ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

কুলিয়ারচরে ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ

কুলিয়ারচর (কিশোরগঞ্জ) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ০৬:৩৯ পিএম, ৮ আগস্ট ২০২১ রবিবার

শিক্ষক নিয়োগে অর্থ লেনদেন। মাধ্যমিক পরীক্ষার্থীদের ফরম পূরণে অতিরিক্ত অর্থ আদায়। কারণ ছাড়াই শিক্ষকদের বেতন কেটে নেওয়া এমন অভিযোগের অন্ত নেই কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের লক্ষ্মীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে। স্কুল পরিচালনা কমিটির প্রধান হয়েও একের পর এক অনিয়ম-দুর্নীতিতে জড়াচ্ছেন তিনি। এতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সুনাম ক্ষুণ্যের পাশাপাশি অসন্তোষ তৈরি হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-কর্মচারীদের মধ্যে।

স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, একসময় বিএনপি-জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন নুরুল ইসলাম। কিন্তু ক্ষমতার পট পরিবর্তনে নিজেকে বদলে ফেলেছেন তিনি। আওয়ামী লীগের কোনো পদ-পদবি বাগাতে না পারলেও দলীয় প্রভাব ব্যবহারের অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।

জনপ্রতিনিধি হতে দুইবার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান/সদস্য পদে প্রার্থী হলেও একবারও জয়ী হতে পারেননি। অভিযোগ আছে, এলাকার উন্নয়ন কাজেও বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন নুরুল ইসলাম। তার ইন্ধনেই লক্ষ্মীপুরের মাতুয়ারকান্দা থেকে লক্ষ্মীপুর বাজার পর্যন্ত সড়কের নির্মাণ কাজ বন্ধ হয়ে যায়।

কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচর উপজেলার লক্ষীপুর গ্রামে ১৯৪৭ সালে লক্ষ্মীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হয়। এই প্রতিষ্ঠানের সাবেক শিক্ষার্থীদের অনেকে সরকারি-বেসরকারি বড় বড় পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। নুরুল ইসলাম স্বনামধন্য এই প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির পদে দায়িত্ব পাওয়ার পর নানা অনিয়ম শুরু হয়।

বিদ্যালয়ের শিক্ষক ও কর্মচারীরা বিভিন্ন সময় নুরুল ইসলামের মাধ্যমে নানাভাবে নির্যাতিত হচ্ছেন। কিন্ত এসব বিষয়ে প্রকাশ্যে কেউ কথা বলতে সাহস পান না। বিশেষ করে নুরুল ইসলাম সভাপতির দায়িত্ব নেওয়ার পর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটিতে অযোগ্যদের টাকার বিনিময়ে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

স্থানীয় পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নুরুল ইসলামকে ঘুষ না দেওয়ায় অনেক শিক্ষার্থী উপবৃত্তির টাকা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। তাদের একজন বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী সাইমা আক্তার। তার বাবা দৌলত মিয়া কৃষিকাজের সঙ্গে জড়িত। কষ্টের সংসারে কোনভাবে মেয়েকে পড়াশোনা করাচ্ছেন তিনি। স্কুল থেকে মেয়ের উপবৃত্তি পেতে বেশ কয়েকবার ধরনা দেন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানটির সভাপতি নুরুল ইসলামের কাছে। কিন্তু দেড় হাজার টাকা ঘুষ না দেওয়ায় উপবৃত্তির তালিকায় নাম দেওয়া হয়নি সাইমার।

দৌলত মিয়া বলেন, ‘আমি একজন গরীব মানুষ। খুব কষ্ট করে মেয়েটারে স্কুলে পড়াইতেছি। শুনেছি স্কুল থেকে ছাত্রছাত্রীরা নাকি উপবৃত্তি টাকা পায়। সেজন্যই স্কুলের সভাপতি নুরুল ইসলামের কাছে কয়েকদিন গিয়েছি। কয়েকবার আমাকে ঘুরিয়ে সবশেষ তিনি বললেন, আমাকে (নুরুল) ১৫০০ টাকা দিতে পারবা? যদি দিতে পারো তাহলে তোমার মেয়ে উপবৃত্তির টাকা পাবে। উত্তরে আমি বলি এত টাকা আমার কাছে নেই; থাক আমার উপবৃত্তি লাগবে না।’

