একটি অন্যরকম থ্যাংকস গিভিং
নাসিম হোসেন
প্রকাশিত : ০৮:৩৭ পিএম, ১৩ জুলাই ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ০৩:৫১ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
পাহাড়ি ছোট্ট বালিকা মুন্নির সঙ্গে লেখক
২০০৪ সালের ৪ঠা অক্টোবর। শরতের মেঘগুলো নানা আকৃতি ধারণ করে দূর পাহাড়ের চূড়াগুলো ছুঁয়ে ছুঁয়ে যাচ্ছে। ভাইবোনছড়া ক্যাম্পের গোলঘরে বসে উপরে মেঘের খেলা আর নীচে চেঙ্গী নদীর অগভীর পানি ভেঙ্গে গরুর পালের পাড় হওয়া দেখছিলাম। আট-নয় বছরের রাখাল ছেলের সেকি দুর্দান্ত গর্জন - খিস্তী ‘মগোদা গরু, বো বো, সিদু ন জেই’।
শপাং শপাং আওয়াজ তুলে বাশেঁর চিকন শাখার আঘাতে নিজের কমান্ড কন্ট্রোল প্রতিষ্ঠার নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।
বিষয়টায় খুব মজা পাচ্ছিলাম-কারণ ও এতোই ছোট যে গরুর পালের মাঝখানে ওকে দেখাই যাচ্ছিলো না।
সেই একাদশ শ্রেণিতে পড়া ইংরেজি গল্পের ছোট্ট বালক জেরীর কথোপকথন মনে পড়লো। লেখিকা তার বাড়িতে কাঠ চিড়তে আসা বালকের ছোট্ট গড়নের দিকে ইংগিত করলে উত্তরে সে বলেছিলো, ‘Size doesn't matter in chopping wood; some big boys don't chop well’.
এ যেন আরেক পাহাড়ি জেরী। এখানে তার হাতে কুঠারের পরিবর্তে বাশেঁর চিকন শাখা। গরুর পাল ঠেলতে দৈহিক গড়ন কোন বিষয় নয়- নিজের আত্মবিশ্বাস আর এটিচিউডই মূল বিষয়।
হাতি বিশাল দৈহিক আকৃতির হলেও রাগী এটিচিউডের (মেজাজের) কারণে সিংহকে সে মানে বনের রাজা হিসাবে।
সিংহ হাতিকে বোঝাতে পারে – ‘It can be his meal’
আমার এসব বিক্ষিপ্ত ভাবনায় ছেদ পড়ে সিগনালম্যানের ডাকে।
-স্যার একটা জরুরি ম্যাসেজ আছে।
ওর হাত থেকে লগ বইটা নিয়ে পড়তে গিয়ে নড়ে চড়ে বসলাম।
বান্দরবনে আমাদের একটি ইউনিটের এক কর্পোরাল রহস্যজনকভাবে দুষ্কৃতিকারীদের হাতে নিহত হয়েছে এবং তার অস্ত্রটিও বেহাত হয়ে গেছে।
সব ব্রিগেড থেকে ২০ টির মতো ‘এ’ টাইপ পেট্রোলের এক সম্মিলিত দলের মিশন হবে সেই খোয়া যাওয়া একে-৪৭ উদ্ধার। একে-৪৭ এর মধ্যে মিশে গেছে সেনাবাহিনীর সম্মান।
জিওসি (IKB)’র নির্দেশ, ‘No return to the base, until you get back that weapon’.
খাগড়াছড়ি ব্রিগেড দলের আমিই কমান্ডার - সকালে ব্রিগেড সদরে সমাবেশ - চট্রগ্রামে রাত্রিবাস- পরদিন বান্দরবনে যাত্রা। মোটা দাগে এই হলো আদেশ।
হঠাৎ করে দূরের সেই রাখাল বালকের বাশেঁর কঞ্চির আঘাত যেন নিজের পিঠে অনুভব করতে লাগলাম- বোধটা অপমানের-সেনাবাহিনীর অস্ত্র কেড়ে নিবে!?
