বাংলাদেশে গণহত্যা এবং সায়মন ড্রিং এর প্রতিবেদন
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০৬:২৪ পিএম, ২৩ জুলাই ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ১১:৫৩ এএম, ২৪ জুলাই ২০২১ শনিবার
[১৯৭১ সালে পূর্ব পাকিস্তানের রাজনৈতিক সংকট ঘনিয়ে উঠলে ৬ মার্চ যুক্তরাজ্যের ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিবেদক সায়মন ড্রিং বিমানে ঢাকায় আসেন। ২৬ বছর বয়সী সায়মনই প্রথম ২৫ মার্চের কালরাত্রিতে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর ভয়াবহ গণহত্যার তথ্য ও প্রতিবেদন ১৯৭১ সালের ৩০ মার্চ লন্ডনের টেলিগ্রাফ পত্রিকায় তুলে ধরেন। তার ‘ট্যাংকস ক্র্যাশ রিভোল্ট ইন পাকিস্তান’ শিরোনামের প্রতিবেদন বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
ঢাকায় দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর চালানো প্রথম দফার গণহত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের প্রত্যক্ষ চিত্র উঠে আসে ওই প্রতিবেদনে। তার এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর বিশ্ব জুড়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত সৃষ্টি হয়। বাংলাদেশের এই অকৃত্রিম বন্ধু গত ১৬ জুলাই বেলা আড়াইটায় রোমানিয়ায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার হাত ধরেই বাংলাদেশে প্রথম স্যাটেলাইট টেলিভিশনের যাত্রা শুরু হয়। তার নেতৃত্বে একুশে টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশে সম্প্রচার সাংবাদিকতার নতুন পথ চলা শুরু হয়।]
নিচে টেলিগ্রাফে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি বাংলায় তুলে ধরা হলো-
বিদ্রোহ দমনে পাকিস্তানে ট্যাংক আক্রমণ: ৭,০০০ নিহত, ঘরবাড়ি ভষ্মীভূত
“আল্লাহ এবং অখণ্ড পাকিস্তানের” নামে শুরু করা লড়াইয়ে ঢাকা এখন ধ্বংস এবং ভীতির নগরী। (এ লড়াই চলাকালে যিনি ঢাকায় ছিলেন সেই সাইমন ড্রিং এ সংবাদ প্রতিবেদনটি পাঠিয়েছেন ব্যাংকক থেকে।)
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ঠাণ্ডা মাথায় ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অবিরাম শেল বর্ষণে সেখানে ৭ হাজারেরও বেশি লোক নিহত হয়েছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে পাওয়া খবরের ভিত্তিতে মনে হচ্ছে ঢাকাসহ সব মিলিয়ে এ অঞ্চলে সেনা অভিযানে ১৫ হাজার লোক নিহত হয়েছে।
কয়েকটি উদাহরণ থেকে সেনা অভিযানের ভয়াবহতা সঠিকভাবে অনুমান করা যেতে পারে। ছাত্রাবাসে নিজেদের বিছানাতেই ছাত্রদেরকে হত্যা করা হয়েছে। বাজারগুলোতে কসাইদেরকে নিজেদের দোকানের পেছনে হত্যা করা হয়েছে। ব্যাপক এলাকা ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। এর মাধ্যমে তারা পূর্ব পাকিস্তানের স্বাধীনতা আন্দোলনকে নির্মমভাবে দমন করেছে।
