ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৯ ১৪৩১

কিটো ডায়েট কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত?

পথচারী

প্রকাশিত : ০৬:০৪ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:০৮ পিএম, ১৩ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

হালের ক্রেজ এখন কিটো। নামীদামী তারকা থেকে সাধারণ মানুষ- অল্প সময়ে অধিক ওজন কমাতে অনেকেই ঝুঁকছে কিটো ডায়েটের দিকে। কিন্তু এটি কতটা স্বাস্থ্যসম্মত? এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়াই বা কী?

দেশের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ায় ঘুরেফিরে আলোচিত হচ্ছে এই প্রসঙ্গগুলোই। বিষয়টিকে নতুন মাত্রা দিয়েছে সম্প্রতি দেশে আজওয়াদ আহনাফ করিম সামিন নামের এক স্কুলছাত্রের কিটো ডায়েটজনিত অসুস্থতায় মৃত্যুর ঘটনা। কিটো আসলে কী?

কিটোজেনিক ডায়েট, সংক্ষেপে কিটো হলো কম কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) ভিত্তিক ডায়েট পদ্ধতি, যেখানে শরীরকে ফ্যাট বার্ন-আউট করতে বাধ্য করা হয়। গড়পড়তা কিটোতে শর্করা ৫-১০ শতাংশ, আমিষ ১০-২০ শতাংশ এবং চর্বি ৭০-৮০ শতাংশ থাকে।

সম্প্রতি বেশি আলোচিত হলেও কিটো কিন্তু নতুন কিছু নয়! ঊনবিংশ শতকে ডায়বেটিস নিয়ন্ত্রণে এটি ব্যবহৃত হতো। ১৯২০-এর দিকে, যখন শিশুদের মৃগীর চিকিৎসায় ওষুধে তেমন কাজ হতো না, তখন ডায়েট থেরাপি হিসেবে কিটোর ব্যবহার শুরু হয়। তবে এই ডায়েট অনুসরণে অল্প ক’দিনে বেশ ওজন কমে বলে কালক্রমে তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ওয়েট-লস ডায়েট হিসেবে।

ডায়েট চার্টে যা থাকবে, যা থাকবে না 

চিনিসহ মিষ্টিজাতীয় সব ধরনের খাবার পুরোপুরি বাদ। খাওয়া যাবে না মিষ্টি ফলও। মাটির নিচে হয় এমন সবজি যেমন- আলু, মুলা, গাজর, শালগম, কচু ইত্যাদিও থাকবে বর্জনীয়ের তালিকায়। ভাত রুটি/পরোটা পাউরুটি নুডলস ওটস ও কর্নফ্লেক্স খাওয়া যাবে, তবে অতি সামান্য পরিমাণে। প্রোটিনজাতীয় খাবার হওয়া সত্ত্বেও বেশ শর্করা থাকায় একই নিষেধাজ্ঞা ডালের ব্যাপারেও।

অন্যদিকে প্রচুর পরিমাণে খেতে হবে সব ধরণের প্রাণীজ আমিষ- ডিম, মুরগী, খাসি ও গরুর মাংস এবং সব ধরণের মাছ। দুধ, ঘি, মাখন, তেল এবং সবুজ শাক-সবজিও খেতে হবে পর্যাপ্ত পরিমাণে।

কিভাবে কাজ করে?