আমার ইউনিট মাইটি সিক্সার্সে রাতভর প্রস্ততি চললো বিভিন্ন ক্যাম্প থেকে জনবল জোন সদরে সন্নিবেশ করার।
রাতে নানাবিধ উত্তেজনার মধ্যে আরো বিশদ একটু জানা গেল। বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের কঠিন চীবরদান উপলক্ষ্যে আয়োজিত মেলা এবং গানবাজনার অনুষ্ঠানে নিরাপত্তার কাজে নিয়োজিত টহল দলের ঐ কর্পোরাল রহস্যজনকভাবে দল থেকে আলাদা হয়ে পড়ায় কয়েকজন দূর্বৃত্তের অতর্কিত আক্রমণের শিকার হয়। ধস্তাধস্তির এক পর্যায়ে অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ হারায়- নিজ অস্ত্রের গুলিতেই প্রাণ হারায় সে।
মেলার কোলাহল মাইকের তীব্র শব্দ আর নানারকম আতসবাজির শব্দে কর্পোরালের প্রাণসংহারী বুলেটের শব্দও মিশে একাকার হওয়ায় সংগীতানুষ্ঠানের প্রধান অতিথির আসনে অধিষ্ঠিত পেট্রোল কমান্ডার ছিলেন বেখবর।
পেট্রোল লীডারের কানে যখন খবর পৌঁছায় ততক্ষণে কর্পোরালের শরীর থেকে প্রচুর রক্ত বের হয়ে গেছে- তার নিথর শরীর থেকে খুলে নিয়ে গেছে তার সম্মান- আর ইজ্জতের প্রতীক তার অস্ত্র এবং ম্যাগাজিনের বান্ডুলিয়ারটি। সম্মানহীন এক সৈনিকের মৃতদেহ কাধেঁ করে ফেরেন পেট্রোলের অধিনায়ক।
রাতে সেই প্রাণহীন সৈনিকের মুখের চিত্রটা মনে মনে আকঁতে আকঁতে ঘুমিয়ে পড়ি।
চট্টগ্রাম থেকে যাত্রার ক্ষণটি শুভ হলো না। নানাবিধ কারনে যাত্রা শুরুতে বিলম্ব হওয়ায় কর্নেল স্টাফের ক্ষোভ ঘনিভূত হলো আমার উপর। মনে করিয়ে দিলেনঃ ‘ফিরে এসো দেখে নেবো’ (I will see the last of it)
শহরকে প্রকম্পিত করে দীর্ঘ সামরিক কনভয়টি কয়েকটি ধাপে ধাপে প্রবেশ করলো। এ শহরের মানুষতো সেই কতকাল থেকে সামরিক এসব যজ্ঞ দেখে এসেছে। তারাও এবার কনভয়ের বিশালতা দেখে উৎকণ্ঠিত হলোঃ ব্যাপারটা কি!
