৭৫ পরবর্তী প্রজন্মের চোখে আগস্ট হত্যাকাণ্ড
বেলায়েত বাবলু
প্রকাশিত : ১১:৪৯ এএম, ১০ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার | আপডেট: ০১:১৮ পিএম, ১০ আগস্ট ২০২১ মঙ্গলবার
১৯৭৫ সালের আগস্ট মাসে বাঙালি হারিয়েছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সন্তান জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। ১৫ আগস্টের কালরাতে ঘাতকরা শুধু বঙ্গবন্ধুকেই হত্যা করেনি, তাদের হাতে একে একে প্রাণ দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুর সহধর্মিনী বঙ্গমাতা বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব, বঙ্গবন্ধুর সন্তান শেখ কামাল, শেখ জামাল, শিশু শেখ রাসেলসহ পুত্রবধূ সুলতানা কামাল ও রোজি জামাল।
পৃথিবীর এই ঘৃণ্যতম হত্যাকাণ্ড থেকে বাঁচতে পারেননি বঙ্গবন্ধুর সহোদর শেখ নাসের, ভগ্নিপতি বরিশালের সন্তান কৃষককূলের নয়ন মনি আব্দুর রব সেরনিয়াবাত, ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি, তার সহধর্মিনী আরজু মনি, সুকান্ত বাবু ও কর্নেল জামিলসহ পরিবারের ১৬ জন সদস্য ও আত্মীয়-স্বজন।
সেনাবাহিনীর কিছুসংখ্যক বিপথগামী সদস্য সপরিবারে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার পর গোটা বিশ্বে নেমে আসে তীব্র শোকের ছায়া এবং ছড়িয়ে পড়ে ঘৃণার বিষবাষ্প। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর নোবেল জয়ী পশ্চিম জার্মানীর নেতা উইলি ব্রানডিট বলেন, মুজিবকে হত্যার পর বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায় না। যে বাঙালি শেখ মুজিবকে হত্যা করতে পারে তারা যে কোনও জঘন্য কাজ করতে পারে।
উইলি ব্রানডিট হয়তো বঙ্গবন্ধুর নির্মম হত্যাকাণ্ড মেনে নিতে না পেরে প্রতিবাদের ভাষায় বলেছিলেন, বাঙালিদের আর বিশ্বাস করা যায়না। কিন্তু যে প্রজন্ম স্বাধীনতা যুদ্ধ দেখেনি অথবা ৭৫ সালেও যাদের জন্ম হয়নি, সেই প্রজন্ম বিশ্বাস করে বঙ্গবন্ধুর মতো মানুষকে হত্যা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, জাতিগতভাবে ঘৃণিত ও জঘন্যতম অপরাধ।
৭৫ পরবর্তী প্রজন্মের চোখে আগস্ট হত্যাকাণ্ড- শিরোনামের প্রতিবেদনে তাদেরই কয়েকজনের অভিব্যক্তি তুলে ধরা হয়েছে, যারা মনে করে একজন মানুষকে হত্যা করেই তাঁর ভিতরকার লালিত স্বপ্নকে হত্যা করা যায় না।
বরিশালের সন্তান, বর্তমান সময়ের ব্যস্ততম চিত্রগ্রাহক ও নাট্য পরিচালক নিয়াজ মাহবুব বলেন, আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি। শুনেছি। ইতিহাস পড়েছি। ভিডিও দেখেছি। এখনও যখন বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শুনি বা তাকে নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র শুটিং করি, চোখ ভিজে আসে, শরীর কেঁপে ওঠে। কোনভাবেই বিশ্বাস হয় না তিনি নেই। মনে হয় যেনো তিনি আমাদের রক্তের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশে আছেন। যখনই মনে পড়ে ১৫ই আগষ্টের হত্যার কথা, বিশ্বাস হয় না। এতটা নির্মম হতে পারে এদেশের মানুষগুলো…. এতটা বিশ্বাসঘাতকতা…. এরকম একজন বীরকে, এরকম একজন সাহসী নায়ককে হত্যা করতে পারে….! হাজার বছর পরেও এ জাতি মনে রাখবে এই মহা নায়কের কথা। আমি বিশ্বাস করি এই মীরজাফররা এখনো মরেনি। আমাদের আশেপাশেই আছে। তাদেরকে চিহ্নিত করে প্রতিশোধ নেয়া উচিত। তা না হলে বঙ্গন্ধুর আত্মা শান্তি পাবে না। শুধু বঙ্গবন্ধু নয়, বঙ্গমাতার কি কম অবদান…. এরকম একজন মাতা কোথায় পাবে এদেশ….যিনি তার জীবিত সময়টুকু এদেশের জন্যই দিয়ে গেলেন। ধানমন্ডির ৩২নং এর বাসায় যখন যাই, শরীর চলে না, পা দুটো যেনো আটকে যায়। শরীরের কোথায় যেনো উত্তেজনা কাজ করে। এক কথায় বলতে হয় এদেশ, এদেশের মানুষ অনেক বড় কিছু হারালো… যা কিনা ফিরে পাবার নয়।
