ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

করোনারি হৃদরোগ : প্রাথমিক ধারণা

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৫:৩৯ পিএম, ৯ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

হৃৎপিন্ডের অনেক ধরনের রোগ হয়ে থাকে। এর মধ্যে বর্তমানে সারা পৃথিবীতে যে রোগটি সর্বাধিক দুর্ভাবনার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটি করোনারি আর্টারি ডিজিজ(Coronary artery disease) বা করোনারি হৃদরোগ। আর এ রোগ প্রতিরোধ ও নিরাময় করতে হলে এ সম্পর্কে একটি স্বচ্ছ ধারণা থাকা প্রয়োজন।

ক্রমাগত ভুল জীবনযাপনের ফলে করোনারি ধমনীর ভেতরের দেয়ালে কোলেস্টেরল প্লাক বা হলুদ চর্বির আস্তর জমে। এতে রক্ত চলাচল ব্যাহত হয়। হৃৎপিন্ডের কোষ- গুলোতে রক্তের মাধ্যমে প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি পৌঁছাতে পারে না। ফলে রোগী একসময় বুকে ব্যথা অনুভব করেন। রক্ত চলাচল কমে গিয়ে এ সমস্যাটি দেখা দেয় বলে একে   ইস্কিমিক হার্ট ডিজিজও (Ischaemic heart disease) বলা হয়।

সাধারণত কিছুদূর হাঁটলে কিংবা ভারী কাজ বা সিঁড়িতে ওঠানামার মতো পরিশ্রম করলে বুকে ব্যথা অনুভূত হয়।
রাতের ভারী খাবারের পর কিংবা অতিরিক্ত ঠান্ডাতেও ব্যথা হতে পারে।
রোগী কোনো কারণে তীব্র মানসিক চাপ বোধ করলেও -এ ব্যথা শুরু হতে পারে।
সাধারণত বিশ্রাম নিলে বা জিহ্বার নিচে নাইট্রেট জাতীয় ওষুধ নিলে ব্যথা কমে আসে।

করোনারি হৃদরোগজনিত এ ব্যথাটি চিকিৎসাশাস্ত্রে এনজাইনা (Angina) নামে পরিচিত। অধিকাংশ রোগীই এসময় বুকের মধ্যে ব্যথা, ভার ভার বা এক ধরনের চাপ অনুভব করেন। মূলত বুকের বাম দিকে বা বুকের মধ্যখানে এই ব্যথা অনুভূত হয়। কখনো কখনো শ্বাসকষ্টও অনুভব হতে পারে। বুকের এই ব্যথা সাধারণত গলা, বাম চোয়াল, ঘাড়, কাঁধ, ওপরের পিঠ, বাম শোল্ডার জয়েন্ট, বাম বাহু ও হাত হয়ে অনামিকা ও কনিষ্ঠা আঙুল পর্যন্ত ছড়িয়ে যেতে পারে।

এ-ছাড়াও হৃদরোগের ব্যথা ওপর পেট, থুতনি, বুকের ডান পাশ, পিঠ এমনকি ডান হাতেও যেতে পারে। করোনারি হৃদরোগের ব্যথা শুধু ওপরের পেটে হলে তা হতে পারে সবচেয়ে বিপজ্জনক। কেন?

আপনি হয়তো রাতে ভূরিভোজ করেছেন। মাঝরাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বুক জ্বলছে। সেইসাথে ওপরের পেটে একটা অস্বস্তি। স্বাভাবিকভাবেই মনে হবে রাতে গুরুপাক খেয়েছি, তাই হয়তো এসিডিটি হয়েছে। বাড়িতে এন্টাসিড থাকলে খেয়ে নিলেন একটা। তারপরও অস্বস্তি কমছে না দেখে ওমিপ্রাজল জাতীয় ওষুধও হয়তো খেয়ে নিলেন। তবুও কমছে না; বরং কিছুটা যেন বাড়ছে। ফোন করলেন আপনার ডাক্তার বন্ধুকে।

