ইতিহাসের অংশ যে চিঠি
দুলাল আচার্য
প্রকাশিত : ০৫:১৯ পিএম, ১৬ জুলাই ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৫:২২ পিএম, ১৬ জুলাই ২০২১ শুক্রবার
প্রিয় দেশবাসী,
আমার সালাম নিবেন। আমাকে সরকার গ্রেফতার করে নিয়ে যাচ্ছে। কোথায় জানি না। আমি আপনাদের গণতান্ত্রিক অধিকার ও অর্থনৈতিক মুক্তির লক্ষ্যেই সারা জীবন সংগ্রাম করেছি। জীবনে কোন অন্যায় করিনি। তারপরও মিথ্যা মামলা দেয়া হয়েছে। উপরে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ও আপনারা দেশবাসী আপনাদের উপর আমার ভরসা।
আমার প্রিয় দেশবাসী, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের কাছে আবেদন, কখনও মনোবল হারাবেন না। অন্যায়ের প্রতিবাদ করবেন। যে যেভাবে আছেন অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবেন। মাথা নত করবেন না। সত্যের জয় হবেই। আমি আছি আপনাদের সাথে, আমৃত্যু থাকব। আমার ভাগ্যে যা-ই ঘটুক না কেন আপনারা বাংলার জনগণের অধিকার আদায়ের জন্য সংগ্রাম চালিয়ে যান। জয় জনগণের হবেই।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়বই। দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটাবই।
জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু
শেখ হাসিনা
১৬/০৭/২০০৭
সময়টা ১৬ জুলাই। ২০০৭। ১৪ বছর আগের কথা। এদিন ফখরুদ্দীন-মইন উ আহমেদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে জাতির উদ্দেশে তিনি একটি চিঠি লিখে যান, যা পরদিন জাতীয় দৈনিকগুলো ফলাও করে প্রকাশ করে। শেখ রেহানা প্রকাশিত ও সম্পাদিত সাপ্তাহিক বিচিত্রায় চাকরি করার সুবাদে এবং বেবী আপার (প্রয়াত সাংবাদিক বেবী মওদুদ) স্নেহধন্য হওয়ায় সেই স্মৃতিময় ঘটনায় নিজেকে সম্পৃক্ত করার সৌভাগ্য আমার হয়েছিল।
সেদিন ভোর ৬টায় রঞ্জন দার (বর্তমান একুশে টিভির বার্তা সম্পাদক) ফোনে আমার ঘুম ভাঙে। তিনি জানালেন, দুলাল আপাকে ( শেখ হাসিনা) গ্রেপ্তার করছে, টিভি খুলে দেখ। টিভিতে চোখ রাখতেই গ্রেপ্তারের প্রস্তুতি দেখে চমকে উঠি। অবশ্য এমন যে হবে, সরকারের কয়েকজন উপদেষ্টার ওই সময়ের বক্তব্যেই আশঙ্কা করা গেছে। তবে খালেদা জিয়ার আগে শেখ হাসিনা গ্রেপ্তার হবেন, তা অনেকেরই ধারণায় ছিল না।
সকাল ৯টা ৪৫ মিনিটে অফিসে পৌঁছি (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরের দুই বাড়ি আগে শুক্রাবাদ বাসস্ট্যান্ড)। টিভি রুমে দেখি বেবী আপা। সিএসবি চ্যানেলটি সরাসরি শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তার, আদালতে টেনে-হিঁচড়ে নেয়াসহ নানা দৃশ্য সম্প্রচার করছে। আমি পাশের একটি চেয়ারে বসি। আদালত এলাকায় গাড়ি থেকে নামানোর সময় টানা-হেঁচড়ার দৃশ্য টিভিতে দেখে বেবী আপা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে উঠলেন। তার দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে! তিনি ফুঁপিয়ে কাঁদছেন। কেমন যেন একটা শোকাবহ পরিবেশ। ঘণ্টাখানেক পর বেবী আপার মোবাইল ফোনে একটি কল এলো। কিছুক্ষণ পর তিনি কিছু না বলেই বের হয়ে গেলেন।
