কোরবানির ঈদে মুক্ত থাকুন অশুদ্ধাচার থেকে
চঞ্চল করিম
প্রকাশিত : ০২:১৯ পিএম, ২০ জুলাই ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ০২:২০ পিএম, ২০ জুলাই ২০২১ মঙ্গলবার
- ভাই, কত (টাকা) দিয়ে কিনলেন? হাট থেকে কোরবানির পশু কিনে বাড়ি ফেরার পথে এই প্রশ্নের সম্মুখীন হন নি এমন মানুষ বিরল! চলতি পথে যিনিই সামনে পড়ছেন সাগ্রহে দাম জানতে চাইছেন, ক্রেতাও সমুৎসাহে দাম বলছেন- ঈদুল আজহার প্রাক্কালে অতি পরিচিত দৃশ্য এটি। তবে কোরবানির পশুর দাম জিজ্ঞেস করা যে একটি অশুদ্ধাচার, তা কি আমরা জানি? কেন এটি অশুদ্ধাচার?
আসলে কোরবানির পশুর কোনো দাম হয় না। কারণ কোরবানির পশু কোনো পণ্য নয়। এটি স্রষ্টার নির্দেশ পালনের একটি অনুষঙ্গ মাত্র। তাই কোরবানির পশুর দাম জিজ্ঞেস করতে নেই। তবে কেউ যদি আপনার কাছে দাম জিজ্ঞেস করে তাহলে উত্তেজিত বা বিরক্ত হবেন না। প্রশ্নকর্তাকে সবিনয়ে বলুন, 'আল্লাহ যা সামর্থ্য দিয়েছেন তার মধ্যেই কেনার চেষ্টা করেছি!'
কোরবানির আরো কিছু বর্জনীয় বিষয়-
'আমি ... টাকা দিয়ে কোরবানি দিলাম'–নিজেকে জাহির করার উদ্দেশ্যে এ ধরনের কথা বলা। কেনার পর বাজারদর যাচাই করে এ নিয়ে অহেতুক আলাপে লিপ্ত হওয়া; 'দামে ঠকে গেছি'-এ ধরনের আফসোস করা। গোশতের ওজন ও পরিমাণ নিয়ে কথা বলা। পশুর সাথে সেলফি তোলা ও তা ফেসবুকে পোস্ট করা। কয়দিন পর কোরবানি করব–এই ভেবে কোরবানির পশুকে অযত্নে-অবহেলায়-অনাহারে রাখা।
কোরবানির ঈদ এলেই এক শ্রেণীর মানুষের মধ্যে দেখা যায় ‘বিরাট গরু’ কেনার প্রতিযোগিতা। প্রতাপশালী ধনাঢ্য লোকেরা ১৫/২০/২৫ লাখ টাকা দামের বিশাল সাইজের গরু কিনে খবরের শিরোনাম হতে চান, যা একেবারেই অনুচিত।
কয়েকটি হাদিসের পর্যালোচনামতে, কোরবানির পশুর কিছু নূন্যতম বৈশিষ্ট থাকতে হবে। ছাগল, ভেড়া ও দুম্বা কমপক্ষে ১ বছর, গরু-মহিষ ২ বছর এবং উট ৫ বছর পূর্ণ হতে হবে। সেই সাথে হতে হবে নীরোগ সুস্থ-সবল।
বড় আকারের পশু কোরবানিতে বাধা নেই। তবে শর্ত হলো, বড় গরু কেনার মধ্যে লোক দেখানোর মানসিকতা যেন না থাকে। মনে রাখা দরকার- কেন কোরবানি দেই, দিতে হয়! আসলে কোরবানি কবুল হওয়ার শর্ত পশুর আকার নয়, মূল বিষয় হলো নিয়ত। মানে আভিজাত্য প্রকাশ, লোক দেখানো কিংবা মাংস খাওয়া নয়, কোরবানির মূল উদ্দেশ্য হতে হবে স্রষ্টা-সচেতনতা।
সূরা হজে আল্লাহ্ বলেছেন, আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের জন্যে কোরবানিকে ইবাদতের অংশ করেছি। (আয়াত ৩৪) (কিন্তু মনে রেখো) কোরবানির মাংস বা রক্ত আল্লাহর কাছে পৌঁছায় না, আল্লাহর কাছে পৌঁছায় শুধু তোমাদের নিষ্ঠাপূর্ণ আল্লাহ-সচেতনতা। (আয়াত ৩৭)
ঈদ পরিবারের সদস্যদের একাত্ম হওয়ার সুযোগ করে দেয়। তবে এই একাত্ম হওয়া মানে কিন্তু কেবল পাশে বসে থাকা নয়। অনেক পরিবারেই দেখা যায়, দূর দূরান্তে থাকা সদস্যরা বহুদিন বাদে এক হচ্ছেন। কিন্তু খানিক কথাবার্তার পর কেউ ঈদের টিভি অনুষ্ঠানে, কেউ নেটফ্লিক্সে, কেউ ভিডিও গেমে, কেউ ফেসবুকে আবার কেউ রান্নার অনুষ্ঠানে মশগুল হয়ে পড়ছে। ফলে এতদিন বাদে কাছে এসেও একাত্ম হতে পারলো না কেউই!
