ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

কালজয়ী গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা`র নীরবে প্রস্থান 

মোহাম্মদ মাসুদ খান

প্রকাশিত : ০৪:৫৬ পিএম, ৪ জুলাই ২০২১ রবিবার

আজ ৪ জুলাই ২০২১ ভোর ৪ ঘটিকায় চলে গেলেন গীতিকবি, শিশু সংগঠক ও বাংলাদেশ বেতারের সাবেক পরিচালক ফজল-এ-খোদা (ইন্না-লিল্লাহি ওয়া ইন্নাইলাহি রাজিউন)। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর। 

গত ২৪ জুন ফজল-এ-খোদা ও তার সহ ধর্মিনী মাহমুদা সুলতানার করোনা শনাক্ত হয়। এক পর্যায়ে তাদের দুজনের অবস্থার অবনতি হলে প্রথমে তার স্ত্রী পরে গত ১ জুলাই ফজল-এ-খোদা কে শহীদ সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে ভর্তি করানো হয়। 

গতকাল ৩ জুলাই ফজল-এ-খোদার শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে চিকিৎসক তাকে আইসিইউ তে স্থানান্তরের পরামর্শ দান করেন।  দুঃখের বিষয় হাসপাতালে আইসিইউ শয্যা খালি না থাকায় বরেন্য এই মানুষটি আইসিইউ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়ে মৃত্যু বরণ করেন।

আজ সকাল ১০ ঘটিকায় জানাজা শেষে তাকে রায়ের বাজার কবরস্থানে সমাহিত করা হয়। তার মেজো ছেলে সজীব ওনাসিস এই তথ্যগুলো জানিয়েছেন। 

উল্লেখ্য গীতিকবি ও শিশু সংগঠক ফজল-এ-খোদা’র জন্ম ৯-মার্চ-১৯৪০ সালে পাবনা জেলার বেড়া থানার বনগ্রামে। শিশু কিশোর সংগঠন শাপলা শালুকের আসরের প্রতিষ্ঠাতা ফজল-এ-খোদা মিতা ভাই নামেও পরিচিত ছিলেন।

ফজল-এ-খোদা’র কর্মজীবন শুরু হয় বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার হিসাবে ১৯৬৩ সাল থেকে। ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে তিনি তালিকাভুক্ত হন। তাঁর লেখা বহুগান শ্রোতাপ্রিয়তা পেয়েছে। তারমধ্যে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি মুক্তিযুদ্ধে সাত কোটি মানুষকে উদ্দীপ্ত করেছে। ১৯৭১ এ অসহযোগ অন্দোলন চলাকালে তাঁর লেখা গন সংগীত ‘সংগ্রাম, সংগ্রাম, সংগ্রাম চলবে, দিন রাত অবিরাম’ গানটি তৎকালীন টেলিভিশন প্রচার করে।

ফজল-এ-খোদা’র কালজয়ী অনেকগুলো গান এখনো মানুষকে আন্দোলিত করে। ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মুল্য কত আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী’, বাসন্তী রং শাড়ী পড়ে কোন বঁধুয়া চলে যায়’, আমি প্রদীপের মত রাত জেগে জেগে’, ‘প্রেমের এক নাম জীবন’, ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো, পথের ধুলোয় লুটোবে’ ইত্যাদি অজস্র গানের রচয়িতা ফজল-এ-খোদার গানগুলো প্রয়াত বশীর আহমেদ, আবদুল জাব্বার, মোহাম্মদ আলী সিদ্দিকী, রথিন্দ্রনাথ রায়ের মতো কিংবদন্তি শিল্পীদের কন্ঠে দর্শক শ্রোতাদের কাছে পৌঁছেছে।

আজাদ রহমান, আবদুল আহাদ, ধীর আলী, সুবল দাস, ্কমল দাশ গুপ্ত, আবেদ হোসেন খান, অজিত রায়, দেবু ভট্টাচার্য, সত্য সাহা প্রমুখের মত সঙ্গীতজ্ঞ ফজল-এ-খোদা’র গানগুলোতে সুর করেছেন।