দেহকোষের শক্তির প্রধান উৎস হলো ব্লাড সুগার বা গ্লুকোজ, যা আসে শর্করা থেকে। শর্করা গ্রহণ কমালে একটা পর্যায়ে দেহে গ্লুকোজের মজুদ ফুরিয়ে যায়। লিভার তখন দেহে সঞ্চিত ফ্যাট থেকে কিটোন বডি উৎপাদন শুরু করে। এই প্রক্রিয়াটিকে বলা হয় কিটোসিস। শরীরের একটি স্বাভাবিক প্রবণতা হলো চর্বি জমিয়ে রাখা। কিন্তু কিটোসিস শুরু হলে গ্লুকোজের অবর্তমানে কিটোন বডি শক্তি উৎপাদনের কাজে ব্যবহৃত হতে থাকে। অর্থাৎ, ফ্যাটই তখন শরীরের প্রধান জ্বালানী। এভাবে কিটো শুরুর ৩/৪ দিনের মধ্যে শরীরে জমানো মেদ বার্ন আউট হতে শুরু করে। ফলে কমে ওজন।

শর্করা কেন এবং কতটা গ্রহণ করা উচিত?

শরীরে শক্তি যোগানোর পাশাপাশি প্রোটিন ও ফ্যাটকেও কর্মক্ষম করে শর্করা; কমায় রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টেরল এবং ভূমিকা রাখে উচ্চ রক্তচাপ, ডায়বেটিস, হৃদরোগ, পিত্তপাথর ইত্যাদি প্রতিরোধে। ক্যান্সার প্রতিরোধেও শর্করার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে।

পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে, প্রাপ্তবয়স্কদের দৈনিক ক্যালোরির ৬০-৭০% শর্করা হতে হবে। তার মানে, আপনি যদি ২০০০ ক্যালোরি খাবার খান তবে এর মধ্যে শর্করা থাকতে হবে ১২০০-১৪০০ ক্যালোরি। সে হিসেবে প্রতিদিন গড়ে ৩০০-৩৫০ গ্রাম শর্করা আপনাকে গ্রহণ করতে হবে। কিন্তু কিটো অনুসরণ করলে আপনি শর্করা গ্রহণ করতে পারবেন মাত্র ২০-৫০ গ্রাম!

শর্করা এতটা কমালে যা হবে

আমরা শর্করাজাতীয় খাবার থেকেই আঁশ পেয়ে থাকি, যা হজমে সাহায্য করে। দরকারি আঁশের অভাবে কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দিতে পারে। শর্করার সঙ্গে ভিটামিন ও মিনারেলসেরও সম্পর্ক আছে বলে এর স্বল্পতায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এতে বাড়ে বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি। প্রোটিন ও ফ্যাট শর্করার ঘাটতি পূরণে লেগে যায় বলে কিটো করলে প্রোটিনের অভাব দেখা দিতে পারে। এতে ব্যাহত হবে মস্তিষ্ক ও চোখের স্বাভাবিক কর্মতৎপরতা। বেশিদিন চললে মাংসপেশি ক্ষয়ে মানুষ কর্মশক্তি হারাতে থাকে।

১৬ আগস্ট ২০১৮ ‘দ্য ল্যানসেট পাবলিক হেলথ’ জার্নালে প্রকাশিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে লো-কার্ব ডায়েটের সাথে আয়ুহ্রাসের একটি সম্পর্ক দেখানো হয়েছে। ২০টিরও বেশি দেশের ৪,৩২,১৭৯ জনের উপর ২৫ বছর ধরে পরিচালিত গবেষণাটিতে দেখা গেছে, শর্করা মোট ক্যালোরির ৪০ শতাংশের কম হলে আয়ু ৪ বছরের মতো কমে যেতে পারে!

অতিরিক্ত প্রোটিন ও চর্বিজাতীয় খাবার যে কারণে খারাপ

সুষম খাবারের অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো চর্বি ও প্রোটিন। কিন্তু কী হয় দ্বিগুণ বা তার বেশি পরিমাণে খেলে? ডায়রিয়া হতে পারে। এ-ছাড়া কিডনিতে পাথরসহ বিভিন্ন জটিলতা, হৃদরোগ, গলব্লাডার স্টোন, প্যানক্রিয়াসের জটিলতা, থাইরয়েডের সমস্যা, হজমশক্তি কমে যাওয়া, চুল পড়ে যাওয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। এ-ছাড়াও, ত্বকে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, হারিয়ে যায় ত্বকের উজ্জ্বলতা।

নিকৃষ্টতম ডায়েট পদ্ধতি!