আসলে জাতি হিসেবে আমাদের শক্তির জায়গা হচ্ছে আমাদের পরিবারপ্রথা, পারিবারিক একাত্মতা। আধুনিক ব্যস্ত জীবনে ঈদ আমাদের সেই সুযোগটি করে দেয় চমৎকারভাবে। তাই সব ধরণের ভার্চুয়াল ভাইরাস ও ডিভাইজকে সরিয়ে রেখে প্রিয়জনের সাথে মনখুলে কথা বলুন, ভাব বিনিময় করুন। খোঁজ নিন - সে কেমন আছে, কীভাবে কাটছে দিন। কোনো চ্যালেঞ্জ আছে কিনা, কিংবা বড় কোনো পরিকল্পনা।
বছরের বাকি দিনগুলোতে প্রিয়জনের সাথে ডিভাইজের মাধ্যমে যোগাযোগ করেছেন, এবার যুক্ত হোন সরাসরি! কোরবানির প্রকৃত উদ্দেশ্য পশু জবেহ করে ভুরিভোজ করা নয়। অথচ ব্যাপারটা কার্যত হয়ে গেছে তা-ই!
এমনকি ‘একটা দিনই তো খাই’- এই ওসিলায় বছরের বাকি দিনগুলোর সংযম ভাঙতেও কার্পণ্য করেন না অনেকে। বিশেষত হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ বা মেদস্থূলতা আছে এমন মানুষও অবলীলায় ভুরিভোজ সারেন ঈদকে উপলক্ষ্য করে। পরিণামে বাড়ে ভোগান্তি। আসলে নিজে খাওয়া নয়, ঈদের আনন্দ বাড়ে অতিথি আপ্যায়নে। কাজেই ঈদে পরিচিত-পরিজনদের ঘরে আমন্ত্রণ জানান। সাধ্যমতো আপ্যায়ন করুন।
আর খোঁজ নিন দরিদ্র প্রতিবেশী-আত্মীয় পরিজনের। উপার্জন হারিয়ে যারা অন্নহীন মানবেতর জীবনযাপন করছে, আপনার ঈদের খরচ থেকে বাঁচিয়ে তাদের পাশে দাঁড়ান। করোনাজনিত আর্থিক অসঙ্গিতের কারণে ঈদ যাদের জন্যে আনন্দের বার্তা বয়ে আনে নি তাদের অভুক্ত রেখে নিজে ভুরিভোজ কোরবানির শিক্ষার পরিপন্থি।
ঈদ মানেই আনন্দ। তবে এবারের ঈদ হয়তো অনেকের জন্যেই আনন্দময় হবে না। কারণ আমাদের মাঝে এমন অনেক পরিবার আছে যাদের উপার্জন প্রায় থেমে গেছে এই লকডাউনে। অনেকেই বেতন আংশিক পাচ্ছেন বা একেবারেই পাচ্ছেন না। অনেকের কারখানা বন্ধ, প্রতিষ্ঠান বন্ধ, কর্মীদের বেতন দিতে পারেননি ঠিকমতো।
তার চেয়ে ভয়াবহ পরিস্থিতি দিনে আনে দিন খায় সেই মানুষগুলোর, যাদের পেটে এক বেলা খাবার ঠিকমতো জুটছে কিনা সন্দেহ।
আরও আছে এমন অনেক পরিবার যাদের এক বা একাধিক সদস্য করোনায় আক্রান্ত অথবা আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেছেন। ফলে সামাজিক চাপের মুখে ঘরবন্দী হয়ে আছেন তারা। আক্রান্ত হবার ভয়ে প্রতিবেশী-পরিজন তাদের একরকম পরিত্যাগ করেছে!
এবারের কোরবানির ঈদে, যাদের সামর্থ্য আছে, তারা হয়তো পরিবারের সাথে ঈদের দিনটা ভালো কাটাবেন, দু চারটা ভালো রেঁধে খাবেন।
ওদিকে করোনার্তদের অনেকেই হয়তো থাকবেন না খেয়ে। ক্ষুধার যন্ত্রণায় কাতর হলেও পথে নামতে পারবে না চক্ষুলজ্জায়।
প্রতি বছর আমরা ধর্মীয় রীতি অনুসরণ করে কোরবানি দেই। কোরবানি অবশ্যই অন্যতম একটি পুণ্যের আমল। কিন্তু বিশেষ পরিস্থিতিতে এবারের কোরবানির ঈদ আমাদের সামনে আরো বেশি পুণ্য লাভ করার সুযোগ এনে দিয়েছে।
এসএ/