ব্রিগেড সদরের সুসজ্জিত অপস্ রুমের বিশালাকার ম্যাপ বোর্ডের উপর দীর্ঘাকায় সৌম্য দর্শন কমান্ডার সংক্ষেপে নিজের স্বাগত ভাষণ দিয়ে অপারেশন ব্রিফিং এর সূচনা করলেন।
ঝকঝকে নতুন টালক পেপারে লাল নীল রেখা চিত্রে শত্রুর সম্ভাব্য অবস্থান, চলাচলের রাস্তা, নিজ নিজ দলের আভিযানিক সীমানা, তল্লাশীর লক্ষ্যবস্তুর নিখুঁত চিত্র বেশ বোধগম্যভাবেই বিধৃত করা হয়েছেঃ কর্ডন এন্ড সার্চ টাইপের অপারেশন।
প্রায় বিশটি টহলদলের সমন্বয়ে চিরুনি অভিযান। মানচিত্রের উপরে এক নিখুঁত পরিকল্পনা। মানচিত্রের রেখাচিত্রের ফাঁক গলে শত্রুর পালিয়ে যাওয়ার কোন সম্ভাবনা তাত্ত্বিকভাবে নেই। তবে বাস্তবতা আর তাত্ত্বিকতার মাঝের ফারাকটুকু যে বান্দরবনের বিশাল উঁচু পাহাড়গুলোর মতো তা আমরা কয়েক ঘণ্টা পরই টের পেতে শুরু করি।
কয়েকজন পোর্টারের উপর সাতদিনের রশদ চাপিয়ে এক তাবলীগী মিশনে বের হয়ে গেলাম বাগমারা ইউনিয়ন এবং ৩ নং রাবার বাগান সংলগ্ন এলাকায়। বাগমারাই হলো সংঘাতের এপিক সেন্টার।
শুকনো রেশন স্থানে স্থানে হেলিকপ্টারে সরবরাহ করা হবে বাকীটা ‘লিভ অফ দ্যা ল্যান্ড’।
টহল দলগুলো চক্রাকারে তার নিজ নিজ সন্দেহভাজন এলাকায় তল্লাশীর কাজ করবে।
একটি দলের পিছে পিছে আরেকটি দল যাবে যেন লুকিয়ে থাকা শত্রু একটি টহলকে ফাঁকি দিলেও অনুসরণরত পরবর্তী দলের সামনে পড়ে। আমাদের শত্রু র সুনির্দিষ্ট পরিচয় পাওয়া না গেলেও সন্দেহের তীরটি ছিলো আরাকান আর্মির কোন দলছুট গ্রুপের দিকে।
শুরু হলো চিরুনি অভিযান- এ যেন খড়ের গাদায় হারানো সূচঁ খোজা। এক পাড়া থেকে আরেক পাড়ায় গমন- পাড়ার লোকদের দৈনন্দিন জীবনকে ব্যাহত না করে মনে মনে কাল্পনিক শত্রুর অবয়ব খুজেঁ ফেরা।
সন্ধ্যায় কোন পাড়ার আশে পাশে বা খালি জুমঘরে বা স্কুলে রাত্রিযাপন। দিনে ছড়ার পানিতে গোসল রাতে চালের পোটলাকে বালিশ বানিয়ে ঘুম। সারাদিনের হাটাহাটিঁর পর ক্লান্ত শরীর পরিত্যক্ত জুম ঘরের বাশের তরজার উপর বিছানাকে পৃথিবীর যে কোন পাচঁ তারকা হোটেলের বিছানার চেয়েও আরামদায়ক মনে হতো। খাবারের মেনু খুবই উন্নত(!)। কখনো পেঁপে ভর্তা কখনো বয়ে আনা শুটকির কোন রেসিপি সঙ্গে সাদা ভাত নয়তো খিচুড়ি।
