হুমায়ুন কবীর বালু এবং ১৯৭২ সালের একটি পুলিশ প্রতিবেদন
আসিফ কবীর
প্রকাশিত : ১০:০৫ এএম, ২৭ জুন ২০২১ রবিবার
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২৮ জুন হুমায়ুন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পরদিনই বিশেষ প্রোগ্রামে খুলনা আসেন। তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, প্রায় ছয় মাস আগে যখন তিনি সাংবাদিক মানিক সাহা নিহত হলে একইভাবে এসেছিলেন ও খুলনা প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিলেন; তখন (সভার সভাপতি) হুমায়ুন কবীর বালু তার নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে শেষবার দেখতে আসার অনুরোধ করেছিলেন।
২০০৪ সালের ২৭ জুন সাংবাদিক ও মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক হুমায়ুন কবীর বালু খুলনায় নিজ পত্রিকা অফিসের সামনে বোমা হামলায় নিহত হন। সে সময় তিনি খুলনা প্রেসক্লাবের সভাপতি। এর আগে ১৯৮৪ ও ’৯৮ সালে তিনি এ বিভাগীয় বৃহত্তম সাংবাদিক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছিলেন। তিনি স্বাধীন বাংলা ছাত্রসংগ্রাম পরিষদ-খুলনা জেলার যুগ্ম আহ্বায়ক হিসেবে খুলনায় স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলকদের অন্যতম। ২০০৯ সালে সরকার তাকে একুশে পদকে ভূষিত করে।
২০০৮ সালে বালু হত্যা মামলায় সব আসামিকে আদালতের রায়ে খালাস দেওয়া হয়। আদালত একই রায়ে তদন্তের দুর্বলতা, তথ্য-প্রমাণের ঘাটতি, সাক্ষ্য প্রদানের অপ্রতুলতা ইত্যাদি উল্লেখ করে রায়ের পরিপ্রেক্ষিত ব্যাখ্যা করেন। ২০০৯ সালে একই ঘটনার বিস্ফোরক মামলাটি রায় ঘোষণার আগ মুহূর্তে পরিবারের পক্ষ থেকে আবেদন করে অধিকতর তদন্তের জন্য সিআইডিতে ন্যস্ত করার আদেশ লাভ হয়। দীর্ঘ পুনর্তদন্ত শেষে চার্জশিট আদালতে জমাদান শেষে পুনরায় বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয় এবং ১৮ জানুয়ারি ২০২১ বিস্ফোরক আইনে কৃত মামলায় সব আসামিকে যাবজ্জীবন দণ্ডের রায় দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় বারের রায়ে কিছুটা স্বস্তির জায়গা তৈরি হয়েছে। সাংবাদিকদের বিশেষ করে দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের যারা এ পেশায় যুক্ত তাদের মাঝেও সামাজিক নিরাপত্তার অদৃশ্য প্ররক্ষা বৃদ্ধির বোধ তৈরি হয়েছে। মামলা নিয়ে এতটুকু পর্যন্ত অর্জনও সহজ ছিল না। এই পথপরিক্রমায় পাশে থাকা সাংবাদিক সমাজ, আইনজ্ঞ, অধিকার কর্মী, সংশ্নিষ্ট বিভিন্ন পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা এবং রাজনৈতিক নেতৃত্বের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাই।
১৯৭২ সালেও একবার তার জীবন বিপন্ন হতে বসেছিল। এ বিষয়ে স্বাধীনতা পদক ও পদ্মশ্রী সম্মাননাপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা লে. কর্নেল (অব.) কাজী সাজ্জাদ আলী জহির বীরপ্রতীকের মাধ্যমে একটি গোয়েন্দা নথি হুমায়ুন কবীর বালুর পরিবারের হাতে আসে। ‘ইনডেক্স টু দ্য বাংলাদেশ পুলিশ অ্যাবসট্রাক্ট সাপ্লিমেন্ট অব ইন্টেলিজেন্স’ শিরোনামে ১ জানুয়ারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর ১৯৭২-এর ভলিউম-১ ভুক্ত ৪২ পাতার ৩২২ নম্বরে খুলনা উপশিরোনামে প্রতিবেদনটি বিবৃত হয়েছে। খুলনা পুলিশ স্টেশন কেস ১২নং ৫ মার্চ ১৯৭২-এ রেকর্ডকৃত। ৪৫৭/৩৭৬ একটি বাংলাদেশ পুলিশ কেস চালু হয়। রিপোর্টে দেখা যায়, খুলনার ইকবালনগর এলাকার [কাজী] শওকত আলী মামলাটির বাদী। হুমায়ুন কবীর বালু (বাংলাদেশ ছাত্রলীগের নেতা), বিবাদীকে (একজন ইউনিফর্ম অফিসার) ধর্ষণ চেষ্টাকালে হাতেনাতে স্থানীয় আরও কয়েকজনের সহায়তা নিয়ে ইকবালনগর এলাকায় ধরেন ও পুলিশে সোপর্দ করেন। পরে বিবাদী জামিন লাভ করেন।