নাম প্রকাশ না শর্তে এই স্কুলের আরেক শিক্ষার্থীর বাবার অভিযোগ উপবৃত্তির তালিকায় তার সন্তানের নাম ছিল। সবাই উপবৃত্তির টাকা মোবাইলে পাচ্ছিল; কিন্তু তার সন্তানের টাকা আসেনি। বিষয়টি নিয়ে তিনি স্কুলে গিয়ে সভাপতির সঙ্গে কথা বলেন। এ সময় সভাপতি তার সঙ্গে খারাপ ব্যবহার করেন এবং স্কুল থেকে বের করে দেন। এ সময় সভাপতি বলেন, ‘যারা টাকা দিয়েছে তাদের নামই তালিকায় এসেছে। তুমি টাকা দেও নিই, তাহলে টাকা আসবে কিভাবে?’

লক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা রহমত উল্লাহ। তিনি বলেন, ‘স্কুলের কাছের বাজারে বসে প্রতিদিনই চা খাই। সেখানে স্কুলের শিক্ষার্থীদের অভিভাবকরা সভাপতি নুরুল ইসলামের বিরুদ্ধে নানান অভিযোগের কথা বলেন। বিশেষ করে উপবৃত্তির তালিকায় নাম উঠানোর কথা বলে ‘বাড়তি টাকা’ নেওয়ার কথা বেশি শোনা যায়। অনেকে এসএসসির ফরমপূরণে বাড়তি টাকা নেওয়ার অভিযোগ বেশি করেন। তবে তার বিরুদ্ধে সরাসরি প্রতিবাদ করার সাহস কারও নেই।’

রহমত বলেন, ‘উনি (নুরুল) শুধু স্কুল নয় গ্রামের মধ্যেও বিভিন্ন ইস্যুতে মানুষের মধ্যে ঝগড়া ফ্যাঁসাদা সৃষ্টি করেন। এলাকার গ্রাম্য শালিশে সুষ্ঠু বিচার না করে কীভাবে সমস্যাটা লাগিয়ে রাখা যায়, সেটা বেশি করেন। আবার যেদিক থেকে বেশি টাকা পান, সেদিক টেনে বিচার করেন। নুরুল ইসলাম নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেন। কিন্তু গ্রামের মুরব্বিরা বলেন- তিনি কখনও মুক্তিযুদ্ধ করেননি বা মুক্তিযুদ্ধে সহযোগীতাও করেননি।’
১ নম্বর গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়নের বীর মুক্তিযোদ্ধা শামসু উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যখন দেশ স্বাধীনের জন্য বঙ্গবন্ধুর ডাকে প্রথম ভারতে গিয়ে যুদ্ধের ট্রেনিংয়ে গিয়েছিলাম, তখন তো নুরুল ইসলামকে দেখিনি। উনি কোথায় ট্রেনিং ও যুদ্ধ করেছেন সেটাও আমরা জানি না। হঠাৎই উনি নিজেকে মুক্তিযোদ্ধা দাবি করেছেন। এলাকার সবাই জানেন উনি একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আমরা উপজেলা মুক্তিযোদ্ধা সংসদ থেকে সরকারের কাছে আবেদন করেছি, তাকে যেন মুক্তিযোদ্ধা তালিকায় অন্তর্ভুক্ত না করা হয়।’