দেশটির সামরিক সরকারের প্রধান প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান দাবি করেছেন, বর্তমানে সেখানকার পরিস্থিতি শান্ত। তা সত্ত্বেও হাজার হাজার লোক শহর থেকে প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চলে পালিয়ে যাচ্ছে, ঢাকা নগরীর রাস্তাঘাট প্রায় জনশূন্য এবং প্রদেশটির বিভিন্ন অংশে এখনো নিধন চলছে।
কিন্তু সন্দেহাতীতভাবে এটা সত্য যে, ট্যাংকের সমর্থনপুষ্ট সেনাবাহিনী সেখানকার শহর এবং প্রধান জনপদগুলো নিয়ন্ত্রণ করছে। প্রতিরোধও খুব সামান্য এবং প্রায় অকার্যকর। তা সত্ত্বেও ন্যূনতম উস্কানিতে সেনাবাহিনী এখনও গুলি চালাচ্ছে এবং নির্বিচারে দালান কোঠা ধ্বংস করা হচ্ছে।
পূর্ব পাকিস্তানের ৭ কোটি ৩০ লাখ বাঙালির ওপর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করতে সেনাবাহিনী যেন দিনকে দিন অধিকতর দৃঢ় প্রতিজ্ঞ হয়ে উঠছে।
তবে এসব সেখানকার নিরীহ জনগণের ক্ষেত্রে কি দুর্ভোগ বয়ে আনছে, তা সঠিকভাবে অনুমান করাটা প্রায় অসম্ভব। চট্টগ্রাম, কুমিল্লা এবং যশোরের মতো প্রত্যন্ত এলাকায় শিশুসহ মহিলাদেরকে জীবন্ত দগ্ধ করা হয়েছে। পাকিস্তানের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধরে নিয়ে গণহারে হত্যা করা হয়েছে। বাজার এবং দোকানপাটগুলো আগুনে ভস্মীভূত করা হয়েছে। রাজধানী ঢাকার প্রতিটি ভবনে এখন উড়ছে পাকিস্তানী পতাকা।
সেনাবাহিনীর ক্ষয়ক্ষতির কথা জানা যায়নি। তবে কমপক্ষে দু’জন সেনা আহত এবং একজন সেনা কর্মকর্তা নিহত হয়েছে। বেশ কিছু সময়ের জন্য বাঙালিদের গণঅভ্যুত্থান ভালোমতো কার্যকরভাবে দমন করা হয়েছে বলেই মনে হচ্ছে। সেনাবাহিনী শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক করে নিয়ে গেছে এবং তার দল আওয়ামী লীগের প্রায় সকল শীর্ষ নেতাকেও গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
সাঁজোয়া হামলা
পূর্ব পাকিস্তানের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক কর্মীদের আটক করা হয়েছে, অন্যদেরকে হত্যা করা হয়েছে এবং শেখ মুজিবের আন্দোলনের প্রতি সমর্থন দেওয়া দুটো পত্রিকার দপ্তর ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে। তবে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর নামানো ট্যাংকের প্রথম লক্ষ্য ছিল ছাত্ররা।
ঐ রাতে সেনা অভিযানে তিন ব্যাটালিয়ন সৈন্য অংশ নিয়েছে বলে ধারণা হচ্ছে। এদের একটি সাঁজোয়া, একটি গোলন্দাজ এবং একটি পদাতিক ব্যাটালিয়ন। রাত ১০টার সামান্য আগে এসব সৈন্য ছাউনি ত্যাগ করতে শুরু করে এবং ১১টা নাগাদ গুলিবর্ষণ শুরু হয়।
আর যেসব লোক রাস্তায় গাড়ি, গাছের গুড়ি, আসবাবপত্র, কংক্রিটের পাইপ দিয়ে সাময়িক প্রতিরোধ গড়ে তুলেছিল তারাই এ হামলার শিকার হয়। টেলিফোনে শেখ মুজিবকে সতর্ক করে দেওয়া হয় যে, কিছু একটা ঘটতে চলেছে। তবু তিনি নিজ বাসভবন ত্যাগ করতে অস্বীকার করেন। পরবর্তীতে গ্রেপ্তার এড়াতে সক্ষম হয়েছিলেন তার এমন এক সহযোগীকে এ সময় শেখ মুজিব বলেন, “আমি আত্মগোপন করলে সেনাবাহিনী আমাকে খুঁজে বের করতে গোটা ঢাকা শহর ছারখার করে ফেলবে।”
