ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

১৪ দিন ও নীল পদ্ম

আহমেদ মুশফিকা নাজনীন

প্রকাশিত : ০৮:৩৭ পিএম, ১৬ জুলাই ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৮:৪৮ পিএম, ১৬ জুলাই ২০২১ শুক্রবার

অর্ডার অর্ডার অর্ডার। বিচারকের কথায় আদালত প্রাঙ্গনে নেমে আসে পিনপতন নিরবতা। বিচারক রায় দেন, আসামীকে ১৪ বছরের সশ্রম কারাদন্ড দেয়া হলো। ঢং করে জেলখানার গেট খুলে যায়। কয়েদীর ড্রেস পরে আসামি মাথা নীচু করে জেলখানার ভেতর ঢুকে পড়েন। তারপর সেখানে কেটে যায় তার অযুত নিযুত দিন রাত্রি। 
 
১৪ বছর পর লম্বা চুল দাড়ি নিয়ে তিনি জেলখানা থেকে বের হন। আমরা করুণার চোখে দেখি তাকে। আমরা একটুও ভাবি না কেমন কেটেছে তার ঘরবন্দি জেলবেলা। 

করেনায় আক্রান্ত হয়ে ইদানিং এই জেলখানা নিয়ে ভাবছি। একটু বুঝেছি যে এক রুমে কাটানো কি কষ্টকর ১৪ দিনের করোনা বেলা। বিষয়টা ভাবা যত সহজ তত আসলে সহজ না।

আগের দিনও যে মানুষটি পরিবারের সবার সাথে আড্ডা মেরে, গান গেয়ে, হেসে, গলাগলি করে, মায়ের কোল ঘেষে দিন কাটিয়েছে, রাত পোহালেই করোনা আক্রান্ত হওয়ায় খবরে সে যেন হয়ে গেলো অচ্ছুত। সমাজের নিয়মে তাকে এখন আর ধরা যাবেনা, ছোঁয়া যাবে না। তার প্লেট আলাদা, গ্লাস আলাদা। একটা রুমে সে নিজেই স্বেচ্ছায় বন্দী হয়ে যায়। তার কাছের মানুষদের ভালোর জন্য তাকে সরে থাকতে হয় দূরে।


 
রাতারাতি এক আকাশটায় হয়ে যায় মেঘের অনেক রঙ। পরিবারের মানুষগুলো যদিও বা কাছে আসতে চায় সে নিজেই তাদের নিরাপত্তার কথা ভেবে কাছে ঘেষতে দেয়না। 

অনেক পরিবারে এক পজেটিভ রিপোর্টে পালটে যায় চারপাশের সবকিছু। দূর থেকে শোনে বাচ্চার কান্না, বরের টেনশন, বাবা মা ভাইবোনের দীর্ঘশ্বাস। এরমধ্যে থাকে আশংকা বাঁচবো তো! একটা পর একটা সমস্যা তৈরী হতে থাকে শরীরে ও মনে। তাল মেলানো বড় কঠিন। একটু পর পর অক্সিজেন স্যাচুরেশন মাপা, লাংস ইনফেকশন, রক্ত জমাট বাধা, সব মিলে কি যে টেনশনের তা যে না ফেস করেছে সে ছাড়া কেউ বুঝবে না। 

অক্সিজেন লেভেল ৯৫ হলেই আত্মা কাঁপতে থাকে, কমছে কেন? চোখের সামনে তখন ভাসে হাসপাতাল, অক্সিজেন সিলিন্ডার কত কি! একবার আমার ৬৯ এসেছিলো, ভয়ে চোখ বড় বড় হয়ে যায়। পরে ভালো করে দেখি অক্সিমিটার উল্টো করে ধরেছি। হাফ ছেড়ে বড় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ি। 

ফেসবুক খুললে তখন শুধু মৃত্যুর খবর। ইন্না লিল্লাহ লিখতে লিখতে হাত ব্যাথা হয়ে যায়। কপি করে বসাই। একা রুমে তখন যেন ভর করে কতকিছু। বিষাদ মন নিয়ে তখন বসা জানালার কাছে। কারো কারো আবার জানালা খোলা বারণ। পাশেই অন্য ভবন। টিভি কারো আছে, কারো নেই। এক বন্দী রুমে তখন আরশোলা, টিকটিকি মশা কয়টা আছে বলে দেয়া যায়। জীবন্ত প্রাণীগুলোকে মনে হয় বড় আপন। মারতে ইচ্ছে করে না। মনে হয় আছে থাক না নড়াচড়া তো করছে। 