গোবরিয়া আব্দুল্লাহপুর ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সভাপতি আবু বক্কর বলেন, ‘উনি একসময় বিএনপি ঘরোয়ার মানুষ ছিলেন। পরবর্তীতে সরকারি দলের সমর্থক হিসেবে যুক্ত হন। তবে আওয়ামী লীগে কোন পদ-পদবীতে নেয় তিনি। সরকারি দলের সমর্থক হওয়ায় এলাকায় প্রভাব দেখান। তার অনিয়ম সম্পর্কে লোকমুখে অনেক কথার প্রচলন আছে।’

ইউনিয়ন ছাত্রলীগ সভাপতি মো. কামাল হোসেন বলেন, ‘নুরুল ইসলাম একজন ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা। আর তিনি ইউনিয়ন বা উপজেলা আওয়ামী লীগের কোনো পদে নেই। দলের নাম ভাঙিয়ে এলাকাতে নিজের অবস্থা তৈরি করার জন্য নানার অপকর্ম করছেন। স্কুলের পাশ দিয়ে লক্ষীপুর মাতুয়ারকান্দা থেকে লক্ষীপুর বাজার পর্যন্ত রাস্তা নির্মাণের জন্য প্রকল্প আসে। রাস্তায় মাটি ফেলা শুরু হলে নুরুল ইসলাম বিভিন্ন কৌশলে গ্রামের দুইপাড়ার মধ্যে বিবাদ সৃষ্টি করে। এতে রাস্তার কাজ বন্ধ হয়ে যায়। কারণ কিন্তু উনি (নুরুল) চান না বিদ্যালয়ের পাশ দিয়ে দুই পাড়ার মধ্যে সংযোগ সড়কটি হোক।’

কামাল হোসেন আরো বলেন, ‘এই রাস্তা নির্মাণকে কেন্দ্র করে গ্রামবাসীর মধ্য সংর্ঘষে চার মাসে দুইটি খুন হয়েছে। পরিবারগুলো এখন মানবেতর জীবনযাপন করছে। বিভিন্ন সময় শুনছি নুরুল ইসলাম বলেছেন, ‘দুটি মার্ডার করিয়েছি, আরও হবে। ... আমাকে তো চেনো না।’

স্কুলের একাধিক শিক্ষক নাম প্রকাশ না শর্তে জানান, সম্প্রতি স্কুলের আর্থিক নিরীক্ষা করতে শিক্ষা অফিস থেকে ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসেন। প্রধান শিক্ষক ও সভাপতি সাহেব যখন বুঝতে পারেন অনিয়মের বিষয়টি ধরা পড়ে যাচ্ছেন; তখন তারা আমাদের (শিক্ষকদের) বেতনের টাকা থেকে বিষয়টি বুঝিয়ে দেন। পরে অবশ্যই সেই মাসে শিক্ষকদের বেতন অর্ধেক কেটে নেয়া হয়েছে।’

একাধিক শিক্ষক দাবি করেন, এই সভাপতির আমলে স্কুলে সবচেয়ে বেশি অনিয়ম হচ্ছে। বিশেষ করে- শিক্ষক নিয়োগ, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি ও এসএসসি ফরম পূরণে অতিরিক্ত টাকা নেওয়া হয়। অযোগ্য শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। যা সম্পূর্ণ টাকার বিনিময়ে। তিনচার লাখ করে টাকা নিয়ে মেধাহীনদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু এসব বিষয়ে কেউ কোন কথা বলতে চাই না।’

এসব বিষয়ে অভিযুক্ত লক্ষ্মীপুর দ্বি-মুখী উচ্চ বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতি নুরুল ইসলামের মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হয়। তিনি অভিযোগের বিষয়গুলো শোনার পর গ্রাম্য শালিশে আছেন জানিয়ে পরে কথা বলবেন বলে ফোন কেটে দেন। পরে একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি।

অনিয়মের বিষয়ে জানতে স্কুলের প্রধান শিক্ষক একাধিকবার ফোন করা হলেও তিনি ফোন ধরেননি করেননি।

আরকে//