আপনার বর্ণনা শুনে ডাক্তারেরও প্রথমেই মনে হতে পারে—রাতের গুরুপাক খাবারই এর কারণ। অতএব এটা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা। ফলে আপনার আর হাসপাতালে যাওয়া হলো না। সকাল হওয়ার আগেই দেখা গেল আপনার হার্ট অ্যাটাক হয়েছে। ততক্ষণে অনেক দেরি হয়ে গেছে। কখনো কখনো হার্ট অ্যাটাকের অন্যতম চিত্র এটি। অর্থাৎ ওপরের পেটে ব্যথার লক্ষণ নিয়ে হার্ট অ্যাটাক হতে যাচ্ছে কিন্তু আপনি মনে করছেন এসিডিটি বা গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা।

আবার এমনও নয় যে, হৃদরোগ হলে সবসময় আপনার ব্যথা হবে। কারো করোনারি ধমনীতে হয়তো ৭০%, ৮০% বা ৯০% ব্লকেজ, কিন্তু কখনোই ব্যথা অনুভব করেন নি। তিনি হয়তো প্রথমবারের মতো ব্যথা অনুভব করেন, যেদিন তার হার্ট অ্যাটাক হয়। এ-ছাড়াও ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময়ই ব্যথা অনুভ‚ত হয় না। অতএব করোনারি হৃদরোগ হলেই যে ব্যথা হবে এমন কোনো কথা নেই। আবার ব্যথা নেই মানেই যে হৃদরোগ নেই—সবসময় জোর দিয়ে বলা যায় না।

আবার কেউ হয়তো রাতে ঘুমের মধ্যে স্বপ্ন দেখছেন—এক কোটি টাকা যে শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করেছিলেন সেটা মার খেয়েছে। কিংবা ব্যাংক থেকে মোটা অঙ্কের লোন করেছিলেন, শোধ করতে পারছেন না বলে ব্যাংক এখন মামলা করে দিয়েছে। পুলিশ ধরতে আসছে, তিনি পালাচ্ছেন। এমন সব দুঃস্বপ্ন দেখার সময় ঘুমের মধ্যেই হার্ট অ্যাটাক হয়ে যেতে পারে। কিংবা তীব্র ব্যথায় ঘুম ভেঙে যেতে পারে। রাতে ঘুমের মধ্যে হয় বলে এমন ব্যথার নাম নক্‌চারনাল এনজাইনা (Nocturnal angina) |  

করোনারি হৃদরোগ: প্রকার ও ধরন
করোনারি হৃদরোগ মূলত দুধরনের : এনজাইনা পেকটোরিস (Angina Pectoris) ও মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন (Myocardial Infarction)।

করোনারি ধমনীতে চর্বি জমে ব্লকেজ সৃষ্টি হতে শুরু করলে এর মধ্য দিয়ে রক্ত চলাচল কমে আসে। যার ফলে হৃৎপিন্ডের সংশ্লিষ্ট অংশে পর্যাপ্ত  রক্ত সরবরাহ হতে পারে না। হৃৎপিন্ডের  কোষগুলো বঞ্চিত হয় প্রয়োজনীয় অক্সিজেন ও পুষ্টি থেকে। তখন বুকে ব্যথা হতে শুরু করে। এটাই  এনজাইনা পেকটোরিস।

আর এই ব্লকেজের পরিমাণ যদি বাড়তে বাড়তে শতভাগ হয়ে যায় এবং ধমনী-পথে রক্ত চলাচল পুরোপুরি বন্ধ হয়ে আসে, তখনই ঘটে হার্ট অ্যাটাক। আবার ৫০%, ৬০% বা ৭০% ব্লকেজও হঠাৎ ফেটে (Burst)  রক্ত ও চর্বির দলা বেরিয়ে এসে পুরো ধমনীকে ব্লক করে ফেললে হতে পারে হার্ট অ্যাটাক। 

চিকিৎসা পরিভাষায় যা মায়োকার্ডিয়াল ইনফার্কশন নামে পরিচিত। রোগী এসময় বুকে তীব্র ও অসহনীয় ব্যথা অনুভব করেন। ব্যথা কখনো কখনো বুক, গলা, ঘাড়, ওপরের পেট, দুই হাত এবং পিঠেও চলে যেতে পারে। সাথে শ্বাসকষ্ট, বমি বমি ভাব বা বমি হতে পারে। রোগী ক্রমশ নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং জরুরি চিকিৎসা দিতে ব্যর্থ হলে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া হয়েছে। 

আরকে//