যদি কোন পাহাড়ি মুরগি বিক্রি করতে চাইতো তবে তো কথাই নেই-যেন ঈদুল আযহা। কিন্তু আগে কোন পেট্রোল যে পথ দিয়ে যেত তারা যে পরিমান সওদা করতো তাতে পরের পেট্রোল আর কিছুই পেত না।
দু'সপ্তাহ পর্যন্ত চললো দিনে রাতে সন্দেহজনক জায়গায় তল্লাশী, এম্বুশ-কিছুই না করতে পেরে হতাশ। এরই মাঝে একদিন সকালে আদেশ পেলাম হেলিপ্যাড তৈরি করতে জিওসি আসবেন আমার পেট্রোল পার্টির সঙ্গে দেখা করতে।
আমাদের অবস্হান তখন ৩নং রাবার বাগানের ভিতর বুড়িপাড়াতে। ত্রিপুরা অধ্যূষিত পাড়ার দক্ষিণে একটা স্কুলঘরে।
পাড়া থেকে বেশ উত্তরে একটি জুম টিলার মাথাকে রেকি করে বের করলাম হেলিপ্যাড হিসাবে। দু' দিক থেকেই এপ্রোচ করা নিরাপদ। নাট্যকার আবুল হায়াতের মাথার মতোই ওটাকে চকচকে করে ফেলা হলো। একটা বড়সর 'H' আঁকা হলো মাঝখানে।
ত্রিপুরা অধ্যূষিত পাড়ার একটা স্কুলঘরে শিশুদের সঙ্গে লেখক
পরদিন সকাল এগারোটায় দূরে হেলিকপ্টারের পাখার ‘দপ দপ দপ’ আওয়াজ ক্ষীণ থেকে তীব্র হওয়ার মধ্য দিয়ে জিওসির আগমনি ধ্বনি শোনা গেল। অতঃপর তীব্র এক ধূলিঝড় উড়িয়ে বেল-২১২ থেকে উনি অবতরণ করলেন।
ধূলোর পর্দা সরে গেলে টিলার ঢাল থেকে আমরাও মাথা উঁচু করলাম।
করমর্দন শেষে উনি জানতে চাইলেন আমার হেলিপ্যাড সিকিউরিটি টীম কোথায়? এইরকম একটা প্রশ্নের পূর্ব প্রস্ততি নেওয়াই ছিলো: এপাশ থেকে ফিল্ড সিগনাল দেখে সিকিউরিটি-১ বাঁশের আগায় লাগানো সাদা পতাকা তুলে অবস্হান দেখালো।
জিওসির পরবর্তী আগ্রহ গত দু’সপ্তাহে কি করেছি।
কিছু কেতাবি প্রশ্ন-সৈনিকদের মোরাল কেমন? কেমন করে অস্ত্র উদ্ধার হবে? কেমন করে সেফটি সিকিউরিটি নিশ্চিত করতে হবে? শত্রুর চলাচলের রাস্তা কোথায়?
‘How many days you can sustain in this way?’ - জিওসি আমাদের মানসিক শক্তি কতটুকু জানতে চাইলেন।
‘As long as you want’- আমার উত্তর।
পাশে দাঁড়ানো সৈনিকদের দিকে তাকিয়ে জানতে চাইলেন, ‘কি তোমাদের কষ্ট হচ্ছে?
যেন মালদ্বীপের কোন রিসোর্টে অবকাশে আছে এমন জোশে জবাব দিলো, ‘না স্যার কোন কষ্ট নাই’।
তারপর হেলিপ্যাডটার চারিদিকে চোখ ঘুরিয়ে জানতে চাইলেন,
-How long did you take to prepare this helipad?
-Only three hours, sir.