আহা মানুষ। মানুষের সঙ্গ হারিয়ে তখন দিশেহারা মন। ক’দিন আগেও যার আচরণে বিরক্ত হয়েছিলো তাকেও তখন মাফ করে দেয়া যায়। জগতের সব প্রাণীকে মনে হয় বড়ই আপন। 

মাঝে মাঝে ভেঙ্গে যায় মনোবল। কালবৈশাখি ঝড়ের দাপট তখন শরীরে। তছনছ করে ফেলতে চায় করোনা ভাইরাস। কখনো জেতে কখনো হারে। মন তখন স্পর্শ চায়। মাথায় চায় স্নেহ ভালবাসার হাত। বোঝে চারপাশে রয়েছে উৎকণ্ঠিত মুখ। কিন্তু সে মুখগুলোকে ধরা যায়না, ছোঁয়া যায়না। যতই ভার্চুয়ালি থাকি মাথায়, কপালে একটা নরম হাত যে কত দরকার রাত জেগে তা বোঝা যায়। কেউ পায় কেউ পায়না। 

আমার রুম থেকে জানালার চারপাশের পৃথিবী তখন আমার মুখস্ত। এক জানালা আকাশ দিয়ে কত কি যে দেখা যায়। ১৩ তালা থেকে নীচ তালার টিনেচালে ছুটোছুটি করে একটা বেজি। ২টা কালো বিড়াল আর লাল ছোট বিড়াল প্রতিদিন ঝগড়া করে। কালো বিড়ালটা বেশি ঝগড়াটে। বয়স একই কিন্তু অযথা ক্ষমতা দেখায়। বিকেলে উড়ে একঝাক সাদা পাখি। একটা ঘুড়িকে পাখি ভেবে কাটিয়েছি ২ঘণ্টা। প্রেমে পড়েছি এক গাছের। কিযে সুন্দর তার পাতার নাচন। ভেবেছি সুস্থ্য হলে গাছটার কাছে যাব। একটা ঠেলাওয়ালা, কতক রিক্সা মাঝরাতে আপনমনে চলে। ক্লান্ত তারা। শহর ঘুমায়, মানুষ ঘুমায়, জেগে থাকে শুধু করোনায় আক্রান্ত মানুষটি।
কবরের অন্ধকারের কথা শুধু মনে হয়। 

খোঁজ নিতে যেয়ে এক চাচী কেঁদে ওঠলেন, মা এমন কি রোগ আসলো, আমরা চলে গেলে সন্তানরা মনে হয় ভয়ে আসবে না। সান্তনা দেই তাকে। 

মাস্ক পরে থাকলে সংক্রমণ অনেকটাই কমে। সম্ভব হলে প্রতিদিন বদলে ফেলা ভালো বিছানার চাদর বালিশ। একা থাকার রুমটাকে ভালোবাসতে হবে। গুছিয়ে রাখতে হবে সব। মাঝে মাঝে দমবন্ধ লাগবে, কান্না পাবে, তারমধ্যেই হাঁটতে হবে, করতে হবে শরীরচর্চা। মাঝে মাঝে শরীর ভালো লাগলে নিজের মতো করে থাকুন না সেজে। 

ম্যাসন্জার ভর্তি শুভাকাংখীদের সুন্দর সুন্দর লেখা পড়ুন। মন খারাপ করে থাকলেই মনে ১শ মণ ভার চেপে বসে। এক গল্পে পড়েছিলাম, এক লোককে দেয়া হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদন্ড। সাজার মেয়াদ শেষে সে যখন বেরিয়ে এলো তখন সে সুস্থ্য। সবাই অবাক। প্রশ্ন করা হয়েছিলো, তুমি কিভাবে এতো ভালো ছিলে এক অন্ধকার রুমে? তার উত্তর ছিলো, আমার কাছে ১২টা আলপিন ছিলো, আমি প্রতিদিন আলপিন গুলো রুমের নানা দিকে ছুড়ে মারতাম। তারপর রাতে সেগুলো খুঁজে খুঁজে বের করতাম। এই কাজটা নিয়ে আমি এতো ব্যস্ত থাকতাম যে হতাশা ক্লান্তি আমাকে স্পর্শ করেনি। 

সুনীল বরুনার জন্য ১০৮টা নীলপদ্মা এনেছিলেন। করোনার আগে আমি নিজেই টবে লাগিয়েছিলাম এক নীলপদ্মর গাছ। আমার নীলপদ্মে ৭টা পাতা এসেছে। ফুল ফুটলে ছোট্ট বাগানটায়ও যেন হবে এক নীল পরি। কোভিট পরবর্তী সব জটিলতা কাটলে সব দু:সহ যন্ত্রণা ভুলে বাগান আলো করে নীলপদ্ম ফোটার অপেক্ষায় কাটছে আমার দিন।

আরকে//