ঢাকা, বুধবার   ২৭ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ১২ ১৪৩১

৫০-এ ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১০:৫৩ এএম, ১ আগস্ট ২০২১ রবিবার

১৯৭১। উত্তাল বাংলাদেশ। একটি স্বাধীন দেশের মানচিত্রের জন্য পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে চলছে অসম লড়াই। হায়েনাদের বর্বরতার শিকার হয়ে মরছে লাখো মানুষ। ঠিক সেই সময়ে হাজার হাজার মাইল দূরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে রচিত হলো এক অনন্য ইতিহাস। যেখানে মুক্তিকামী মানুষের পক্ষে ‘কনসার্ট ফর বাংলাদেশ’-এ সুরের ঝংকার তুললেন মানবতাবাদী একদল শিল্পী। যা মুহূর্তেই নাড়িয়ে দেয় গোটা বিশ্বকে। বাংলাদেশের অস্তিত্বের সঙ্গে মিশে থাকা ঐতিহাসিক সেই সংগীতানুষ্ঠানের ৫০ বছর পূর্তি আজ। ১৯৭১ সালের ১ আগস্ট ছিল সেই দিন।

বাংলার মানুষের ওপর পাকিস্তানিদের নৃশংসতা আর মানবতার বিপর্যয় দেখে অন্য অনেকের মতো প্রাণ ডুকরে কেঁদে উঠেছিল ভারতীয় উপমহাদেশের কিংবদন্তি সেতারবাদক পণ্ডিত রবিশঙ্করের, যাঁর পূর্বপুরুষের ভিটা নড়াইলের কালিয়ায়। তিনি ডাকলেন প্রিয় শিষ্য বিটলস ব্যান্ডের অন্যতম গায়ক জর্জ হ্যারিসনকে। ১৯৬৫ সালে রবিশঙ্করের কাছে সেতারের তালিম নিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। কিন্তু তিন-চার বছর পরই বুঝে গিয়েছিলেন, তাঁর পক্ষে ভালো সেতারবাদক হওয়া সম্ভব নয়। তাই সেতার ছাড়লেন। কিন্তু ‘গুরুদক্ষিণা’ বাকি থেকে গিয়েছিল। একাত্তরে জর্জ হ্যারিসনের কাছে যেন সেই গুরুদক্ষিণা চাইলেন রবিশঙ্কর। বললেন, বাংলাদেশে যুদ্ধে আক্রান্ত অসহায়দের জন্য কিছু করতেই হবে। দুজনে ঠিক করলেন, বাংলাদেশের পক্ষে বিশ্বজনমত গড়তে এবং অসহায় মানুষের সহায়তায় তহবিল সংগ্রহের জন্য আয়োজন করা হবে একটি কনসার্ট।

এর পর থেকেই জর্জ হ্যারিসন যোগাযোগ করেন খ্যাতিমান শিল্পী বব ডিলান, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রিস্টন, রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেলসহ অন্যদের সঙ্গে, যাঁরা সেই কনসার্টে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। কনসার্টে রবিশঙ্করের সঙ্গে ভারতীয় উপমহাদেশের আরো তিন কিংবদন্তি শিল্পী অংশ নেন। তাঁরা হলেন ওস্তাদ আলী আকবর খান, ওস্তাদ আল্লা রাখা ও কমলা চক্রবর্তী।

কনসার্টের দিনটি ছিল রবিবার। সেদিন প্রথমে একটি শো হওয়ার কথা থাকলেও দর্শক-শ্রোতা বেশি হওয়ায় দুটি শো করতে হয়। টিকিট কেটে দুই শোতেই ৪০ হাজারের মতো মানুষ অংশ নেয়। প্রথম শো শুরু হয় দুপুর আড়াইটায়, দ্বিতীয় শো রাত ৮টায়। 

শুরুতেই দর্শক-শ্রোতাদের উদ্দেশে রবিশঙ্কর বলেন, ‘আমরা কোনো রাজনীতি করতে আসিনি, আমরা শিল্পী। আমরা এই অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে শুধু একটি বার্তাই পৌঁছে দিতে সমবেত হয়েছি। আমরা চাই আমাদের সংগীত আপনাদের বাংলাদেশের মানুষের তীব্র বেদনা আর মনোযন্ত্রণা অনুভব করতে সহায়তা করুক।’