ঝাড়া একটা চাপা মেরে দিলাম। মনে মনে বলি এই হেলিপ্যাড তো পাহাড়ি-বাঙ্গালি যৌথ প্রযোজনায় তৈরি।
যাই হোক ১০ মিনিটের একটা এক্সক্লুসিভ ভিজিট করে সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে হেলিকপ্টারের দিকে এগিয়ে যেতেই এডিসির ইশারায় একজন সৈনিক ভিজিটের তোফা দুটো বড় মিষ্টির প্যাকেট হাত বদল করে নিলো।
চপারের পেটের ভিতর নিজেকে সপে দিতে দিতে পুনরায় অস্ত্র উদ্ধারের মিশনের কথা মনে করিয়ে দিলেন।
জিওসির উর্ধাকাশে মিলিয়ে যেতে মনে হলো আমার সেক্টর থেকে ঐ হারানো অস্ত্র উদ্ধারের সম্ভাবনা অনেকটা ত্রিশজন অশ্বারোহী নিয়ে আফগানিস্তানের Tora Bora রেন্জে ওসামা বিন লাদেনকে খোঁজার সামিল।
জিওসির বডি ল্যাংগুয়েজ দেখে মনে হলো আমরা শুধু শুধু বনে বাদাড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি-তাই মনটা ঈষৎ
বিষণ্ণতায় ডুবে গেল।
আজ দু'সপ্তাহ পার হতে চললো নিজ ব্রিগেড ছেড়ে অন্য এলাকায় ভাড়া খাটছি। অস্ত্র হারানো সম্পূর্ণ কমান্ড ফেইলারের জন্য ঘটেছে- এতদিনে আমাদের এই উপলব্ধি হয়েছে। এতে স্থানীয় জনগণের তো কোন সম্পৃক্ততা নাই, এখন রাত-বিরাতে এদের বাড়ির বাক্স-পেটরা উল্টে অস্ত্র খুজঁলে পূর্বের করা সকল ভালো আমল নষ্ট হবে।
এরা মুখের উপর কিছু হয়তো বলবে না, কিন্তু মধ্যরাতে ঘুম জাগা শিশুর মনে যে ছাপ রেখে যাবে তা ঐ অস্ত্রের হারানো মূল্যের চেয়ে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। রাতে বাড়ির আঙ্গিনায় উর্দি পরা কোন সেনাকেই কোন দেশের শিশুই সহজভাবে নেয় না।
বুড়িপাড়া দিয়ে নিজেদের আস্তানায় যেতে বেশ কিছু ত্রিপুরা শিশুদের খেলা করতে দেখে একটু বিরতি দিলাম। জিওসির কাছ থেকে পাওয়া তোফা বিলিয়ে দিলাম। বাঙ্গালি মিঠাই পেয়ে দারুণ খুশি।
বাঙ্গালি মিঠাই পেয়ে দারুণ খুশি শিশুরা
তখনি চোখে পড়লো মুন্নীর দিকে। মায়ের কোলে বসা ফর্সা ফুটফুটে বছর পাঁচেকের এক কন্যা শিশু। মাথার চুল উসখুসে ঠোটগুলো কালচে লাল। মায়ের কোলে বসে সতীর্থদের খেলা দেখছিলো।
বাঁশের চকচকে মাচার উপর বসেছিলো ওর মা। ওর দিকে এগিয়ে গিয়ে নিজের যৎ সামান্য জানা ত্রিপুরা ভাষা প্রয়োগ করি:
‘গাম কুরুন্দে’-কেমন আছো?
‘নিনি মুং তামা’-তোমার নাম কি?
‘নুং তামা খাই দং’- তোমার কি হয়েছে?
ও আমার মুখে এরকম প্রশ্নে অবাক হয়ে মায়ের বুকের আরো গভীরে মুখ লুকায়।
ওর মা জানালো আজ তিন চার দিন ওর জ্বর। গ্রামের বৈদ্য (কবিরাজ) দেখিয়েছে, জ্বর কমার লক্ষণ নেই।