২০০ ছাত্র নিহত
সেনাবাহিনীর হামলা সম্পর্কে ছাত্রদেরও সতর্ক করা হয়েছিল। হামলার পরও আশে-পাশে থেকে যাওয়া ছাত্ররা জানায়, তাদের ধারণা ছিল হয়তো তাদেরকে কেবল গ্রেপ্তার করা হবে।
২৫শে মার্চ মধ্যরাতের পরপরই একদল পাকিস্তানী সৈন্য মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরবরাহ করা দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধকালীন এমন-২৪ ট্যাংক নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢুকে পড়ে। সৈন্যরা সেখানকার ব্রিটিশ কাউন্সিলের লাইব্রেরিটির দখল নেয় এবং এটিকে আশপাশের ছাত্রাবাসগুলোতে শেল বর্ষণের ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে।
এ আকস্মিক হামলায় সরকারবিরোধী জঙ্গী ছাত্র সংগঠনের সদর দপ্তর হিসেবে বিবেচিত ইকবাল হলে প্রায় ২০০ ছাত্র নিহত হয়। সৈন্যরা ছাত্রাবাস ভবনে শেল বর্ষণের পাশাপাশি ছাত্রাবাসের কক্ষগুলোতে মেশিনগানের গুলি বর্ষণ করে। ঐসব নিহতদের লাশ হামলার দু’দিন পরও তাদের ভস্মীভূত রুমেই পড়ে ছিল। ছাত্রাবাসের বাইরেও অনেকের লাশ পড়ে আছে এবং সেখানকার একটি পুকুরেও অনেক লাশ ভেসে রয়েছে। চারুকলার একজন ছাত্রের লাশ হাত-পা ছড়ানো অবস্থায় তার ক্যানভাসের সামনেই পড়ে রয়েছে।
নিজেদের বাসভবনেই নিহত হয়েছেন ৭ জন শিক্ষক। আর বাড়ির বাইরে আত্মগোপন করতে গেলে সৈন্যরা ১২ সদস্যের একটি পরিবারকে গুলি করে হত্যা করেছে। সেনাবাহিনী নিহতদের অনেকের লাশ সরিয়ে নিলেও ইকবাল হলের করিডোর যে সব ছাত্রের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে ৩০ তারিখ পর্যন্ত তা গোনা হয়নি।
আরেকটি ছাত্রাবাসে সৈন্যরা তড়িঘড়ি করে খনন করা গণকবরে নিহতদের সমাধিস্থ করে এবং পরে ট্যাংক দিয়ে তা সমান করে দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছাকাছি এলাকায় বসবাসকারী জনসাধারণের উপরও গুলি বর্ষণ করা হয়েছে এবং সেখানকার পাশ দিয়ে চলে যাওয়া রেলপথের পার্শ্ববর্তী ২০০ গজ বিস্তৃত বস্তি ঘরগুলোও গুঁড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।
সেনাবাহিনীর টহলদল পার্শ্ববর্তী এলাকার একটি মার্কেটও গুঁড়িয়ে দিয়েছে। সৈন্যরা সেখানকার দোকানদারকে ঘুমন্ত অবস্থাতেই হত্যা করে। দু’দিন পর পরিস্থিতি খানিকটা স্বাভাবিক হয়ে এলে সেখানে গিয়ে দেখা যায় তখনো তাদের কাঁধ পর্যন্ত কম্বলে ঢাকা যেন তারা ঘুমন্ত।
একই এলাকার ঢাকা মেডিকেল কলেজে সরাসরি বাজুকা আঘাত হানে এবং সৈন্যদের শেল বর্ষণে একটি মসজিদও মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তরে হামলা
বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানী সৈন্যদের হামলার সময় নগরীর রাজারবাগস্থ পূর্ব পাকিস্তান পুলিশ সদর দপ্তরেও সৈন্য নামে। সেখানে ট্যাংকের গোলাবর্ষণ করা হয়, পরে সৈন্যরা ভেতরে ঢুকে আবাসিক ভবনগুলো গুঁড়িয়ে দেয় এবং নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে।
পুলিশ সদরদপ্তরের বিপরীত দিকে বসবাসরতরাও জানে না এ হামলায় কতজন নিহত হয়েছে। তবে রাজারবাগ পুলিশ সদর দপ্তরে ১১শ’ পুলিশ বসবাস করতো। তাদের খুব কমজনই বেঁচে আছে বলে ধারণা করা হচ্ছে।
এসব হামলা চলাকালে সেনাবাহিনীর অন্য ইউনিটগুলো শেখ মুজিবের বাড়ি ঘিরে ফেলে। রাত ১টার সামান্য আগে যোগাযোগ করা হলে মুজিব আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেন, খুব অল্প সময়ের মধ্যেই হয়তো হামলা হতে যাচ্ছে। সে কারণেই আমি নিজের কাজের লোক ও একজন দেহরক্ষী ছাড়া অন্যদেরকে নিরাপত্তার জন্য অন্যত্র পাঠিয়ে দিয়েছি।
তার একজন পড়শী বলেন, রাত ১টা ১০ মিনিটের দিকে একটি ট্যাংক, একটি সাঁজোয়া যান এবং ট্রাকভর্তি সৈন্যরা রাস্তা থেকে গুলি ছুড়তে ছুড়তে শেখ সাহেবের বাড়ির দিকে এগুতে থাকে। সৈন্যদের এ বহর বাড়িটির বাইরে এসে থামলে একজন সেনা কর্মকর্তা ইংরেজিতে চেঁচিয়ে বলে ওঠে, “শেখ তোমাকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”
এসময় শেখ মুজিব নিজ বাড়ির দোতলার ব্যালকনিতে বেরিয়ে এসে জবাব দেন, “হ্যাঁ, আমি প্রস্তুত। তোমাদের গুলি ছোঁড়ার কোন দরকার নেই।”
“তোমাদের দরকারের কথাটা টেলিফোন করে বললেই হতো। আমি করতাম। এ সময় ঐ সেনা কর্মকর্তা শেখ মুজিবের বাড়ির বাগান পার হয়ে ভেতরে ঢুকে বলে, “শেখ, তোমাকে গ্রেপ্তার করা হলো।”
শেখ মুজিবের দেহরক্ষী ঐ সেনা কর্মকর্তাকে গঞ্ছনা করতে শুরু করলে তাকে বেধড়ক পেটানো হয়। পরে তিনজন কাজের লোক, একজন সহযোগী ও ঐ দেহরক্ষীসহ শেখ মুজিবকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয়।
দলিলাদি জব্দ
শেখ মুজিবকে সেনাদপ্তরে ধরে নিয়ে যাওয়ার পর পরই সম্ভবত সৈন্যরা তার বাড়িতে ঢুকে সকল নথিপত্র কব্জা করে, ভাংচুর চালায় এবং বাগানের গেটটি তালাবদ্ধ করে দেয়। তারা সেখানে উড্ডীন লাল, সবুজ ও হলুদ রঙের ‘স্বাধীন বাংলাদেশের’ পতাকা গুলি করে ভূপাতিত করে এবং পরে সেখান থেকে চলে যায়।
২৬শে মার্চ ভোর ২টার দিকেও সারা শহর জুড়ে গুলিবর্ষণ ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটতে থাকে। ইতোমধ্যেই সৈন্যরা বিশ্ববিদ্যালয় এবং সংলগ্ন এলাকা দখল করে নিয়েছিল। তারা সেখানে আত্মগোপনকারী ছাত্রদের হত্যা ও স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে পাকিস্তানের জাতীয় পতাকা উড়ানোর কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়ে।
এসময় বেশ কয়েকটি এলাকায় ভারি গোলাবর্ষণ অব্যাহত থাকলেও হামলার তীব্রতা উল্লেখযোগ্যভাবে কমে আসতে থাকে। এক প্লাটুন পাকিস্তানী সৈন্য ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের বিপরীত দিককার স্থানীয় ‘পিপলস’ নামক পত্রিকাটির জনশূন্য দপ্তরে হামলা চালায়, তারা ঐ এলাকার অধিকাংশ ঘরবাড়িসহ সেটি জ্বালিয়ে দেয় এবং সেখানকার একমাত্র নৈশ প্রহরীকে হত্যা করে।
