ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

‘প্লাস্টিক-খেকো’ ফাঙ্গাসের আবিষ্কার

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০১:১৩ পিএম, ৩১ জুলাই ২০২১ শনিবার

ফাংগাসের প্লাস্টিক খাওয়ার দৃশ্য

ফাংগাসের প্লাস্টিক খাওয়ার দৃশ্য

প্লাস্টিকের বর্জ্য সহজে পচে-গলে মাটিতে মিশে যায় না। ঠিক সে কারণেই প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবেশের জন্য এত বড় হুমকি হয়ে উঠেছে। কিন্তু প্লাস্টিক বর্জ্য প্রকৃতিতে মিশে যাবার কাজটা পানির মত সহজ হয়ে যাবে এমন একটি পদ্ধতি আবিষ্কার করেছেন এক বিজ্ঞানী।

অন্য এক বিষয়ে গবেষণার কাজ করতে গিয়ে দৈবক্রমে সামান্থা জেংকিনস নামে এ গবেষক আবিষ্কার করেছেন এমন একটি ফাংগাস বা ছত্রাক, যা প্লাস্টিক-খেকো।

পৃথিবীর দেশে দেশে পরিবেশ দূষণের এক অন্যতম কারণ হলো প্লাস্টিক। যে কোন বড় শহরের আবর্জনার স্তূপের দিকে তাকান, সবখানেই দেখতে পাবেন হাজার হাজার, লাখ লাখ প্লাস্টিক। এখন সারা পৃথিবীতে মহাসাগরের গভীর তলদেশেও ছড়িয়ে গেছে, ঢুকে পড়েছে তিমির মত নানা প্রাণীর পেটে, মানুষের খাবারে, এমনকি মানব ভ্রুণের প্ল্যাসেন্টাতেও ঢুকে পড়েছে প্লাস্টিকের কণা।

অন্য আবর্জনার মত প্লাস্টিক পচে-গলে মাটিতে মিশে যায় না, এটা টিকে থাকে শত শত বছর। কিছু প্লাস্টিক রিসাইকল করা যায়, কিন্তু অন্য কিছু প্লাস্টিক রিসাইকেল করা খুব কঠিন। এক ধরনের প্লাস্টিক আছে যাকে বলে পিইটি (পলিইথাইলিন টেরেপথালেট), যা ব্যবহার করা হয় নানা রকমের পানীয়ের বোতল তৈরির জন্য। এগুলো সহজে নষ্ট হয়না।

সামান্থা জেংকিনস ঠিক করলেন, এই পিইটি’কে ফাংগাস দিয়ে ধ্বংস করা যায় কিনা সেটাই পরীক্ষা করে দেখবেন। তার আবিষ্কৃত ফাংগাসটি পিইটি আর পলিইউরিথেনের ওপর পরীক্ষা করে দেখেন তিনি।

পরীক্ষায় তিনি দেখলেন, ‘প্লাস্টিক দিচ্ছেন, ফাংগাসটা সেই প্লাস্টিক খেয়ে ফেলছে। তারপর ফাংগাস জন্ম দিচ্ছে আরও ফাংগাসের। আর সেটা থেকে নানা রকম বায়ো-মেটিরিয়াল বা জৈবপদার্থ তৈরি হচ্ছে। আর সেটা নানা কাজে লাগানো যাচ্ছে। যেমন- খাবার তৈরির জন্য, পশুর জন ফিডস্টক তৈরিতে, এমনকি এন্টিবায়োটিক তৈরির কাজে।’

সামান্থা জেংকিন্স হচ্ছেন বায়োহম নামে একটি বায়ো-ম্যানুফ্যাকচারিং ফার্মের প্রধান বায়োটেক প্রকৌশলী।
তার কোম্পানির একটি গবেষণা প্রকল্পের কাজের জন্য তিনি কয়েকরকম ফাংগাস নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছিলেন। এর মধ্যে একটি ফাংগাস এমন একটা কাণ্ড করে বসলো যে তার গবেষণার গতিপথ ঘুরে গেল অন্যদিকে।