‘নিনি অরো বিথি দই তং’-তোমার কাছে ঔষধ আছে? - মায়ের উদ্বিগ্নতা চোখে মুখে। গেল বছরই দেড় বছরের শিশুপুত্রকে হারিয়েছে হামে।
আজ চৌদ্দ পনের দিন পাহাড়ের বন- বাদারে ঘুরে ঐ বয়সী আমার ছোট ছেলেটার চেহারাটাই ভুলতে বসেছি। হঠাৎ মনে হলো আমার ছেলেটাই বুঝি আজ আমাকে খুঁজতে এই পাহাড়েই চলে এসেছে।
মেয়েটার নাম মুন্নী। কপালে হাত দিয়ে দেখলাম বেশ জ্বর।
মেডিকেল সহকারী জ্বর মেপে জানালো ১০৩ ডিগ্রি। মুন্নীকে ওয়াটার স্পন্জিং করা হলো। ঔষধ দেওয়া হলো। কিন্তু মেডিকেল সহকারী বললো, স্যার ট্যাবলেট খেতে পারবে না। ওর জন্য চাই সিরাপ। সিরাপ তো আমাদের নাই।
আরএমও ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীরের টেলিমেডিসিন দিয়ে চিকিৎসা চললো। বাশঁ কাঠ নিতে আসা চান্দের গাড়িতে সিরাপ পাঠানোর প্রতিশ্রুতি পাই।
পেট্রোলের সকলের আদরের কেন্দ্র বিন্দুতে পরিনত হলো মুন্নী। জীবনরক্ষাকারী বিস্কুটে ভরে উঠলো ওর দু'হাত। পরদিন মুন্নীর বাবার কাছে সিরাপসহ বেশ কিছু ঔষধ আর পথ্য দিয়ে আমরা পরবর্তী গন্তব্যে যাত্রা করি।
অপারেশনের শেষ ধাপে পৌছেঁ গেছি। বান্দরবন সদরের পাশে কুহালং ইউনিয়নের একটি স্কুলে রাত্রিযাপনের পর প্রস্ততি নিচ্ছি বান্দরবন ছেড়ে যাবার। সদরে রাত্রিযাপনের পর পরদিন চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা। অপারেশন কলড আপ, খালি হাতে ফিরতে হচ্ছে।
সকালে খাগড়াছড়ির অন্যান্য পেট্রোলের এক সঙ্গে জড়ো হওয়ার অপেক্ষায় আছি। এমন সময় দেখলাম প্রহরীকে অনুসরণ করে সেই বুড়িপাড়ার জ্বরে ভোগা মুন্নী আসছে ওর বাবার কাধেঁ চড়ে।
কাধেঁর এক পাশে পা দু'দিকে দুলিয়ে বসে আছে। এক হাত দিয়ে বাবার গলা পেচিয়ে ভারসাম্য রক্ষা করছে আরেক হাতে পাতায় মোড়ানো কিছু একটা হবে।
‘স্যার, আপনাকে আগের জায়গায় না পেয়ে মানুষজনকে জিজ্ঞাসা করে এখানে আপনাকে পেলাম।
আমার মেয়ে আপনার জন্য পিঠা বানিয়েছে, আপনাকে দেবে বলে আব্দার করায় এখানে আনতে হলো।’
এক নিঃশ্বাসে কথাগুলো বলে মুন্নীকে কাধঁ থেকে নামালো।
বাবার কাধেঁর এক পাশে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে মুন্নী, জ্বরের ধকলটা ভালোই সয়েছে সে। জড়তা যেন তার কাটছে না। নিজেকে ওর সামনে রবীন্দ্রনাথের কাবুলীওয়ালাই মনে হলো।
‘ক্যায়া মেওয়া লে আরা হ্যায় মুঝকো লিয়ে?’
ওর নিরবতা ভাঙ্গতে প্রশ্ন ছুড়ে দেই-
‘গাম কুরুন্দে?’-কেমন আছো?
‘নিনি তামা বাই চাখা- আজ কি দিয়ে ভাত খেয়েছো?’