১৯৯৯ থেকে ২০১০ পর্যন্ত ২৪, ৮২৫ জনের উপর যুক্তরাষ্ট্রের দ্য ন্যাশনাল সেন্টার ফর হেলথ স্ট্যাটিসটিকস পরিচালিত একটি জরিপ গবেষণায় দেখা গেছে, এদের মধ্যে কম শর্করা গ্রহণকারীদের হার্ট অ্যাটাক ও অন্যান্য হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক এবং ক্যানসারে মৃত্যুর আশঙ্কা যথাক্রমে ৫১, ৫০ ও ৩৫ শতাংশ বেশি! ২০২০ সালে কিটো ডায়েটের কারণে কিডনি জটিলতা নিয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান বলিউড অভিনেত্রী মিষ্টি মুখোপাধ্যায়। সম্প্রতি সামিনের মৃত্যুর জন্যেও দায়ী করা হচ্ছে কিটোকে।

এ-সব কারণে দেশ-বিদেশের স্বাস্থ্যবিশেষজ্ঞরা এখন কিটোর ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে সরব হয়েছেন। আমেরিকার পুষ্টিবিদ ও ডায়েটেশিয়ানদের মাঝে পরিচালিত এক জরিপে ২০২০ সালের নিকৃষ্টতম ডায়েট নির্বাচিত হয় কিটো।

আরো কিছু স্বাস্থ্যঝুঁকি

কিটোসিসের ফলে চর্বি ভেঙে কিটো এসিড তৈরি হয়, যা শরীরের জন্য ভয়াবহ একটি অবস্থা কিটো-এসিডোসিস সৃষ্টি করতে পারে। এতে অপূরণীয় ক্ষতি হতে পারে মস্তিষ্ক, লিভার এবং কিডনির। তাছাড়া এই চর্বি রক্তপ্রবাহের মাধ্যমে শরীরের বিভিন্ন স্থানে ছড়িয়ে পড়ে, যা হৃৎপিণ্ডের রক্তনালীতে জমে হতে পারে হার্ট অ্যাটাকের কারণ।

মস্তিষ্কের প্রধান খাবার হলো গ্লুকোজ, যা স্বাভাবিক অবস্থায় শর্করা ভেঙে তৈরি হয়। তাই দীর্ঘমেয়াদে কিটোতে স্মৃতিভ্রষ্ট হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেয়া যায় না!

কিটো সবার জন্যে নয়!

কিটো মূলত ওজন কমানোর ডায়েট নয়, এটি একটি থেরাপি। যা প্রযোজ্য ব্যক্তিবিশেষের জন্যে, গণহারে সবার জন্যে নয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার বা ডায়েটেশিয়ান আপনার খাদ্যাভ্যাস ওজন লাইফস্টাইল মেডিকেল হিস্টরি ইত্যাদি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনে কিটো সাজেস্ট করতে পারেন। তবে ডায়েট শুরু করতে হবে সরাসরি তার সাথে পরামর্শ করে, তার ইউটিউব ভিডিও দেখে বা ব্লগ পড়ে নয়।

আর হুট করে ওজন কমানোর চেয়ে পরিকল্পিতভাবে একটু একটু করে কমালে তা টেকসই হবে। মনে রাখবেন, রুচি, ধর্ম ও বিজ্ঞানসম্মত সব ধরণের খাবার গ্রহণ করার পরও শরীরচর্চা ও পরিশ্রমী জীবনযাপনের মাধ্যমে আপনি যেমন অতিরিক্ত ওজন ঝরাতে পারেন, সেই সাথে পেতে পারেন সুস্বাস্থ্য ও প্রাণপ্রাচুর্য্যে ভরপুর দীর্ঘজীবন।

এসি