ঢাকা, রবিবার   ২৪ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১০ ১৪৩১

স্মরণ

বুরহান সিদ্দিকী ছিলেন ব্যতিক্রমধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের মানুষ

মোহাম্মদ ইউসুফ

প্রকাশিত : ১০:১২ পিএম, ২৫ জুলাই ২০২১ রবিবার

মরণঘাতী করোনাকালে মৃত্যুর কাতারে আরেক বিশিষ্টজনের নাম য়ুক্ত হলো। তবে করোনায় নয়,দূরারোগ্য ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করে তিনি হেরে যান। জীবনযুদ্ধে পরাভূত এ মানুষটি হলেন সাবেক মন্ত্রী ও রোটারি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের অবিভক্ত জেলা গভর্নর ইঞ্জিনিয়ার এল কে সিদ্দিকীর ছোটভাই সাবেক সচিব,আইজিপি ও কূটনীতিক বুরহান সিদ্দিকী। গত ১৮জুলাই ২০২১ মধ্যরাতে রাজধানীর ইউনাইটেড হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। রাজারবাগ পুলিশলাইন ও চট্টগ্রামের সীতাকু-ের রহমতনগর গ্রামের বাড়িতে দু’দফায় রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় জানাজাশেষে তাঁকে পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয়।

আবু ইউসুফ বুরহানুল ইসলাম সিদ্দিকী (এ ওয়াই বি আই সিদ্দিকী), বুরহান সিদ্দিকী হিসেবে পরিচিত ছিলেন। বাবা আবুল মনসুর লুৎফে আহমেদ সিদ্দিকী বরিশাল জেলার তৎকালীন ফিরোজপুর মহাকুমায় ম্যাজিস্ট্রেট থাকাকালে ১৯৪৫ সালের ১ জানুয়ারি বুরহান সিদ্দিকী সেখানে জন্মগ্রহণ করেন। বাবার কর্মস্থল ফরিদপুর, কিশোরগঞ্জ ও নিজগ্রাম রহমতনগরে প্রাথমিক শিক্ষা শেষ করে বুরহান সিদ্দিকী ১৯৫৫ সালে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে ভর্তি হন। লেখাপড়ার পাশাপাশি তিনি সঙ্গীতশিল্পী হিসেবেও সকলের নজর কাড়েন। ১৯৬০ সালে তিনি এ স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মেট্রিক পাস করেন। অতঃপর চট্টগ্রাম সরকারি কলেজ থেকে আই.এসসি পাশ করার পর ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ে অনার্স কোর্সে অধ্যয়নকালে ইন্টারউয়িং স্কলারশিপ করেন এবং পাকিস্তানের লাহোরে সরকারি কলেজে বি.এসসি অনার্স-এ পড়ালেখা শুরু করেন। ১৯৬৫ সালে জিওলজিতে অনার্স সম্পন্ন করে তিনি পাঞ্জাব বিশ^বিদ্যালয় থেকে জিওফিজিক্সে এম,এসসি ডিগ্রি লাভ করেন।

শিক্ষাজীবন শেষ করে বুরহান সিদ্দিকী পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যাপনার পর পাকিস্তান জিওলজিক্যাল সার্ভে প্রতিষ্ঠানে সহকারি পরিচালক হিসেবে যোগদান করেন। ১৯৭০ সালে বুরহান সিদ্দিকী পাকিস্তান পুলিশ সার্ভিস-এ তৎকালীন পিএসপি পদে যোগদান করেন। পুলিশ একাডেমিতে প্রশিক্ষণকালে তিনি শ্রেষ্ঠ প্রশিক্ষার্থী পুলিশ অফিসার হিসেবে রাষ্ট্রপতি গোল্ড মেডেল ও বেস্টম্যান কাপ অর্জন করেন। প্রশিক্ষণ পর্ব শেষ করে তিনি মহাকুমা পুলিশ অফিসার হিসেবে তৎকালীন ফিরোজপুর ও গোপালগঞ্জ মহাকুমায় দায়িত্ব পালন করেন। চাকরির ৪বছরের মাথায় তিনি এডিশনাল এসপি পদে উন্নীত হয়ে ঢাকা ও রংপুর জেলায় সততা ও নিষ্ঠার সাথে চাকরি করেন। এরপর তিনি পুলিশ হেডকোয়াটার্সে এআইজি (অর্থ ও উন্নয়ন) হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন।১৯৮১ সালে তিনি আবুধাবিতে অবস্থিত বাংলাদেশ দূতাবাসে প্রথম সচিব হিসেবে যোগ দিয়ে দীর্ঘ ৫বছর এ পদে তাঁর সততা ও মেধার স্বাক্ষর রাখেন। পরবর্তীতে সদ্য স্বাধীন নামিবিয়ায় বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশন চালু হলে বুরহান সিদ্দিকী ভারপ্রাপ্ত হাইকমিশনার হিসেবে সেখানে অত্যন্ত সফলতা ও দক্ষতার সাথে কাজ করেন।