লজ্জায় মুখটা বাবার মাথার সঙ্গে ঠেকিয়ে হাতটা আমার দিকে বাড়িয়ে দেয়-সবুজ পাতায় মোড়ানো একটা প্যাকেট।
জ্বর থেকে একটু ভালো হতেই মাকে পিঠা বানিয়ে দেওয়ার আব্দার করে মুন্নী। সদ্য জুম থেকে পাওয়া চালের গুঁড়ো দিয়ে বানানো ‘মুঠি’ পিঠা। মাকে পিঠা বানাতে দেখে ছোট্ট হাতে নিজেও কিছু মুঠি পিঠা তৈরি করে।
তারপর ‘আর্মি’ ততই (কাকা)দের দেবে বলে আমরা যেখানটায় ছিলাম সেখানে না পেয়ে প্রায় দু’ঘণ্টা পথ পায়ে হেটেঁ এখানে এসেছে। বেঁচে থাকা একমাত্র কন্যা সন্তানের আব্দার রাখতে পথ হাটার কোন কষ্টকেই আমলে নেয়নি মনিলাল ত্রিপুরা।
নিজের ফ্রকের কোনায় আঙ্গুল পেচাঁতে পেচাঁতে বাবার কথা শুনছিলো মুন্নী-গেল বছর হামে পড়ে দু’দিনের জ্বরে পৃথিবী ছেড়েছে তার ছোট ভাইটি।
ঝাড়-জংগলের এই বনভূমিতে পাহাড়ি কবিরাজ আর বৈদ্যই ভরসা।
আমাদের বদৌলতে ঔষধ মেলেছে তাই কৃতজ্ঞতার ঋণ শোধের এই ধারণা কেমন করে এই ছোট্ট মুন্নীর মাথায় এলো তা ভেবে আমি অবাক হয়ে যাই।
আগ্নেয়াস্ত্র, হেলমেট, বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট আবৃত সেনাদলের বাহ্যিক ভীতিটাকে সে শিশু সুলভ নিষ্পাপ ভালোবাসায় ঢেকে দিয়েছে।
‘আমার মেয়েকে আশীর্বাদ করবেন স্যার’-মনিলালের এমন আবেদনে তাড়িত হয়ে মুন্নীর মাথায় হাত রেখে বলি,
‘নুং আংবাই বাকসা থানাই দই’-তুমি যাবে আমার সাথে?
বাবার গলাটা আরো দৃঢ় ভাবে চেপে ধরে মুন্নী।
তিন সপ্তাহের একটি সার্চ মিশন এভাবেই শেষ করে বিশাল একটি কনভয় নিয়ে মেঘলা পর্যটনের উঁচু গিরিখাত পার হতে হতে ভাবছিলাম কি অর্জন করলাম একদিনে?
রণকৌশলের কেতাবী ভাষায়ঃ What is the end state?
থ্যাংকস গিভিং ডে এর উপর ভিত্তি করে শিল্পীর শিল্পকর্ম
নভেম্বরের শেষ সপ্তাহের ঈশ্বরকে ধন্যবাদ জানাতে নানারকম খাদ্য সামগ্রীর মেলা বসে মার্কিন সেনা ছাউনি গুলোতে। ‘থ্যাংকস গিভিং ডে’ নামে পরিচিত এ অনুষ্ঠানে রাষ্ট্রপতিরা উড়ে যান ইরাক আফগানিস্তানে নিয়োজিত সেনাসদস্যদের সঙ্গে মিলিত হতে।
ধূমায়িত টার্কি রোস্ট খেতে খেতে ধন্যবাদ জানান সেনা সদস্যদের পরিশ্রমের। আমাদের জন্য কেউ থ্যাংকস গিভিং এর পশরা সাজিয়ে বসে নেই।
আমাদের তিন সপ্তাহের অপারেশনের লক্ষ্য আপাত দৃষ্টিতে অর্জিত হয়নি।
একটি পাহাড়ি কন্যার ভালবাসার যে উপহার পেয়েছি তা কোন থ্যাংকস গিভিং ডে উপলক্ষ্যে রাষ্টপতির দেয়া টার্কি রোস্টের চেয়েও উত্তম।
অস্ত্র উদ্ধার হয়নি, ভালবাসা উদ্ধার হয়েছে-গাড়ির ড্যাশবোর্ডে রাখা মুন্নীর দেওয়া পিঠার প্যাকেটটির পাতার ভাজঁ খুলতে খুলতে নিজের মনেই বলে উঠি-
‘Mission Accomplished’.
পুনশ্চঃ বান্দরবনের রুমা থেকে অস্ত্রটি পরে আরেকটি দল উদ্ধার করেছিলো।
লেখক: অব. সামরিক কর্মকর্তা।