কনসার্ট শুরু হয় সেতারবাদক রবিশঙ্কর, সরোদবাদক আলী আকবর খান, তবলাবাদক আল্লা রাখা ও তানপুরাবাদক কমলা চক্রবর্তীর পরিবেশনা দিয়ে। তাঁরা বাংলাদেশের পল্লীগীতির সুরে ‘বাংলা ধুন’ নামে একটি পরিবেশনা করেন। এরপর একে একে অন্য ব্যান্ডদলের বিখ্যাত শিল্পীরা সংগীত পরিবেশন করেন। সেদিন অনুষ্ঠানের অন্যতম আকর্ষণ ছিলেন প্রতিবাদী গানের রাজা বব ডিলান। তিনি গেয়েছিলেন ছয়টি গান। ডিলানের সঙ্গে গিটার বাজিয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন, ব্যাস লিওন রাসেল ও ট্যাম্বুরিন রিঙ্গো স্টার। অনুষ্ঠানে বিটলসের অন্যতম সদস্য রিঙ্গো স্টার, লিওন রাসেল, এরিক ক্ল্যাপটন, বিলি প্রেস্টন, ডন প্রেস্টন প্রমুখ গান গেয়েছেন, গিটার বাজিয়েছেন।

একটি দেশের জন্য বিশ্বের অন্যান্য দেশের গায়কদের একত্রে এমন গান করার ইতিহাস নেই বললেই চলে। সেই অনুষ্ঠানে আটটি গান গেয়েছিলেন জর্জ হ্যারিসন। সবার শেষে নিজের লেখা ও সুরে গাইলেন তাঁর কালজয়ী ‘বাংলাদেশ বাংলাদেশ’ গানটি।

পরবর্তীকালে এই কনসার্ট প্রসঙ্গে জর্জ হ্যারিসন একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘প্রকৃতপক্ষে এটা ছিল রবিশঙ্করের পরিকল্পনা। সে কিছু একটা করতে চেয়েছিল। আমার সঙ্গে কথা বলে সে তার উদ্বেগের কথা জানায়। জানতে চায়, আমার কোনো পরামর্শ আছে কি না। এরপর আমরা শো করার বিষয়টি নিয়ে অর্ধেক রাত পর্যন্ত কথা বলি। তারপরই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম আমি অনুষ্ঠানটি করব। তখন অনেককে একত্র করার চেষ্টা করি। আমাকে কিছু জিনিস সংগঠিত করতে হয়েছিল; তার মধ্যে ছিল ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেন। আসলে এটাই। পরিকল্পনা থেকে শুরু করে সফলভাবে এর বাস্তবায়ন পর্যন্ত এই পুরো আয়োজনটি সম্পন্ন করতে মাত্র চার সপ্তাহ সময় লেগেছিল।’

দুটি বেনিফিট কনসার্ট ও অন্যান্য অনুষঙ্গ থেকে পাওয়া অর্থ প্রায় আড়াই লাখ ডলার ইউনিসেফের মাধ্যমে বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য ব্যবহৃত হয়েছিল। প্রকাশিত হয় কনসার্টের লাইভ অ্যালবাম, যা রীতিমতো বিক্রির রেকর্ড গড়ে। একটি বক্স থ্রি রেকর্ড সেট এবং অ্যাপল ফিল্মসের তথ্যচিত্র ১৯৭২ সালে চলচ্চিত্র আকারে প্রকাশিত হয়। ১৯৭৩ সালে যা বেস্ট অ্যালবাম হিসেবে জিতে নেয় গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড।  

সেদিনের জগদ্বিখ্যাত তারকাদের অংশগ্রহণে কনসার্টটির প্রভাব ছিল ব্যাপক ও সুদূরপ্রসারী। বিশেষ করে সেই কনসার্টের প্রতিক্রিয়া হয়েছে অনেক। যাতে করে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষ জেনেছিলেন বাংলাদেশের নাম। গোটা বিশ্ব সেদিন আরও ভালো করে জেনেছিল, পাকিস্তানি হায়েনারা কী তাণ্ডবই না চালাচ্ছে বাংলার সবুজ জমিনে। মানুষের হৃদয় ছুঁয়েছে, মনে দাগ কেটেছে সেই আয়োজন।

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে জর্জ হ্যারিসনের ঐতিহাসিক সংগীতের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে তার কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অ্যালবামটি নিয়ে প্রকাশিত হলো ডিজিটাল বই।

শনিবার (৩১ জুলাই) আইসিটি বিভাগের আইডিয়া প্রকল্পের ব্যবস্থাপনায় এটি প্রকাশ করেছে অ্যাপেক্স ডেটা মাইনিং অ্যান্ড আইটি। ভার্চুয়ালি এই বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করেন আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক।

এসময় বঙ্গবন্ধু উত্তর সময়ে তার ঘোষিত সোনার বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠায় সাংস্কৃতিক বিপ্লবের ডাক দিয়ে সকলকেই প্রযুক্তি-শক্তিতে বলীয়ান হওয়ার আহ্বান জানান তিনি।
এসএ/