ভোর রাতের দিকে গুলিবর্ষণ প্রায় বন্ধ হয়ে আসে। সূর্যোদয়ের লগ্নে সারা শহরে ভৌতিক নীরবতা নেমে আসে। এ সময় রাস্তায় সেনা কনভয়ের আওয়াজ এবং কাকপক্ষীর কিচিরমিচির ছাড়া আর কোন জনমনিষ্যির উপস্থিতির আভাস মাত্রও দেখা যায়নি।
তখনো সবচেয়ে ভয়াবহ ঘটনা ঘটার যেন বাকি ছিল। ২৬ তারিখ মধ্য দুপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা কোন পূর্ব-সতর্কীকরণ ছাড়াই পুরনো ঢাকার আবাসিক এলাকায় ঢুকে পড়ে। সেখানকার সংকীর্ণ গলি-ঘুঁপচি ও রাস্তা সরু হলেও এলাকাটিতে ১০ লাখেরও বেশি লোক বাস করে। ঢাকার যেসব এলাকায় শেখ মুজিবের প্রতি জনসাধারণের দৃঢ় সমর্থন রয়েছে, পুরানো ঢাকা তার অন্যতম। ইংলিশ রোড, ফ্রেঞ্চ রোড, নয়া বাজার, সিটি বাজার, অর্থহীন এসব নামের এলাকাতে হাজারো লোকের বসবাস। পরবর্তী ১১ ঘণ্টা ধরে পাকিস্তানী সৈন্যরা পরিকল্পিতভাবে ধ্বংসযজ্ঞ চালায় এবং অগ্নি-সংযোগ করে ব্যাপক এলাকা ভস্মীভূত করে।
ফ্রেঞ্চ রোড, নয়া বাজার এলাকার বয়োবৃদ্ধ এক অধিবাসী জানায়, “হঠাৎ করেই রাস্তার মাথায় সৈন্যরা উপস্থিত হয় এবং তারা সকল বাড়িঘরে গুলিবর্ষণ করতে করতে ছুটে আসে।” এ হামলাকারী দলটির পিছু পিছু পেট্রোল-ভর্তি ক্যান নিয়ে আসে আরেকদল সৈন্য।
এসব এলাকার যেসব বাসিন্দা পলায়নে উদ্যত হয় তাদেরকে গুলি করে হত্যা করা হয় আর যারা ঘর বাড়িতে অবস্থান করে তাদেরকে জীবন্ত পুড়িয়ে মারা হয়। মধ্য দুপুর থেকে দুইটার মধ্যকার সময়ে এসব এলাকায় প্রায় ৭শ’ নর-নারী ও শিশুকে হত্যা করা হয়।
আরো তিনটি এলাকাতেও অনুরূপ ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়েছে। এসব এলাকার আয়তন এক বর্গমাইল বা তারও বেশি। সৈন্যরা এক এলাকায় ধ্বংসযজ্ঞ শেষে নিহতদের বাইরে সবাইকে ট্রাকে তুলে নিয়ে পরবর্তী লক্ষ্যস্থলের দিকে যেতে থাকে। পুরানো ঢাকায় থানাতেও হামলা হয়েছে।
শনিবার সকালে এসব বাজারের ধ্বংসস্তূপের মাঝে অনুসন্ধানরত এক পুলিশি ইন্সপেক্টর বলেন, “আমি আমার সিপাইদের খুঁজছি। আমার এলাকার ২৪০ জন সেপাই ছিল, এ পর্যন্ত তাদের মধ্যে ৩০ জনকে খুঁজে পেয়েছি এবং সকল নিহত।”
ঢাকার সমগ্র সেনা অভিযানের বৃহত্তম গণহত্যার ঘটনাটি ঘটেছে পুরনো ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাগুলোয়। এসব এলাকায় সৈন্যরা জনসাধারণকে ঘরের বাইরে ডেকে এনে দল ধরে গুলি করে হত্যা করে। এলাকাগুলোতে অগ্নিসংযোগও করা হয়। পুরনো ঢাকায় স্থানীয় চরদের সাথে নিয়ে সৈন্যরা ২৬ তারিখ রাত ১১টা পর্যন্ত অবস্থান করে। এসব সৈন্য ফ্লেয়ার ছুঁড়ে চারপাশ আলোকিত করলে চররা আওয়ামী লীগ সমর্থকদের ঘর-বাড়ি দেখিয়ে দেয়। ট্যাংকের গোলা বা স্বয়ংক্রিয় বন্দুকের গুলি বা ক্যান ভর্তি পেট্রোলের সাহায্যে সৈন্যরা ঐসব ঘরবাড়ি ধ্বংস করে।