‘একটা জার ভর্তি আছে শস্যকণা- তার ওপরে এক দলা ফাংগাস গজিয়েছে। এর মধ্যে উত্তেজনাকর বা আকর্ষণীয় কিছু ছিল না। কিন্তু যেই জারটা খোলা হলো, দেখা গেল দারুণ এক ব্যাপার ঘটে গেছে।’

জেংকিন্স দেখলেন, জারটা বায়ুরোধী করার জন্য যে প্লাস্টিকের স্পঞ্জ দেয়া ছিল ফাংগাসগুলো সেটাতে ক্ষয় ধরিয়েছে এবং অন্য যে কোন খাবারের মতই সেটাকে হজম করে ফেলেছে।

জেংকিন্সের প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল জৈব-ভিত্তিক পদার্থকে ইনসুলেশন প্যানেল তৈরিতে কীভাবে ব্যবহার করা যায় সেটা পরীক্ষা করা। কিন্তু এই প্লাস্টিক-খেকো ‘ক্ষুধার্ত ফাংগাস’ তাদের গবেষণাকে নিয়ে গেল অন্য আরেক দিকে।

বায়োহম এখন কাজ করছে কিভাবে এই ফাংগাসের আরও শক্তিশালী একটা জাত তৈরি করা যায়। যা হয়তো একসময় প্লাস্টিক বর্জ্য থেকে পরিবেশকে মুক্ত করতে পারবে।

সামান্থা জেংকিনস

এ নিয়ে আরও কিছু বিজ্ঞানী কাজ করে সাফল্য পেয়েছেন।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা সম্প্রতি ই-কোলাই নামে একধরনের ব্যাকটেরিয়ার ল্যাবরেটরিতে তৈরি সংস্করণ ব্যবহার করেছেন টেরেপথ্যালিক এসিডকে ভেঙে ভ্যানিলিন তৈরির কাজে। যা খাবারের সুগন্ধি হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই টেরেপথ্যালিক এসিড হচ্ছে পিইটি থেকে পাওয়া একটি অণু।

এডিনবরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বায়োলজিক্যাল সায়েন্সেস-এর ড. জোয়ানা স্যাডলার বলছেন, ‘আমাদের পরীক্ষা-নিরীক্ষা এখনও প্রাথমিক স্তরে রয়েছে। এই প্রক্রিয়াটিকে কার্যকর ও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক করার জন্য আরও কাজ করতে হবে। কিন্তু এটি অত্যন্ত উত্তেজনাকর সূচনা এবং এ প্রক্রিয়াটাকে উন্নত করার পরে ভবিষ্যতে এর বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহারযোগ্য হবার সম্ভাবনাও আছে।’

অন্যদিকে জার্মানির লাইপজিগে হেলমহোল্টৎস সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল রিসার্চের একটি দল আরেকটি গবেষণায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি ঘটিয়েছে। এই দলটি ‘সিউডোমোনাম এসপি টিডিএ-ওয়ান’ নামে এক ধরনের ব্যাকটেরিয়াকে পলিইউরিথেন ভাঙার জন্য ব্যবহার করছে।

স্থানীয় একটি আবর্জনা ফেলার জায়গায় এই ব্যাকটেরিয়াটি পাওয়া গিয়েছিল। দেখা যাচ্ছে, এই ব্যাকটেরিয়া প্লাস্টিকের কিছু অংশ খেয়ে ফেলে, আর বাকি অংশ কার্বনডাইঅক্সাইড হিসেবে বাতাসে মিশে যায়। সিউডোমোনাস তার এনজাইম ব্যবহার করে পলিইউরিথেনকে ভেঙে ফেলে। এছাড়া অন্য আরো কিছু ক্ষুদ্র অণুজীব আছে যারা প্লাস্টিক খায়।

লাইপজিগের গবেষক দলটি এই ব্যাকটেরিয়ার জিনোম বিশ্লেষণ করেছে, যাতে এসব এনজাইমের জেনেটিক গঠন বের করা যায়।

মিশিগান স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক রামানি নারায়ণ বলছেন, এগুলো খুবই আগ্রহ-উদ্দীপক গবেষণা, তবে এসব প্রযুক্তিকে বর্তমানে প্রমাণিত বাণিজ্যিক পদ্ধতিগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করতে হবে।

সূত্র: বিবিসি বাংলা

এএইচ/