দুপুর ২টার পর পরই অফিস ফাঁকা হয়ে যায়। চারদিকে এক ধরনের নীরবতা ও ভীতিকর পরিস্থিতি। রাস্তায় লোকজন খুব কম। কেমন যেন থমথমে ভাব। ২টার আগেই অফিসের প্রায় সবাই চলে যায়। অফিসে ওয়ালিদ, মনির ও আমি। ওয়ালিদ (বিচিত্রার সার্কুলেশন ম্যানেজার) বলল, চল, সবাই চলে গেছে আমরাও যাই। বেবী আপা মনে হয় আজ আর আসবেন না। আমি বললাম, দাঁড়াও একটু অপেক্ষা করি। বিচিত্রার চাকরিজীবনের (১৯৯৮-২০০৭) প্রায় নয় বছরে একটি অভিজ্ঞতা হয়েছে। বেবী আপা অফিস থেকে যখনই বের হন না কেন, প্রায়দিনই অফিস বন্ধ হওয়ার আগে একবার আসেন। না এলে আগেই জানিয়ে দিতেন। বরাবরের মতো আমি আর মনির (অফিস সহকারী) অপেক্ষা করি।
বিকাল ৩টার কিছু বেশি হবে। বেবী আপা তার রুমে ঢুকেই মনিরকে (মনির বর্তমানে ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের অফিস সহকারী) ডাকলেন। ৪/৫ মিনিট পর আমি ইচ্ছা করেই আপার রুমে যাই। দরজায় দাঁড়িয়ে আছি, আপা বইয়ের সেলফ থেকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বই বের করছেন, কিছু বই ইতোমধ্যে টেবিলেও রেখেছেন। আমাকে দেখে বললেন, দুলাল মনির আসুক, তোমাকে প্রেস ক্লাব যেতে হবে। আমি দাঁড়িয়ে রইলাম, কিছু বললাম না। বুঝলাম আপার মনের অবস্থা ভালো না। আপা বললেন, তুমি এখন যাও, আমি ডাকব।
৫ মিনিট পর মনির এসে বলল, দুলাল ভাই ফুপু ডাকছেন (মনির বেবী আপাকে ফুপু বলে সম্বোধন করতেন)। আমি আপার রুমের দিকে এগোচ্ছি, পেছনে মনির। মনির বলল, দুলাল ভাই ‘জরুরি’ খবর আছে।
আমি রুমে ঢুকতেই বেবী আপা বললেন, এখানে ২০ কপি আছে, তুমি প্রেস ক্লাব গিয়ে আজাদের (বর্তমানে বাসসের এমডি, প্রধানমন্ত্রীর সাবেক প্রেস সেক্রেটারি) কাছে দেবে। আজাদকে তোমার কথা বলা আছে। প্যাকেটটি হাতে নিয়ে যাও। আমি বুঝতে পারলাম, এটা বড় আপার হাতের লেখা। কারণ, পাশেই মূল কপিটা রাখা ছিল। আমরা বিচিত্রায় যারা চাকরি করতাম, তারা সবাই শেখ হাসিনাকে (মাননীয় প্রধানমন্ত্রী) বড় আপা এবং রেহানা আপাকে ছোট আপা বলেই ডাকতাম। বিচিত্রায় চাকরি করার সুযোগে শেখ হাসিনার হাতের লেখার সঙ্গে আমার একটা পরিচয় রয়েছে। তার বেশির ভাগ লেখাই বিচিত্রায় কম্পোজ হতো এবং একপর্যায়ে সংশোধনের জন্য আমার কাছে আসত।
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কাজে কয়েকবার আমাকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফুলার রোডে ফকরুল আলম স্যারের বাসায় যেতে হয়েছে। বইটির বাংলা কম্পোজের পর ইংরেজি অনুবাদ করার জন্য স্যারের বাসায় বেবী আপা আমাকে পাঠাতেন। আমি অফিস ছুটির পর স্যারকে এগুলো পৌঁছে দিতাম এবং দু-একদিন পর ইংরেজি হয়ে গেলে নিয়ে আসতাম।
