ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনাচার হৃদরোগ নিরাময় করে

একুশে টেলিভিশন  

প্রকাশিত : ০৪:৩৮ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম

জাতীয় অধ্যাপক ডা. নুরুল ইসলাম

হৃৎপিন্ডের যত ধরনের অসুখ আছে, তার মধ্যে করোনারি হৃদরোগ অন্যতম। ধূমপান, অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার, শারীরিক পরিশ্রমের অভাব ইত্যাদি এ রোগের অন্যতম কারণ। প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় শুধু ওষুধ, এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস অপারেশনের মাধ্যমে হৃৎপিন্ডের ব্লকেজের চিকিৎসা করা হয়। কিন্তু চিকিৎসক-জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় আমি দেখেছি, অত্যধিক মানসিক চাপ ও দুশ্চিন্তা হৃদরোগের অন্যতম প্রধান অনুঘটক, যার কোনো সমাধান প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থায় নেই।

এ-ছাড়াও অপারেশনের পর রোগী যখন আবার ধূমপান, ভাজাপোড়া ও তৈলাক্ত খাবারসহ পুরনো জীবনধারায় ফিরে যায়, আবারও সে আক্রান্ত হয় হৃদযন্ত্রের নানা জটিলতায়। তাই এ থেকে পরিপূর্ণ নিরাময়ের জন্যে প্রয়োজন ধূমপান বর্জন, জীবনধারায় পরিবর্তন এবং টেনশনমুক্ত জীবন। আমি আমার রোগীদেরকে এসব ব্যাপারে সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেই।

টেনশনমুক্ত প্রশান্ত জীবনের জন্যে মেডিটেশনের ভূমিকা এখন বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত। মেডিটেশন ও জীবনাচার পরিবর্তনের মাধ্যমে যারা হৃদরোগ মুক্ত হয়েছেন, আমি তাদের অভিনন্দন জানাই। এদের মধ্যে অনেকেই  অপারেশন-পরবর্তী জটিলতায় আক্রান্ত হতে পারতেন। কিন্তু তা হন নি; বরং সঠিক সময়ে সঠিক চিকিৎসাটি তারা নিতে পেরেছেন।

অপারেশনকে ভয় করেন না এমন মানুষ নেই, তাই অপারেশনের চেয়ে ঝুঁকিহীন এমন একটি পদ্ধতির মাধ্যমে সুস্থ হওয়া সত্যিই ভাগ্যের ব্যাপার। হৃদরোগ থেকে মুক্ত হওয়ার অভিজ্ঞতা তাদের কাছ থেকে আমি শুনেছি। সৎসাহস না থাকলে এ কথাগুলো তারা এত সহজে বলতে পারতেন না। সত্য বলেই সৎসাহস ও সৎ-উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এ কথাগুলো আমাদের সামনে তুলে ধরতে পেরেছেন। আর সত্য বলতে কোনো ভয় থাকা উচিত নয়। কারণ সত্য-মিথ্যার দ্বন্দ্বে শেষ পর্যন্ত সত্যই প্রতিষ্ঠিত হয়।

মানসিক প্রশান্তি ও সুস্থ জীবনধারা হৃদরোগ নিরাময় করে—এটি এখন প্রতিষ্ঠিত সত্য। নানা গবেষণা আর চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতামতের ভিত্তিতে সত্য প্রমাণিত হয়েছে বলেই মেডিকেল সায়েন্সের মূলধারার বই ও জার্নালগুলোতে এ কথাগুলো ছাপা হয়েছে। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে আপনি যদি ভালো থাকতে পারেন, তবে অনর্থক কাটাছেঁড়া কেন করবেন?