এদিকে ঢাকার শহরতলী বিশেষত টঙ্গী এবং নারায়ণগঞ্জের শিল্প এলাকায় শেখ মুজিবের বামপন্থী সমর্থকদের ঘাঁটিতে অভিযান শুরু করতে ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈন্যদের ব্যবহার করা হয়। রোববার সকাল পর্যন্ত এসব এলাকাতে গোলাগুলি ও অগ্নিসংযোগ অব্যাহত ছিল। তবে সেনা অভিযান শুরুর প্রায় ২৪ ঘণ্টা পর ২৬শে মার্চ রাত নাগাদ ঢাকা শহরের মূল অভিযান চালানো হয়। বাংলা ভাষী দৈনিক ইত্তেফাক অফিস ছিল এ অভিযানের শেষ লক্ষ্যবস্তু। সেনা হামলা শুরুর পর থেকে এখানে ৪শ’রও বেশি লোক আশ্রয় নিয়েছিল।
২৬ তারিখ বিকাল ৪টায় অফিসটির বাইরের রাস্তায় ৪টি ট্যাংক অবস্থান নেয়। সাড়ে চারটার মধ্যে ভবনটি অগ্নিকুণ্ডে রূপ নেয়। শনিবার সকাল নাগাদ সেখানে ছাইভস্ম ও লাশ ছাড়া আর কিছুই ছিল না। সৈন্যরা যত দ্রুত হাজির হচ্ছিল, তার চেয়ে বেশি দ্রুতই তারা রাস্তা থেকে উধাও হয়ে যেতে থাকে। শনিবার সকালে রেডিওতে সকাল ৭টা থেকে বিকাল চারটা পর্যন্ত কারফিউ তুলে নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া হয়।
অতঃপর রেডিওতে সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর নিষেধাজ্ঞা, সংবাদ মাধ্যমের ওপর সেন্সরশীপ, সকল সরকারি কর্মচারীদের কাজে যোগদান এবং ব্যক্তিগত মালিকানাধীন অস্ত্র জমা দেওয়া সংক্রান্ত সামরিক বিধি বার বার ঘোষণা করা হতে থাকে।
হাজার হাজার লোক পালাচ্ছে
হঠাৎ করেই নগরীতে কর্মচাঞ্চল্য ফিরে আসে। তবে চারদিকে আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সকাল ১০টা নাগাদ পুরানো ঢাকার বিস্তীর্ণ এলাকা ও বাইরে শিল্পাঞ্চলের দিককার রাস্তাগুলোতে কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী আর পলায়নমুখী মানুষের ভিড় দেখা যায়।
গাড়ীতে-রিক্সায় যত না তার চেয়েও বেশি মানুষ মালামাল কাঁধে নিয়ে ঢাকা ছেড়ে যায়। দুপুর নাগাদ আরো হাজার হাজার মানুষ এই কাফেলায় যোগ দেয়। কাউকে কাউকে কাকুতি মিনতি করতে দেখা যায়, “দয়া করে আমাকে একটু তোল, আমি বুড়ো মানুষ”, “আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে সাহায্য কর”, “অন্তত আমার বাচ্চাগুলোকে সঙ্গে নাও”।
সেনাবাহিনীর কাণ্ড দেখতে দেখতে লোকজন নীরবে আর বিষণ্নমুখে এগিয়ে যায়। অত্যন্ত সুচারুরূপে পরিচালিত ও চরম নিষ্ঠুরতার সঙ্গে বাস্তবায়িত এটা এক ব্যাপক ধ্বংসলীলা, এসব থেকে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে তারা হাঁটতে থাকে।
একটি মার্কেটের কাছাকাছি কোথাও হঠাৎ গুলির শব্দে হাজার দু’য়েক লোক রুদ্ধশ্বাসে ছুটতে শুরু করে। তবে তা ছিল একটা দুর্ঘটনা মাত্র। বাহিনীতে সবে যোগ দেওয়া আনাড়ি এক সদস্যের বেখেয়ালে ট্রিগারে চাপ লেগে এ গুলির ঘটনা ঘটে।