চ্যানেল-২৪ এর বরিশাল প্রধান কাওসার হোসেন রানা বলেন, ১৫ আগস্টে শুধুমাত্র এক রাজনৈতিক ব্যক্তি ও সদস্যরা হত্যাকাণ্ডের শিকার হননি। ওই হত্যাকাণ্ডের মধ্য দিয়ে বাঙালির রাজনীতি, সংস্কৃতি ও অর্থনীতিকে হত্যা করা হয়। তবে কালের পরিক্রমায় আমাদের প্রিয় জন্মভূমি আজ বিশ্বের বুকে তার নিজস্ব স্বকীয়তায় মাথা উচু করে দাঁড়িয়েছে। যা একজন বাঙালি হিসেবে আমাদের সকলের গৌরবের।
তরুন সাংবাদিক ও ঢাকা পোস্টের বরিশাল প্রতিনিধি সৈয়দ মেহেদী হাসান বলেন, মনে রাখা জরুরী বাংলাদেশকে এক কথায় প্রকাশ করা যেতে পারে চির বিপ্লবী কণ্ঠস্বর জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে দিয়ে। ফলে বাংলাদেশকে যে বা যারা মেনে নেয়নি তারা দেশকে ধ্বংস করতে চাইলে প্রথমেই বেছে নিবে দেশটির মূল কণ্ঠস্বর চেপে ধরতে। সেজন্য ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট রচনা করেছিল জাতির অভিশপ্ত রাত। তখন হত্যাকারীরা ৩২ নম্বরে যে গণহত্যা করেছিল তার মাধ্যমে আশান্বিত হয় নব্য স্বাধীন দেশকে আবার সমর্পন করতে পারবে পাকিস্তানের হাতে। কিন্তু ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বিদেশে থাকায় গণহত্যার মিশন সফল হয়নি। তাই ২০০৪ সালে বাঙালীর ও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা শেখ হাসিনাকে কার্যত শেখ মুজিবের বংশ পরস্পরাকে স্তব্ধ করে দিতে ২১ আগস্ট হামলা চালায়। রচিত হয় আগস্ট ট্রাজেডি। এই হত্যা ও হত্যাচেষ্টা শুধু ব্যক্তি পর্যায়ে নয়, জাতিগতভাবে ঘৃণার। চিহ্নিত সেসব হত্যাকারী আমৃত্যু সক্রিয় থাকতে চেষ্টা চালাবে, তবু ভয়াবহ আগস্ট পেরিয়ে আসা বাংলাদেশকে সেই নীল মুখোশওয়ালাদের শাস্তির বিধান করতে হবে। এ প্রজন্ম এটাই চায়।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ বরিশাল মহানগরের ১৯ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক মহিলা বিষয়ক সম্পাদক রোমানা বাবলু বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সর্ম্পকে যতোটুকু শুনেছি, তা এক কথায় বলতে গেলে তাঁর মতো মহান ব্যক্তি বাঙালি জাতির জন্য ভীষণ প্রয়োজন ছিলো। যিনি নিজের জীবনকে ভাল না বেসে আজীবন বাংলাদেশ এবং এ দেশের মানুষকে ভালবেসে গেছেন। তাঁকে যারা হত্যা করতে পেরেছে তারা কতোটা বর্বর তা সহজেই অনুমান করা যায়। অনেকের কাছে হয়তো ভাল লাগবেনা, তারপরেও বলি- বঙ্গবন্ধুর মতো এখন আর কেউ এই দেশটাকে ভালোবাসে না। দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ মানুষগুলোও আজ বড্ড অসহায়।
বাংলা নিউজ-এর স্টাফ রিপোর্টার মুশফিক সৌরভ বলেন, নিঃসন্দেহে ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড একটি বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ড। আমি শুধু এটুকু বুঝি, যারা বেঁচে আছেন তাদের ভয়াল সেই রাত, আর তার পরের দিনগুলোর কথা সবার সামনে তুলে ধরা উচিত।