আমি আমার সিটে গিয়ে ব্যাগটি গুছিয়ে নিয়ে প্যাকেটটি ব্যাগের একটি ভাঁজে রাখলাম। ওয়ালিদকে বললাম উঠো। টেবিল ছেড়ে উঠতেই বেবী আপা ডাকলেন, দুলাল। আমি কাছে যেতেই ১০০ টাকার একটি নোট দিয়ে বললেন, তাড়াতাড়ি যাও, দেরি করো না। আর শোন, আজাদকে বলবা যারা আওয়ামী লীগ বিট করেন, তাদের ফোনে ডেকে হাতে হাতে দিতে। ঠিক আছে আপা, বলেই আমি বের হয়ে গেলাম। রাস্তায় নেমেই ওয়ালিদ বলল, আমি তোমার সঙ্গে নেই। আমি বুঝলাম এটি তার দুষ্টুমি। বেবী আপা আমাকে এর আগে যত দায়িত্বই দিয়েছেন, ওয়ালিদ কোনো না কোনোভাবে আমাকে সহায়তা করেছে।
আমরা মিরপুর থেকে আসা (৯ নম্বর) একটি লোকাল বাসে প্রথমে নিউমার্কেট যাই। নিউমার্কেটে গিয়ে বাস আর যাবে না। পরে নিউমার্কেট থেকে রিকশায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে প্রেস ক্লাব যাই। ওয়ালিদ প্রেস ক্লাবে না নেমে পল্টনে প্রেসে চলে যায়। প্রেস ক্লাব গেট থেকে আমি আজাদ ভাইকে ফোন দিই। তিনি বললেন, আমি ভেতরে। আমি ভেতরে ঢুকে দেখি আজাদ ভাই মাঠে পায়চারি করছেন। প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের সংখ্যাও আজ কম।
আজাদ ভাই আমাকে দেখে বললেন কই, দাও। প্যাকেটটি হাতে দিতেই তিনি কী যেন বলতে চাইলেন। আমি বললাম, ভাই বেবী আপা বলেছেন, আওয়ামী লীগ বিট যারা করেন তাদের ডেকে হাতে হাতে দিতে।
তিনি আমার দিকে তাকালেন। আজাদ ভাইয়ের সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত জানাশোনা মূলত বিচিত্রা অফিসেই। সম্ভবত ২০০২ সালে। তখন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার প্রেস উপদেষ্টা জাওয়াদুল করিম ভাই বিচিত্রা অফিসে (বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরসংলগ্ন বাড়ি) একটি কক্ষে বসতেন। সেখানে নেত্রীর প্রেস-সংক্রান্ত কাজ চলত। শোকবাণী, বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক দিবসের বাণী- সবই তখন এখান থেকে দেয়া হতো।
জাওয়াদুল করিম ভাইকে সহায়তার জন্য একসময় আসলাম সানী ভাইকে নিয়োগ দেয়া হয়। বেবী আপার নির্দেশে আমিও জাওয়াদ ভাইকে সহায়তা করতাম। আজাদ ভাই আসার আগে এখানে কিছুদিন কাজ করেছিলেন পিআইডির সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা হারুন-উর-রশিদ ভাই (সদ্যপ্রয়াত)। আজাদ ভাই আসার পর হারুন ভাই আর আসতেন না। জাওয়াদ ভাই মারা যাওয়ার পর আজাদ ভাই পুরো দায়িত্ব পান। একসময় সানী ভাই চাকরি ছেড়ে দিলেন। উল্লেখ্য, আসলাম সানী ভাই বিচিত্রা নতুন ব্যবস্থাপনায় প্রকাশের শুরুতেই এর সহকারী সম্পাদক ছিলেন। তারপর যতদিন বিচিত্রা অফিসে নেত্রীর প্রেস অফিস ছিল, ততদিন কম্পিউটার অপারেটর ফাতেমা কম্পোজ করত। আমি তা প্রুফ-সংশোধন করে দিতাম। অনেক সময় বেবী আপা আমাকে ফোনে বলতেন, দুলাল অমুক...যাবে তাকে একটি শোকবাণী অথবা প্রেস-সংক্রান্ত কোনো কাগজ রেডি করে রাখ। পরোক্ষভাবে সেসময় বেবী আপাও এসব দায়িত্ব তদারকি করতেন।