মুলত ছড়া দিয়ে তার লেখালেখি শুরু। তার ছড়াগ্রন্থের সংখ্যা ১০ টি আর কবিতা গ্রন্থ ৫ টি। এছাড়াও গান, নাটক, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য ইত্যাদি নিয়ে তার সর্বমোট বইয়ের সংখ্যা ৩৩টি। এ ছাড়াও সত্তর দশকে শিশু কিশোরদের মাসিক পত্রিকা ‘শাপলা শালুক’ ফজল-এ-খোদা’র নিপুন সম্পদনায় প্রকাশিত হতো।

১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্বপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার শিকার হলে ফজল-এ-খোদা তাঁর দুঃখ এবং ক্ষোভ গানের মাধ্যমে প্রকাশ করেন যা সেই সময়ে্র কল্পনাতীত ঘটনা। বশীর আহমদের সুরারোপে মোহাম্মদ আবদুল জাব্বারের গাওয়া ফজল-এ-খোদা’র সেই গানটি ছিলো ‘ভাবনা আমার আহত পাখির মতো/ পথের ধুলোয় লুটোবে / সাত রঙে রাঙা স্বপ্ন-বিহংগ / সহসা পাখনা লুটোবে/ এমন তো কথা ছিলো না’। গানটি ১৯৭৬ সালে রেকর্ড ও  বেতারে প্রচারিত হয়।

ফজল-এ-খোদা’র লেখা এবং মোহাম্মদ আবদুল জব্বারের সুরারোপ করা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি ২০০৬ সালে বিবিসি’র সর্বকালের সর্বশ্রেচঠ বাংলা গানের সেরা ২০ টি গানের তালিকায় ১২ তম (দ্বাদশ) স্থান পায়।

১৯৬০ দশক থেকে শুরু করে ২০১৫ সাল পর্যন্ত প্রায় ৫০ বছর ফজল-এ-খোদা  অসংখ্য দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোক সংগীত, ইসলামী গান লিখেছেন।

৮০ উত্তীর্ন গুণী এই মানুষটি দীর্ঘদিন ধরে ডায়াবেটিক এবং কিডনি রোগ ছাড়াও জটিল ডিমেন্সিয়া রোগে ভুগছিলেন তার মোহাম্মদ পুর বাবর রোডের বাসায়।

টেলিভিশন এবং সংবাদ মাধ্যমগুলো’র অনেকেই তাঁর বর্তমান অবস্থার খবর জানতেন না। গত ৯ মার্চ ২০২১ ফজল-এ -খোদার ৮০ তম জন্মদিন উপলক্ষে একুশে টিভি অন লাইনে লেখা প্রকাশিত হলে কেবল একটি বেসরকারি চ্যানেল তার উপর প্রতিবেদন প্রচার করে।  

সর্বকালের সেরা ২০ টি গানের তালিকায় স্থান পাওয়া ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা বেচে থাকা অবস্থায় কোন জাতীয় কিংবা রাস্ট্রীয় পুরস্কার পান নি যা খুবই বেদনাদায়ক। 

কবি,সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবীদের মৃত্যুর পর এবং দাফনের আগে সাধারণত শহীদ মিনারে শ্রদ্ধা জানানো'র রীতি। সালাম সালাম হাজার সালাম গানের গীতিকার সেই সামান্য সন্মান থেকেও বঞ্চিত হলেন। একেবারে নীরবেই তিনি পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন
বাবা মুহাম্মদ খোদা বক্স এবং মা মোসাম্মাৎ জয়নবুন্নেছা’র ঘরে জন্ম নেয়া তাদের ১ম সন ফজল-এ-খোদা'র বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি।

-মোহাম্মদ মাসুদ খান, লেখক ও সংগঠক
ই মেইলঃ masoodsupti@gmail.com

আরকে//