সরকারি অফিস আদালতগুলোর সব ছিল প্রায় ফাঁকা। বেশিরভাগ কর্মচারীই গ্রামের পথ ধরছে। যারা পলায়নপর নয়, তারাও নিজেদের ধোঁয়া উঠতে থাকা ভস্মীভূতি ঘরবাড়ির ধ্বংসস্তূপের আশেপাশে এলোপাথাড়ি ঘুরঘুর করতে থাকে।
ঢাকার আবাসিক এলাকাগুলোতে ঘরের চালের টিন আগুনে পুড়ে দুমড়ে-মুচড়ে গেছে। লোকজনকে এই ছাইভস্ম থেকেই গার্হস্থ্য সামগ্রী রক্ষায় তৎপর দেখা গেছে। যেসব যানবাহন গ্রামের দিকে যাত্রী বহন করছে না, রেডক্রসের পতাকা উড়িয়ে সেগুলোর প্রায় প্রতিটাই লাশ অথবা আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার কাজে ব্যস্ত ছিল।
এসবের মাঝেই হঠাৎ রাস্তায় সৈন্যবাহী কনভয় দেখা যায়। এসব কনভয়ের সৈন্যরা কঠিন মুখ করে সাধারণ মানুষের দিকে বন্দুক উঁচিয়ে রেখেছিল।
শুক্রবার রাতে ব্যারাকে ফিরিয়ে নেওয়ার সময় তারা যুদ্ধে আরবদের ব্যবহৃত একটি রণধ্বনি “নারায়ে তাকবীর” উচ্চারণ করতে থাকে- যার অর্থ “আমরা যুদ্ধে জিতে গেছি।” শনিবার মুখ খোলা মাত্রই তারা “পাকিস্তান জিন্দাবাদ”, “পাকিস্তান দীর্ঘজীবী হোক” ইত্যাদি স্লোগানই উচ্চারণ করতে থাকে।
আগে থেকেই বেশির ভাগ লোক ইতিকর্তব্য ঠিক করে রেখেছিল। তাই নতুন করে কারফিউ জারি হওয়ার আগে বাজারে পেট্রোল ছাড়া অন্য সবকিছুর চেয়ে পাকিস্তানী পতাকা বেশি বিক্রি হয়। নিজেদের অনুপস্থিতির সময় মালামালের সুরক্ষা নিশ্চিত করার একমাত্র উপায় হিসেবে তারা বাড়িঘর তালাবদ্ধ করার আগে একটি পতাকা উড়িয়ে রেখে যায়। বিকেল চারটার দিকে রাস্তাঘাট আবার ফাঁকা হয়ে যায়। সেনাবাহিনী রাস্তায় নেমে এলে ঢাকায় আবার নীরবতা নামে।
কিছু সময়ের মধ্যেই গোলাগুলি শুরু হয়। রেডিওতে ঘোষণা হতে থাকে “চারটা পর কেউ বাড়ির বাইরে থাকলে তাকে গুলি করা হবে।”
কারফিউ জারির মিনিট দুয়েক পরে সৈন্যরা একটি কিশোরকে রাস্তায় দৌড়াতে দেখে থামায়। একজন সেনা কর্মকর্তা তার মুখে চারবার থাপ্পড় মারে। শুধু তাই নয়, তাকে সেনাসদস্যদের জীপেও তুলে নেয়া হয়।
ঔপনিবেশিক আমল থেকে বিদ্যমান ঢাকা ক্লাবের একজন নৈশপ্রহরী এসময় ক্লাবের দরোজা বন্ধ করতে গেলে তাকেও গুলি করে হত্যা করা হয়। রেসকোর্স ময়দানের রমনা কালীমন্দিরে বসবাসরত একদল পাকিস্তানী হিন্দুকে হত্যা করা হয়েছে। খোলা জায়গায় থাকা ছাড়া দৃশ্যত তাদের আর কোন অপরাধ ছিল না।
ঢাকা থেকে বেরুবার সব পথ সৈন্যরা অবরোধ করার কারণে শহরে পুনরায় ফিরে আসা শরণার্থীদের ভাষ্য, সৈন্যদের এড়াতে গিয়ে বিপুলসংখ্যক লোক গুলি খেয়ে মারা গেছে। ঐসব সড়কের অবরোধ করা স্থানগুলো কমবেশি জনমানব শূন্য। এখনো সেসব স্থানে নির্মূল অভিযান চলছে। অন্যত্র কি ঘটছে সেনাবাহিনী ছাড়া কারো পক্ষেই তা অনুমান করা অসম্ভব।
আবার অনেকেই জনস্রোত এড়াতে সড়ক পথের পরিবর্তে নদী পথে শহর ছাড়ার চেষ্টা চালায়। আর নৌকার জন্য অপেক্ষা করতে গিয়ে ফের কারফিউ জারি হওয়ায় আটকে পড়ার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে অনেকে। শনিবার বিকালে অপেক্ষারত এমন একদল লোকের বসার জায়গায় পরদিন সকালে তাদের রক্তধারা ছাড়া আর কিছুই অবশিষ্ট ছিল না।
