যোগ হতে যাচ্ছে 'সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন'। দেশের মধ্যাঞ্চলে যমুনা নদী-সংলগ্ন পলল-প্লাবিত সিরাজগঞ্জ জেলার এই শিল্পাঞ্চলটি পাল্টে দেবে মধ্যাঞ্চলসহ সমগ্র উত্তরাঞ্চলের, এমনকি সমগ্র দেশের মানুষের জীবনযাত্রা, কর্মযোগ ও অর্থনৈতিক জীবনব্যবস্থা। এক সময়ের অবহেলিত কিন্তু বর্তমানে বঙ্গবন্ধু যমুনা সেতু ও রেলপথ সেতু নির্মাণের ফলে বস্ত্র খাতের বিশেষত, তাঁতবস্ত্রের 'হাব'খ্যাত সিরাজগঞ্জ জেলা তার অতীত ঐতিহ্য সাঙ্গীকৃত করে নবউদ্যমে 'সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন' গড়ার মানসে বদ্ধপরিকর। সর্বস্তরের মানুষের উদ্যমকে আমলে নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এই ইকোনমিক জোনকে সর্বাঙ্গীন সহায়তা দিয়ে যাচ্ছেন। শেখ হাসিনার প্রত্যক্ষ তত্ত্বাবধানে সিরাজগঞ্জে 'সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন' প্রতিষ্ঠা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়। আমাদের উদ্দেশ্য হলো রাজধানী ও দেশের বড় বড় শহরকেন্দ্রিক কর্মস্থান তথা জীবন ও জীবিকার জন্য কষ্টসাধ্য উপায় থেকে মানুষকে মুক্তি দিয়ে কর্মসংস্থানকে তাদের নাগালের মধ্যে নিয়ে আসা। উপরন্তু মানুষ তাদের চিরকালীন নিজস্ব গ্রামীণ নিসর্গের আবহে বসবাস করেই জীবন ও জীবিকার সংস্থান করতে পারে। যেন তাদের পরবর্তী প্রজন্ম এখান থেকেই আধুনিক জীবন-যাপনের যাবতীয় সুযোগ-সুবিধা লাভ করতে পারে। যেন রোগ-শোকে তাদের আর দৌড়াতে না হয় দূর-দূরান্তে। একটি সুখী-সমৃদ্ধ আত্মনির্ভরশীল বাংলাদেশ বিনির্মাণের লক্ষ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মিশন ও ভিশনকে সামনে রেখে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে পরিকল্পিত শিল্পাঞ্চল গড়ে তোলার যে বিশাল কর্মপরিকল্পা নেওয়া হয়েছে, আমরা তারই আলোকে উত্তরবঙ্গের প্রবেশদ্বার বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম তীরে 'সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন' গঠন করার উদ্যোগ গ্রহণ করি। এ উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত হয় এ দেশের স্বনামধন্য ১১টি প্রতিষ্ঠিত শিল্পপ্রতিষ্ঠান। নগদ অর্থে ১০৪১ দশমিক ৪৩ একর ভূমি ক্রয় করে এখানে বেসরকারি পর্যায়ে দেশের সর্ববৃহৎ ইকোনমিক জোন নির্মাণের যাবতীয় অবকাঠামো তৈরির কার্যক্রম ইতোমধ্যে শুরু করা হয়েছে।