দেশে ফিরে বুরহান সিদ্দিকী স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব ও সর্বশেষ পুলিশের মহাপরিদর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করলেও অনিয়ম-দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতি তাঁকে কখনো স্পর্শ করতে পারেনি। অথচ এ ধরনের পদে থেকে কোটি কোটি টাকা আয় করা প্রচলিত সংস্কৃতিতে অত্যন্ত সহজ ব্যাপার। সকলপ্রকার লোভ-লালসার ঊর্ধ্বে থেকে তিনি তাঁর ওপর অর্পিত সকল সরকারি দায়িত্ব পালন করেন। দেশের প্রতি গভীর মমত্ববোধ থাকায় স্বীয় দায়িত্ব সুষ্ঠুভাবে পালনের মাধ্যম দেশপ্রেমের সমুজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন তিনি। ব্যতিক্রমধর্মী চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন তিনি। নীতি-নৈতিকতার প্রশ্নে ছিলেন বরাবরই আপোসহীন। অত্যন্ত বিনয়ী, ন্যায়নিষ্ঠ, সৎ. নিবেদিতপ্রাণ সরকারি এ আমলা ছিলেন আগাগোড়াই একজন ভদ্রলোক। সকলকে তিনি ‘আপনি’ বলেই সম্মোধন করতেন। বাবার চাকরির সুবাদে তাঁর জন্ম, বেড়েওঠা, লেখাপড়া বাইরের পরিবেশে হওয়ায় পিতৃভূমির সাধারণ মানুষের সাথে ততোটা সখ্যতা গড়ে ওঠেনি। 

স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যমন্ত্রী প্রয়াত এম আর সিদ্দিকীর জ্ঞাতিভাই, বনেদী পরিবারের সন্তান বুরহান সিদ্দিকী নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে সীতাকু- সংসদীয় এলাকায় আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন পাচ্ছেন- –এমন খবর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছিলো। দশম জাতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি থেকে তাঁকে দলীয় মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি এলাকায় এসে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করেছিলেন। কিন্তু দলের আরেকটি অংশের প্রভাবে দলীয় হাইকমান্ড তাঁর মনোনয়ন বাতিল করে লায়ন আসলাম চৌধুরীকে মনোনয়ন দেয়া হলে তিনি মনে ভীষণ আঘাত পেয়েছিলেন। নির্বাচন করার কথা মাথায় আসায় হয়তো সেদিন তিনি সংবাদকর্মী হিসেবে আমার সাথে সখ্যতা গড়ে তুলেছিলেন। কালক্রমে তাঁর সাথে আমার অন্যরকমএকটা সম্পর্ক তৈরি হয়েছিলো। মুঠোফোনে প্রায় আমার সাথে তাঁর কথা হতো এবং এলাকার রাজনীতিসহ বিভিন্ন বিষয়ে খোঁজখবর নিতেন। এমপি হলে সীতাকু-ের সার্বিক উন্নয়নে কী করবেন- তেমনএকটা কর্মপরিকল্পনাও প্রণয়ন করেছিলেন তিনি। কিন্তু সীতাকু-ের উন্নয়ন ভাবনা তিনি বাস্তবায়ন করে যেতে পারেননি। তবে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের সচিব থাকার সময় বুরহান সিদ্দিকী সীতাকু-ের রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোগত উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখেন। বিশেষ করে সীতাকু- পৌরসভা কার্যালয় ভবন, জেলা পরিষদ অডিটোরিয়াম (এল কে সিদ্দিকী স্কয়ার), সীতাকু- উপজেলা মহিলা মার্কেট স্থাপন করে পৌরসদরের চেহারায় আমূল পরিবর্তন আনেন। শিবপুর-ইদিলপুর সড়ক, শনি ঠাকুর মন্দির সড়কসহ সীতাকু-ের যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে তাঁর যথেষ্ট অবদান রয়েছে। এছাড়া তিনি চট্টগ্রাম ওয়াসাসহ সরকারি বিভিন্ন বিভাগে সীতাকু-ের অনেকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করেছিলেন।  

অবসরে এসে বুরহান সিদ্দিকী সঙ্গীতচর্চায় যুক্ত হন। তাঁর সহধর্মিনীও সঙ্গীতশিল্পী। এ শিল্পীদম্পতির কণ্ঠে ধারণকরা ২শ’ বাংলা গানের দুটি সিডি বের হয়েছে সম্প্রতি। বুরহান সিদ্দিকীর কণ্ঠে রবীন্দ্রনাথের প্রেম-পূজা ও প্রকৃতি নিয়ে ১শটি গান নিয়ে তৈরি হয়েছে ‘অপরূপ তোমার বাণী’। অন্যদিকে রেহানা সিদ্দিকীর কণ্ঠে ধারণ করা হয়েছে ৬০টি মৌলিক ও ৪০টি পঞ্চকবির গান। তাঁর অ্যালবামের নাম ‘কিছু কথা কিছু স্মৃতি’। এছাড়া রেহেনা সিদ্দিকী ফর ইউ ফর এভার নামে (ফাইপে) একটি বেসরকারি সংস্থার প্রধান নির্বাহী। ব্যক্তিগতজীবনে তাঁরা এক পুত্র ও এক কন্যাসন্তানের জনক। ছেলে লুৎফে সিদ্দিকী ইউনাইটেড ব্যাংক অব সুইজারল্যান্ড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক। মেয়ে হুসনা সিদ্দিকী লন্ডনে একটি বেসরকারি স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে পরামর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন। 

লেখক: প্রধান-সম্পাদক- সাপ্তাহিক চাটগাঁর বাণী ও চাটগাঁরবাণীডটকম

আরকে//