নিউজ বাংলা’র ডিভিশনাল করেসপন্ডেন্ট ও দৈনিক যুগান্তর’র রিপোর্টার তন্ময় তপু বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টে যে হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয়েছিলো, তার একমাত্র উদ্দেশ্যেই ছিলো জাতিকে শেষ করা। জাতির জনককে হত্যার মধ্য দিয়ে এ দেশকে পুনরায় পাকিস্তান করা। কিছু সময়ের জন্য হলেও সফল হয়েছিলো হায়েনারা। স্ব-পরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে জাতি অনেকটা পিছিয়ে পড়েছিলো। তবে হায়েনাদের টার্গেট সম্পন্ন হয়নি। বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ এখন বিশ্বে এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
কুয়াকাটা শিল্পী গোষ্ঠীর সভাপতি হোসাইন আমির বলেন, আগস্ট মাস আমাদের গোটা বাঙালি জাতির গণতন্ত্র হত্যা করার মাস, জাতির জনক এবং তাঁর পরিবারবর্গকে নির্মূল করাই ছিলো হত্যাকারীদের প্রধান মিশন, যা এখনো শত্রুপক্ষ বারবার করার চেষ্টা করছে। ১৫ আগস্ট নির্মম হত্যাকাণ্ডের পর ২১শে আগস্টের গ্রেনেড হামলায় অসংখ্য মানুষকে হত্যা করার পরেও শত্রুপক্ষ থেমে নেই, বারবার হত্যাচেষ্টা চলছে। স্বাধীনতা বিরোধী পক্ষ আজও বসে নেই। জননেত্রী, প্রধানমন্ত্রীর উপর বারবার হামলাই তার প্রমাণ। আমার কাছে আগস্ট মানেই আতঙ্কের মাস, ভয়ের মাস, হারানোর মাস। আমরা আর কাউকে হারাতে চাই না। ৭৫ সালের ১৫ আগস্ট শুধু মাত্র হত্যাকাণ্ড নয়, দেশে জাতির জন্য একটি কালো অধ্যায়। দেশ যতদিন বেঁচে থাকবে এই কলঙ্কিত ঘটনাও বেঁচে থাকবে। যিনি জীবনের তোয়াক্কা না করে, জেল জুলুম সহ্য করে বাংলাকে স্বাধীন করে আনলো তাঁকেসহ তার পরিবারকে হত্যা এ প্রজন্ম স্বাভাবিক হত্যাকাণ্ড হিসেবে দেখে না।
সরকারি ব্রজমোহন কলেজ ছাত্র সংসদের সাবেক ক্রীড়া সম্পাদক ও সাবেক ছাত্রনেতা ফয়সাল বিন ইসলাম বলেন, বঙ্গবন্ধুর বিশ্বাস ছিলো তাঁকে হায়েনারা যখন হত্যা করেনি তখন বাঙালি কেউ তাঁকে হত্যা করবে না। কিন্তু তাঁর সেই বিশ্বাসের অমর্যাদা করে বর্বর হায়েনার দল শুধু তাঁকেই হত্যা করেনি। হত্যা করেছে আমাদের স্বপ্নকে। দীর্ঘ বছর পর হলেও বঙ্গবন্ধুর যোগ্য উত্তরসূরি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার হাত ধরে সোনার বাংলা এগিয়ে যাচ্ছে তার অভিষ্ঠ লক্ষ্যে।
বরিশালের সকল ব্যান্ড দলের সংগঠন বরিশাল ব্যান্ড ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গৌতম চন্দ্র ঢালী বলেন, এই কালো রাতে আমরা হারিয়েছি এদেশের সূর্য সন্তানদের, হারিয়েছি জাতির পিতাকে। যিনি আমাদের কিভাবে লড়াই করে অধিকার আদায় করতে হয় তা শিখিয়ে গেছেন, যিনি আমাদের ভালভাবে বেঁচে থাকার স্বাদ বুঝিয়েছেন। শিখিয়েছেন এ জাতিকে মেরুদন্ড শক্ত করে সোজা হয়ে দাঁড়াতে, শিখিয়েছেন কিভাবে দেশ ও মাতৃভূমির জন্য শত্রুর মোকাবেলা করতে হয়। ১৫ আগস্টের রাতে আমরা হারিয়েছি আমাদের বরিশাল সংগীত অঙ্গণের সে সময়ের ব্যান্ড ক্রিডেন্স-এর অন্যতম সদস্য নইম খান রিন্টুকে। ওই কালো রাতের আরও অনেক অজানা ইতিহাস যা এই প্রজন্মের অনেকেই আমরা জানি না। ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য যা জানা প্রয়োজন বলে মনে করি।
প্রতিভাবান নাট্যাভিনেতা জেসন পলাশ বলেন, ১৫ আগস্ট থেকে ২১শে আগস্ট বাঙ্গালি জাতির সর্বনাশা একটা মাস, ভয়ের মাস, কোটি বাঙ্গালির জাতির পিতাকে হারানোর মাস। যার জন্য আমরা পেয়েছি নির্দিষ্ট একটা ভূখন্ড, একটা মানচিত্র, লাল সবুজের পতাকা। যার আত্মত্যাগের কারণে আমি গর্বিত আমি বাঙ্গালি, সেই মহান নেতাকে হত্যা করে যারা ইতিহাসের চাকা অন্য পথে চালাতে চেয়েছিলো তারাই আজ ইতিহাসের আস্তাকুড়ে নিমজ্জিত।
লেখক: সাবেক সাধারণ সম্পাদক, বরিশাল সাংবাদিক ইউনিয়ন।
এনএস//