একটি আধুনিক সবুজ শিল্পনগরীতে সামাজিক, অর্থনৈতিক, মানবিক এবং পরিবেশগত সুবিধা বজায় থাকে। সিরাজগঞ্জ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্লাটিনাম গ্রিন কনসেপ্টে গড়ে উঠবে; যেখানে গ্রামের প্রাকৃতিক পরিবেশ ক্ষতিগ্রস্ত না করে আধুনিক শিল্পনগরীর সুযোগ-সুবিধাসহ দক্ষ জনগোষ্ঠীর বাসস্থান ও কর্মসংস্থান গড়ে উঠবে। শহরমুখী শ্রমজীবী মানুষ শহরের মানের শিক্ষালয়, বাসস্থান, স্বাস্থ্যসেবা, বিনোদন ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের মধ্যে উপভোগ করতে পারলে তারা কর্মের সন্ধানে পরিবারচ্যুত হবে না। দেশে বেশিরভাগ শিল্পই গড়ে উঠেছে অপরিকল্পিতভাবে। এর ফলে জমি, অর্থ এবং সময় অপচয় হচ্ছে। কাজেই পরিকল্পিত শিল্পায়নের জন্য অর্থনৈতিক অঞ্চল আশীর্বাদ। নিঃসন্দেহে এতে জমির অপচয় রোধ হবে। অন্যদিকে ব্যাপক হারে কৃষিজমি বা বনভূমি ধ্বংস না করে বরং অর্থনৈতিক অঞ্চলের মধ্যে পরিকল্পিত সবুজায়ন হবে। এককভাবে শিল্পকারখানা প্রতিষ্ঠা করতে গেলে গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অন্যান্য অবকাঠামোর খরচ এককভাবে বহন করতে হয়। ফলে খরচ অনেক বেশি পড়ে ও অনেক অপচয় হয়। কিন্তু অর্থনৈতিক অঞ্চলে শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার কারণে প্রয়োজনীয় সব সেবা মিলবে এক ছাতার নিচে। এককভাবে সবাই সব ধরনের সুবিধা নিতে পারবেন। পণ্য ওই অঞ্চল থেকেই দেশে-বিদেশে বাজারজাত করা যাবে। বন্দরগুলোকেও অযথা জটের মুখোমুখি হতে হবে না। পরিকল্পিত শিল্পনগরীতে উৎপাদন বাড়বে, অন্যদিকে শিল্পায়নের বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা পাবে পরিবেশ। বিনিয়োগকারীরা সব সেবা ও সুযোগ-সুবিধা এই অঞ্চলের মধ্যেই পাবেন।
সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনের স্থানটি দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারী ও শ্রমজীবীর জন্য অপার সম্ভাবনাময় স্থান। কারণ, এই অঞ্চলে রয়েছে রেলপথ, জলপথ ও সড়কপথের সুবিধা। এক থেকে দুই বছরের মধ্যে চারলেন ও ফ্লাইওভার হয়ে গেলে দেশি-বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সহজেই বিনিয়োগ করতে পারবেন। ঢাকা এয়ারপোর্ট থেকে মাত্র দুই ঘণ্টার ব্যবধানে সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোনে পৌঁছানো যাবে। সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী ব্যবস্থাপনার সঙ্গে সম্পৃক্ত সকল কর্তৃপক্ষকে নদীর গভীরতা বাড়ানোর জন্য নিয়মিত নদীশাসন ও ড্রেজিং করার নির্দেশ দিয়েছেন। ফলে নৌপথে সরাসরি সিরাজগঞ্জ থেকে মোংলা, চট্টগ্রাম বা পায়রা বন্দরে পণ্যসামগ্রী পরিবহন করা যাবে। সিরাজগঞ্জ এলাকার মাটি অত্যন্ত উর্বর। যেখানে খাদ্য, রবিশস্য, ফলফলাদিসহ বিভিন্ন ধরনের সবজি উৎপন্ন হয়। আরও আছে তাঁতশিল্প, কুটিরশিল্প, দুগ্ধজাত পণ্য ইত্যাদি। গ্রামীণ জীবনের স্বকীয়তা বজায় রেখে উন্নয়নের দোরগোড়ায় পৌঁছে যাবে কর্ম, শিল্প ও মানুষ। বায়ু, পানি দূষণমুক্ত সুস্থ পরিবেশে গড়ে উঠবে একটি দক্ষ ও উৎপাদনক্ষম জনগোষ্ঠী।
লেখক : উদ্যোক্তা ও পরিচালক, সিরাজগঞ্জ ইকোনমিক জোন লিমিটেড; সিনেট সদস্য, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়
এসএ/