আজাদ ভাই খামটা খুলে একটি বের করে পড়লেন।
আমি বললাম, আজাদ ভাই আমি কি আপনাকে কোনোভাবে সহায়তা করতে পারি। তিনি বললেন, তুমি কোনদিকে যাবে? আমি বললাম, মতিঝিলের দিকে। তিনি আমাকে ৬টি কপি দিয়ে বললেন, যাওয়ার পথে এগুলো সংবাদ, যুগান্তর, ইত্তেফাক, ইনকিলাব, অবজারভার অফিসে দিয়ে যাবে। একটা বেশি আছে, প্রয়োজনে ফটোকপি করে নিও।
প্রেস ক্লাব থেকে বের হয়ে প্রথমে রঞ্জন দাকে ফোন দিলাম। রঞ্জন সেন (বিচিত্রার সাবেক কর্মী) তখন সংবাদের রিপোর্টার। রঞ্জন দা বললেন, আমি অফিসে।
সংবাদে ঢুকেই রঞ্জন দাকে একটি কপি দিলাম। তিনি দাঁড়িয়ে চোখ বুলিয়ে বার্তা সম্পাদক হয়ে নির্বাহী সম্পাদকের রুমে গেলেন (সাংবাদিক নেতা মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল তখন নির্বাহী সম্পাদক)। বুলবুল ভাইয়ের কাছে দিয়ে খুব দ্রুত সেখান থেকে বের হয়ে একটা রিকশা নিলাম- প্রথমে অবজারভার হয়ে যুগান্তর অফিসের উদ্দেশে। রাস্তায় ৫টি ছোটো খাম কিনে আলাদা আলাদা করলাম। অবজারভার অফিসে রিসিপশনে একটি খাম দিয়ে বের হলাম যুগান্তরের উদ্দেশে। সেখানে নিচে দাঁড়িয়ে রিপোর্টার ফজলুর রহমানকে (তিনিও বিচিত্রার সাবেক কর্মী, বর্তমানে ডিবিসি চ্যানেলের বার্তা সম্পাদক) ফোন দিলাম। তিনি বললেন, উপরে আসো। হাতে একটি কপি দিলে আমাকে নিয়ে তিনি সাইফুল ভাইকে (তখন তিনি যুগান্তরের নির্বাহী সম্পাদক, বর্তমানে সম্পাদক) দিলেন। সাইফুল ভাই এক নিঃশ্বাসে পড়ে আমার দিকে পর পর দুবার তাকালেন। সাইফুল ভাই কোথায় পেলাম জানতে চাইলে বললাম, বেবী আপা দিয়েছেন। বললেন, যাও সাবধানে যেও। ফজলু ভাই আমার সঙ্গে নিচে নামলেন এবং আমাকে বললেন, এখন কোথায় যাবে? আমি বললাম ইত্তেফাক, ইনকিলাব। বললেন সাবধান, ব্যারিস্টার মইনুলের পত্রিকা কিন্তু...। আমার মনেও এই ভয়টি কাজ করছিল, কারণ ব্যারিস্টার মইনুল তখন সরকারের উপদেষ্টা এবং দায়িত্ব পাওয়ার পরই আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনা সম্পর্কে নানা রকম বিরোধী মনোভাব প্রকাশ করতেন।
আমি একটা রিকশা নিয়ে ইত্তেফাকের গেটে নেমে উপরে উঠে প্রথমে ফরাজী আজমল ভাইকে খুঁজলাম। তখন তিনি অফিসে নেই। পরে ছোটো ভাই জাহিদুর রহমান সজলকে খুঁজলাম, সেও বাইরে। আমার পরিচিতদের মধ্যে কেউ কেউ অফিসে থাকলেও তাদের কাছে দেয়াটা নিরাপদ মনে করলাম না। নিচে নেমে দুটি খাম ইত্তেফাক ও ইনকিলাব পত্রিকার প্রেস রিলিজ বক্সে রাখি। পরে আজাদ ভাইকে ফোন দিই। তাকে বিস্তারিত বললাম এবং আমার কাছে একটি কপি আছে বললাম। তিনি বললেন ঠিক আছে, তুমি কাছাকাছি থেক। প্রয়োজনে ফোন দেব। তখন সন্ধ্যা হয়ে গেছে। বাসায় যেতে ইচ্ছা হলো না। হাঁটতে হাঁটতে মতিঝিল মসজিদ মার্কেটে অর্থকণ্ঠ অফিসে গেলাম। পত্রিকাটির মালিক আমার বন্ধু এনামুল হক এনাম (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী)। অফিসে বসে দুই গ্লাস পানি খেলাম। ভাবলাম বেবী আপাকে একটা ফোন দিই।