প্রযুক্তির ক্রম-উৎকর্ষের ফলে শহরে-গ্রামে কোথাও আমরা এখন হাঁটি না, সর্বত্রই গাড়িতে চলাচল করি। অর্থাৎ আমাদের জীবনযাত্রা হয়ে পড়েছে শারীরিক পরিশ্রমহীন। আমাদের খাদ্যাভ্যাসেও এসেছে ব্যাপক পরিবর্তন। শাকসবজির বদলে এখন আমরা ফাস্ট ফুড, প্রক্রিয়াজাত, ভাজাপোড়া ও অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবারে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি। এসব খাবার যতই সুস্বাদু হোক, শরীরের জন্যে কিন্তু বিপজ্জনক। আর ধূমপানের কথা বলাই বাহুল্য। সিগারেটের নিকোটিন হৃৎপিন্ডের ধমনীকে সংকুচিত করে। এতে রক্ত চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়, যা করোনারি হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। এর সাথে যুক্ত হয়েছে আধুনিক জীবনের নানা দুশ্চিন্তা ও টেনশন।

তাই আপনার হৃৎপিন্ডের সুস্থতার জন্যে ধূমপান অবশ্যই বর্জন করুন। জীবন-অভ্যাসে পরিবর্তন আনুন। মানসিকভাবে প্রশান্তিতে থাকুন। আপনি ভালো থাকবেন।

যুক্তরাষ্ট্রে ডা. ডিন অরনিশ শত শত হৃদরোগীকে এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস ছাড়াই সুস্থ করে তুলেছেন। হৃদরোগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এ  চিকিৎসাপদ্ধতি আবিষ্কারের জন্যে তাকে চিকিৎসাবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত করা উচিত বলে আমি মনে করি। সমস্ত মেডিকেল জার্নাল, গবেষক ও বিশেষজ্ঞরা একবাক্যে স্বীকার করেছেন যে, এর ভিত্তি আছে। এতে মিথ্যা কিছু নেই। চিকিৎসক-জীবনে আমি নিজেও এর বহু প্রমাণ পেয়েছি।

নজরুলের একটি কবিতায় আছে—‘বিশ্বাস আর আশা যার নাই, যেও না তাহার কাছে’। তাই জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রেই বিশ্বাস এবং আশাকে সঙ্গী করে রাখবেন। এই আশা এবং বিশ্বাসই আপনাকে সুস্থ করে তুলবে, সাফল্য এনে দেবে। এর পাশাপাশি সৃষ্টিকর্তা যা দিয়েছেন, তার প্রতি শ্রদ্ধাশীল হোন। সবসময় কৃতজ্ঞচিত্ত থাকুন।

মেডিটেশন ও সুস্থ জীবনাচার চর্চা করে যারা সুস্থ হয়েছেন, তাদের সুস্থতার মূলেও রয়েছে এই বিশ্বাস। বিশ্বাস করে এগিয়ে গেছেন বলেই তারা আজ সুস্থ ও হৃদরোগমুক্ত। নিঃসন্দেহে তারা ভাগ্যবান। তাদেরকে বলি—আপনারা এ অভিজ্ঞতা সবাইকে জানান, পত্রিকায় ছাপানোর ব্যবস্থা করুন। আপনাদের খ্যাতি কিংবা পত্রিকার কাটতি বাড়ানোর জন্যে নয়, বরং মানুষের কল্যাণের জন্যে। যারা হৃদরোগ থেকে পরিত্রাণ চান, অপারেশনের ঝুঁকি থেকে দূরে থাকতে চান, সুন্দরভাবে বাঁচতে চান, তাদের জন্যে প্রচার করুন। সমাজের জন্যে, জাতির জন্যে সর্বোপরি মানুষের কল্যাণার্থে এ সুসংবাদ সবার কাছে পৌঁছে দেয়া একটি নৈতিক কর্তব্য বলে আমি মনে করি। বিশ্বাসের সাথে আমি যে কথাগুলো বললাম, তাতে আমার পেশার কোনো ক্ষতি হবে না। আমার পেশা তার যোগ্য সম্মান নিয়েই বেঁচে থাকবে।