জামিনে মুক্তি পেয়ে বিবাদী কয়েকজন সঙ্গী নিয়ে ৯ মার্চ ১৯৭২ রাত আনুমানিক ১২টা ৪৫-এ (আগে-পরে) হুমায়ুন কবীর বালুকে তুলে নিয়ে যায়। এ সময় ১৫, ইকবালনগরে তার পৈতৃক বাড়ি ভাঙচুর করে বিবাদী ও তার সঙ্গীরা। পরিবারের অভিযোগ পেয়ে পুলিশ তার খোঁজ শুরু করে। পরদিন সকালে শহরের জোড়াগেট এলাকায় তাকে মৃতপ্রায় অবস্থায় উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় ছাত্রসমাজ ক্ষিপ্ত ও প্রতিবাদী হয়।
জাতির পিতা ও প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ঘটনার পরপরই অবগত করেন খুলনায় বসবাসকারী তার ভাই শেখ আবু নাসের। জেনারেল এমএজি ওসমানী ওয়্যারলেস মেসেজে হুমায়ুন কবীর বালুর সন্ধান পেতে বার্তা দেন। এ ঘটনার পর দীর্ঘদিন খুলনা সদর হাসপাতালে ভর্তি থেকে তাকে চিকিৎসা গ্রহণ করতে হয়। তদানীন্তন কর্নেল আবুল মঞ্জুর ও মেজর সুবিদ আলী ভূঁইয়া খুলনা জেনারেল হাসপাতালে তাকে দেখতে আসেন। ১৯৭৫ সালে পরিবর্তিত রাজনৈতিক বাস্তবতায় এ ঘটনাটির রাজনীতিকরণের চেষ্টা হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০০৪ সালের ২৮ জুন হুমায়ুন কবীর বালু হত্যাকাণ্ডের পরদিনই বিশেষ প্রোগ্রামে খুলনা আসেন। তখন তিনি বিরোধী দলের নেতা। তিনি তার বক্তৃতায় উল্লেখ করেন, প্রায় ছয় মাস আগে যখন তিনি সাংবাদিক মানিক সাহা নিহত হলে একইভাবে এসেছিলেন ও খুলনা প্রেসক্লাবে প্রতিবাদ সভায় যোগ দিয়েছিলেন তখন (সভার সভাপতি) হুমায়ুন কবীর বালু তার নিজের জীবননাশের আশঙ্কা প্রকাশ করে শেষবার দেখতে আসার অনুরোধ করেছিলেন। হায়! তা ফলে গেল। সেই অনুরোধ রক্ষার জন্যই তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতার পক্ষ থেকে বার্তা পাঠিয়ে রাখা হয়, তার খুলনায় উপস্থিতির পরই যেন দাফন কার্যক্রম সম্পন্ন করা হয়। তিনি তখন একে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন।
রাজনৈতিক কারণে প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়েই তালিকা করে বিরোধী দল আওয়ামী লীগের নেতা-কর্মী, সমর্থক এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অনুবর্তী বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হচ্ছে, আরও হবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ তেমনই ঘটেছিল। বালু হত্যাকাণ্ড যে রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড- তারও প্রমাণ স্পষ্ট হতে থাকে। এই আকস্মিক হত্যাকাণ্ডে তার পরিবারকে অসীম মানবিক সংকটে নিমজ্জিত হতে হয়।
জ্যেষ্ঠ সন্তান হিসেবে কঠিন বাস্তবতা মোকাবিলা করতে হয় আমাকে। যা মনে পড়লে এখন ভাবি, তখন অতিক্রম করলেও দ্বিতীয়বার এই বৈতরণী পেরোতে দিলে একই ব্যক্তি হয়েও আমি আর কোনোদিন তা মোকাবিলা করতে পারব না।
লেখক: হুমায়ুন কবীর বালুর পুত্র
এএইচ/