প্রথমবার তিনি ধরলেন না। ১০ মিনিট পর আবার ফোন দিলে তিনি রিসিভ করেই বললেন, দুলাল বলো। আপাকে বিস্তারিত বললাম, তিনি বললেন ঠিক আছে বাসায় চলে যাও।
এবার এনামের রুমে গিয়ে তার হাতে একটি কপি দিই। তিনি পড়ে সঙ্গে সঙ্গেই ৫টি ফটোকপি করিয়ে আনেন। কিছুক্ষণের মধ্যে অর্থকণ্ঠ অফিসের সবাই জেনে যায়।
ওয়ালিদকে ফোন দিলাম। বলল, আমি প্রেসে, আসবা? আমি বললাম, মতিঝিল এনামের অফিসে আছি। মতিঝিল হয়ে যাও।
সে বলল, না, দেরি হবে। তুমি চলে যাও। কাল সকাল সকাল অফিসে এসো।
সেদিনের কথাগুলো আজ ১৪ বছর পরও অমলিন। মনে পড়ে সেদিন ঘড়ির কাঁটা নয়টা ছুঁই ছুঁই। রাস্তায় লোকজন তেমন নেই, যানবাহনও কম, দু-একটা রিকশা চলছে। রিকশা না পেয়ে হেঁটেই বাসায় চলছি। ভাবছি, ১৯৭১ সাল আর ২০০৭ সাল- ব্যবধান ৩৬ বছর। স্বাধীনতার সমবয়সি আমি। আমার যখন জন্ম হয়, তখন এদেশে চলছে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরদের বর্বরতা। মা-বাবার কাছে শুনেছি, সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতির কথা। মার কোলে শরণার্থী হয়েছিলাম আমি।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ওয়্যারলেস মেসেজের কথা আজ ইতিহাসের অংশ। পেশার কারণে অসংখ্যবার পড়েছি। লেখায় ব্যবহার করেছি। সেই মেসেজটিতে জাতির জন্য যে নির্দেশনা বঙ্গবন্ধু দিয়েছিলেন, দেশবাসী সেই নির্দেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। আমরা মুক্ত হলাম, দেশ স্বাধীন হলো। ৩৬ বছর (২০০৭ সাল) পর অন্যায় শাসন আর অরাজকতার বিরুদ্ধে কথা বলতে গিয়ে শেখ হাসিনা জেলে। তার এই মেসেজটি (চিঠি) এদেশের জনগণকে উদ্দেশ করে লেখা।
আমি বঙ্গবন্ধুর মেসেজ আর আজ তার কন্যার মেসেজটি তুলনা করলাম। দুটোতেই মুক্তির কথা, অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর কথা রয়েছে। দুটোই মুক্তির সনদ। একটি দেশকে শত্রুমুক্ত করে দেশ স্বাধীন করতে অন্যটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠায়, অগণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতে। যে সংগ্রাম শেখ হাসিনা করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে।
রাজনৈতিককর্মী নয়, একজন সংবাদকর্মী হিসেবে সেসময় শেখ হাসিনাকে গ্রেপ্তারবিরোধী আন্দোলনে অন্যদের মতো নিজেও সম্পৃক্ত ছিলাম। পরে বেবী আপার নেতৃত্বে এই চিঠির হাজার হাজার কপি ছাপিয়ে সারা দেশে প্রচার করেছি। সঙ্গে কিছু লিফলেটও। সময়ের স্রোত অপ্রতিরোধ্য, সেই স্রোতের একটা স্মৃতি- ১৬ জুলাই ২০০৭।
লেখক: সাংবাদিক