প্রায় ২০ বছর আগে কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশনের শিথিলায়ন মেডিটেশনের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে আমি অতিথি হয়ে এসেছিলাম। সেদিনও ‘প্রশান্তিতে মুক্তি’ শীর্ষক ভাষণে একজন চিকিৎসক হিসেবেই আমি বলেছিলাম—‘শুধু ট্যাবলেট, মিকশ্চার বা প্রেসক্রিপশন দিয়ে সব রোগমুক্তি সম্ভব নয়। কারণ প্রত্যেক চিকিৎসককেই তার পেশাগত জীবনে এমন কিছু রোগীর সংস্পর্শে আসতে হয়, যাদের রোগের সাথে কোনো না কোনোভাবে টেনশন জড়িত। দেখা গেছে, হাসপাতালের বহির্বিভাগে যে রোগীরা যান, তাদের মধ্যে শতকরা ৪০ ভাগেরই কোনো ওষুধের প্রয়োজন হয় না। কাউন্সেলিং বা সৎপরামর্শ, আত্মবিশ্বাস এবং প্রশান্তিতে এ সমস্ত রোগের মুক্তি হয়। আর অস্থির-অশান্ত আধুনিক মানুষের জীবনে প্রশান্তির সুবাতাস আনতে পারে মেডিটেশন। কোয়ান্টাম মেডিটেশন মানুষের মনে প্রশান্তি ও আত্মবিশ্বাস সৃষ্টি করে রোগ নিরাময়কে ফলপ্রসূ করে, যা এখন পাশ্চাত্যে বিজ্ঞান হিসেবে স্বীকৃত। তাই আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের পরিপূরক হিসেবে কোয়ান্টাম মেথড চমৎকার কাজ করতে পারে। যে-সব রোগে ওষুধের প্রয়োজন নেই, তার নিরাময়ে কোয়ান্টামই হতে পারে সার্থক বিকল্প।’

আসলে শরীরের চেয়ে মন অনেক বেশি শক্তিশালী। মনের গতি, শক্তি, পরিধি সবই ব্যাপক। মনের এই দুর্দমনীয় শক্তির প্রভাবে শরীরে এমন কিছু রাসায়নিক পরিবর্তন ঘটে, যাতে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ে, এমনকি রোগ নির্মূলেও সাহায্য করে।

যুগে যুগে মহামানবরা, নবী-রসুলরা বিভিন্ন রোগ নিরাময়ের ক্ষেত্রে ধ্যানের এই শক্তিকে কাজে লাগিয়েছেন। এটি তাই নতুন কিছু নয়। এটি হাজার বছরের শাশ্বত চেতনারই একটি আধুনিক ও সমন্বিত রূপ, যার উৎস এই প্রাচ্য। বর্তমানে হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধের এ প্রক্রিয়া সারা বিশ্বে ব্যাপকভাবে গ্রহণযোগ্য ও সর্বজনস্বীকৃত। তাই আমি আশা করব, হৃদরোগ নিরাময়ের এ প্রক্রিয়া বাংলাদেশে আরো জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

পরিশেষে এটাই বলি—আপনার সুস্থতা ও নিরাময়ের দায়িত্ব আপনাকেই নিতে হবে। তাই সুস্থ হৃদযন্ত্র সর্বোপরি সুস্থ জীবনের জন্যে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণ করুন। অর্থাৎ ইতিবাচক ও কৃতজ্ঞচিত্ত হোন। প্রাকৃতিক খাদ্যাভ্যাসে অভ্যস্ত হোন। নিয়মিত হাঁটুন, ব্যায়াম করুন এবং টেনশনমুক্ত জীবনযাপন করুন। সবচেয়ে বড় কথা—বিশ্বাস এবং আশা নাই যাদের, তাদের কাছ থেকে দূরে থাকুন। সবসময় আশাবাদী, বিশ্বাসী ও ভালো মানুষদের সংস্পর্শে থাকুন। আপনি ভালো থাকবেন।

লেখাটি ডা. মনিরুজ্জামান ও ডা. আতাউর রহমান এর লেখা এনজিওপ্লাস্টি ও বাইপাস সার্জারি ছাড়াই ‘হৃদরোগ নিরাময় ও প্রতিরোধ’ শীর্ষক বই থেকে নেয়া। 
 
আরকে//