“বিশ্বাসঘাতকতার” অভিযোগ
ঢাকা বা প্রদেশটির অন্য কোথাও সৈন্যদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ সংঘটিত হওয়ার আলামত দেখা যায়নি। পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা কর্মকর্তারা তাদের বিরুদ্ধে কারো প্রতিরোধ যুদ্ধ শুরু করার ধারণা ব্যঙ্গসহকারে উড়িয়ে দিয়েছে। পাঞ্জাবী এক লেফটেন্যান্টের ভাষ্য, “এসব লোক চেষ্টা করলেও আমাদের হত্যা করতে পারবে না।”
অন্য এক সেনাকর্মকর্তা বলেছে, “এখন পরিস্থিতি অনেক ভাল। কেউ আর কিছু বলতে রাস্তায় নামতে পারবে না। তা করলে আমরা তাদের হত্যা করবো। তারা অনেক বকেছে। তারা বিশ্বাসঘাতক এবং আমরা তা নই। আল্লাহর নামে আমরা অখণ্ড পাকিস্তানের জন্য লড়ছি।”
পূর্ব পাকিস্তানে নিয়োজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক গভর্নর লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খানই দৃশ্যত এ অভিযানের পরিকল্পনা করেছেন এবং তাতে নেতৃত্ব দিচ্ছেন। বাঙালিদের ভেতর থেকে প্রতিরোধের সর্বশেষ প্রচেষ্টা নস্যাতে এ অভিযান সফলও হয়েছে।
ঢাকার বাইরের কোথাও থেকে একদল আন্ডাগ্রাউন্ড বামপন্থীর গোপন বাংলাদেশ বেতার ছাড়া ভারতীয় সরকারের গণমাধ্যমের প্রোপাগান্ডার মাঝেই কেবল লড়াই ব্যাহত রয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালি জনসাধারণ গণতান্ত্রিক পথের যে স্বপ্ন দেখেছিল গত সপ্তাহের বেদনাদায়ক ও বীভৎস গণহত্যার মধ্য দিয়ে তা নস্যাৎ হয়ে গেছে। হয়তো সময় এ ক্ষতে প্রলেপ দেবে। তবে এই মর্মান্তিক ও বেদনাদায়ক দুঃস্বপ্ন ভুলতে তাদের কয়েক প্রজন্ম লেগে যেতে পারে।
শেখ মুজিবের আন্দোলন থেকে কেবল এ উপলব্ধি ঘটে যে সেনাবাহিনীকে কখনোই খাটো করে দেখা যাবে না। সেই সঙ্গে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া জনগণের কাছে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেওয়ার ব্যাপারে যত কথাই বলুন না কেন, ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী কোন নির্বাচনের ফলই মেনে নেবে না- তা নিরপেক্ষ হোক, আর নাই হোক।
পাকিস্তানি সেনাবাহিনী একাত্তরের ২৫ মার্চ রাতে বাংলাদেশের মানুষের ওপর গণহত্যা শুরু করে। মুক্তিযুদ্ধের নয় মাস ধরে চলে তাদের গণহত্যা। দীর্ঘ নয়মাসব্যাপী সংগঠিত বিস্তৃত ঘটনাবলীর সচিত্র প্রতিবেদন যা পৃথিবীর বিভিন্ন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছে সেসব একাধারে সংগ্রহ করেন তৎকালীন কমার্স ব্যাংকে কর্মরত ব্যাংকার, লেখক ফজলুল কাদের কাদেরী। ওইসব প্রতিবেদন সংগ্রহ করে তিনি তৈরি করেন ‘Bangladesh Genocide and World Press’ গ্রন্থটি। যেটি পাকিস্তানিদের গণহত্যার প্রথম প্রামাণ্য দলিল। এই বইয়ে সায়মন ড্রিং এর লেখাটি প্রথমদিকে স্থান পায়।
এসি