ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

মুক্তিযুদ্ধ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১২:০৩ পিএম, ২৯ জুন ২০২১ মঙ্গলবার

১৯৭১ সালে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। একাত্তরে পাকিস্তান সশস্ত্রবাহিনী বাঙালি সৈনিক, বৈমানিক ও ছাত্রছাত্রীগণকে একই পর্যায়ভুক্ত করে আক্রমণ চালিয়েছিল। এই অপারেশনের নাম ছিল ‘অপারেশন সার্চলাইট’। এইচ আওয়ার নির্ধারিত হয়েছিল ২৬ মার্চ রাত ১টা। ক্যান্টনমেন্ট থেকে সেনাবাহিনী প্রথম প্রতিরোধের সম্মুখীন হয় ফার্মগেটে। রাস্তায় পড়ে থাকা একটি বিশাল গাছ বাহিনীর গতিরোধ করে, রাস্তার পাশের এলাকা পুরানো গাড়ি আর স্টিম রোলার দিয়ে বন্ধ ছিল। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের ছাত্ররা হলের সামনে একটি বড় গাছের গুঁড়ি ফেলে রেখে সেনাবাহিনীকে বাধা দেয়। সকাল ৪টার মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয় ভবনগুলো দখল করে নেয় তারা। ১৮ নং পাঞ্জাব, ২২ নং বেলুচ এবং ৩২ নং পাঞ্জাব রেজিমেন্টের বিভিন্ন ব্যাটালিয়ন নিয়ে গঠিত বিশেষ মোবাইল বাহিনী লেফটেন্যান্ট কর্নেল তাজের নেতৃত্বে স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ট্যাংক বিধ্বংসী রিকয়েললেস রাইফেল, রকেট লঞ্চার, মর্টার, ভারি ও হালকা মেশিনগানে সজ্জিত হয়ে ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ থেকে ২৭ মার্চ সকাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস ঘেরাও করে আক্রমণ, পাইকারি হত্যা, লুণ্ঠন, অগ্নিসংযোগ এবং ধ্বংসযজ্ঞ চালায়। 

ঐ রাতে দৈবক্রমে পাকিস্তানি আক্রমণ থেকে বেঁচে যাওয়া অধ্যাপক ড. মফিজুল্লাহ্ কবির তার ১৯৭১-৭২ সালের বার্ষিক রিপোর্টে লেখেন, ঐ রাতে ছাত্র সহ প্রায় ৩০০ ব্যক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় নিহত হয়। সেই সাথে ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ১০ জন শিক্ষক ও ২৬ জন অন্যান্য কর্মচারী। 

নিহত শিক্ষকদের মধ্যে ছিলেন, ড. ফজলুর রহমান (মৃত্তিকাবিজ্ঞান বিভাগ), অধ্যাপক এ. আর. খান খাদিম (গণিত বিভাগ), অধ্যাপক শরাফত আলী, ড. গোবিন্দচন্দ্র দেব (প্রাক্তন প্রভোস্ট জগন্নাথ হল), অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, ড. জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতা (প্রভোস্ট জগন্নাথ হল), অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য, অধ্যাপক মুহম্মদ মুকতাদির (ভূতত্ত্ব) প্রমুখ। সবচেয়ে নারকীয় ঘটনা ঘটে জগন্নাথ হলে, সেই রাতে ৩৪ জন ছাত্র শুধু সেই হলেই নিহত হয়। ২৬ মার্চ রমনা কালীবাড়িও আক্রান্ত হয়। সেস্থলে নিহত হয় জগন্নাথ হলের ৫/৬ জন ছাত্র। হানাদার বাহিনী হত্যা করে মধুর ক্যান্টিন খ্যাত মধুসূদন দে’কেও (মধুদা)। মুক্তিযুদ্ধ কালীন পাকিস্তানি সৈন্যরা মধুর ক্যান্টিন ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিতে শুরু করলে উর্দু বিভাগের শিক্ষক আফতাব আহমদ সিদ্দিকী খবর পেয়ে তাদের বাধা দেন এবং জানান যে এই ভবনেই ১৯০৬ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১০ নভেম্বর সশস্ত্র সৈন্যরা রোকেয়া হলে প্রবেশ করে এবং ত্রিশজন ছাত্রীর উপর নির্যাতন করে। তারা প্রভোস্টের বাংলোও অবরোধ করে রাখে।

একাত্তরের মার্চ মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের অধিবেশনে যোগদানের জন্য জেনেভা যান। সেখানে জেনেভার একটি পত্রিকায় দু’জন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রের মৃত্যুসংবাদ দেখে বিচলিত হয়ে ২৫ মার্চ পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক শিক্ষাসচিবকে পাকিস্তান দূতাবাসের মাধ্যমে প্রেরিত এক পত্রে লেখেন, ‘আমার নিরস্ত্র ছাত্রদের উপর গুলি চালানোর পর আমার ভাইস চ্যান্সেলর থাকার কোন যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। তাই আমি পদত্যাগ করলাম’। ফলে মার্চের সেই কালরাত্রিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছিল উপাচার্য বিহীন। পরে মুজিবনগর সরকার বিচারপতি সাঈদকে ‘প্রবাসী সরকারের বিশেষ প্রতিনিধি’ হিসেবে নিয়োগ দেয়। পাকিস্তান বাহিনী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন উপাচার্য ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসায়েনকে তাদের কনভয়ে করে ঢাকায় নিয়ে এসে ১৯ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের পদে বসান। তাকে সহায়তা করেন ড. হাসান জামান, ড. মেহের আলি। স্বাধীনতার পর তিনজনই গ্রেফতার হন এবং মুক্তির পর দেশ ত্যাগ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অসংখ্য ছাত্রছাত্রী মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি অংশগ্রহণ করেন। এদের অনেকেই পরবর্তীকালে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কমিশন লাভ করে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষক মুক্তিযুদ্ধকালীন মুজিবনগর যান এবং প্রবাসী সরকারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ধ্বংসযজ্ঞ চালাবার পরে টিক্কা খান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল বিভাগীয় প্রধানদের ২১ এপ্রিল ও সকল শিক্ষকদের ১ জুন কাজে যোগ দিতে বলেন। টিক্কা খান ২ আগস্ট থেকে সকল ক্লাস চালু করারও আদেশ জারি করেন। মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকার অভিযোগে কয়েকজন শিক্ষককে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে বন্দি করা হয় এবং ইন্টারোগেশনের মাধ্যমে নির্যাতন করা হয়। এদের মধ্যে ছিলেন ড. আবুল খায়ের, ড. রফিকুল ইসলাম, কে এ এম সাদউদ্দিন, আহসানুল হক এবং এম শহীদুল্লাহ। টিক্কা খান অধ্যাপক মুনীর চৌধুরী, ড. নীলিমা ইব্রাহিম, ড. সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, ড. এনামুল হককে লিখিত ভাবে সতর্ক করে দেন। ড. আবু মোহাম্মদ হাবিবুল্লাহকে পদচ্যুত করা হয়।
[মূল নিবন্ধ : বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
সূত্র : ইউকিপিডিয়া
এসএ/