ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

কলারোয়ায় সাফল্য অর্জনকারী ৫ জয়িতার ইতিকথা

কলারোয়া (সাতক্ষীরা) প্রতিনিধি

প্রকাশিত : ১০:৩০ এএম, ২০ আগস্ট ২০২১ শুক্রবার

বা দিক থেকে যথাক্রমে- আলেয়া খাতুন, সীমা বিশ্বাস, সানজিদা খাতুন, নারগিস বেগম ও মমতাজ বেগম।

বা দিক থেকে যথাক্রমে- আলেয়া খাতুন, সীমা বিশ্বাস, সানজিদা খাতুন, নারগিস বেগম ও মমতাজ বেগম।

অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জনকারী নারী- 
কলারোয়া উপজেলার বুইতা গ্রামের মোজাম্মেল গাজীর বিধরা কন্যা আলেয়া খাতুন। তিন সন্তানের জননী, বসবাসের কোনো জাগয়া ছিল না। স্বামীর মৃত্যুর পর একেবারে অসহায় হয়ে পড়েন। অন্যের বাড়িতে ও ক্ষেত-খামারে কাজ করে জীবন ধারণ করতেন। কিছু টাকা জমিয়ে একটি মুদির দোকান দেন এবং উপার্জিত অর্থ দিয়ে ১৮ কাঠা জমি কেনেন। নিজের আয়ের অর্থ দিয়ে দুই ছেলেকে বিদেশ পাঠিয়েছেন এবং ছোট ছেলেকে লেখাপড়া করাচ্ছেন।

মুদি দোকানের পাশাপাশি নিজের জায়গায় একটি পোল্ট্রি ফার্ম করেছেন এবং কুঁড়ে ঘর থেকে পাকা বাড়িতে বসবাস করছেন। এক সময় তার ‘দিন এনে দিন খাওয়া’ সংসার ছিল। এখন আলেয়া খাতুন অনেক সুখে আছেন।   প্রশিক্ষণ নিয়ে পোশাক তৈরি ও তাতে ব্লক-এর কাজ করে পোশাক বিক্রয় করেও স্বাবলম্বী হয়েছেন। বর্তমানে তার আর্থিক অবস্থা পূর্বের তুলনায় অনেক ভালো। তার অর্জিত পুঁজি বৃদ্ধি অব্যাহত আছে।

নির্যাতনের বিভীষিকা মুছে ফেলে নতুন উদ্যমে জীবন শুরু করেছেন যে নারী-
কলারোয়া উপজেলার রঘুনাথপুর গ্রামের সিমসন বিশ্বাসের কন্যা সীমা বিশ্বাস। অনেক কম বয়সে বিয়ে হয় এবং ২টি সন্তান হওয়ার পর স্বামী তার ওপর অত্যাচার শুরু করে। তার অমানবিক নির্যাতনের কথা শুনে হতবিহ্বল হয়ে পড়ে সবাই। 

সীমা বিশ্বাস বলেন, ‘সন্তান দুটির কারণে আত্মহত্যার পথ থেকে ফিরে আসি। বাবার বাড়ি ফিরে যাব কিন্তু বাবা গরীব। অবশেষে নির্যাতন সইতে না পেরে তালাক হয়ে যায়।’

অতঃপর, সন্তান দুটি নিয়ে ভাইয়ের ঘরের পাশে চাল দিয়ে বসবাস করতে থাকেন। কিছু দিন পর তার বাবাও মারা যান। সংগ্রামী এই নারী বলেন, ‘বাবার মৃত্যুর পর আমি আরও অসহায় হয়ে পড়ি’। এরপর সীমা স্থানীয় মিশনে একটি চাকরি খুঁজে পান। বর্তমানে ব্র্যাক অফিসে ক্লিনার পদে নিযুক্ত আছেন এবং বাচ্চাদের লেখাপড়া শিখিয়ে মানুষের মতো মানুষ করতে চান।

শিক্ষা ও চাকুরী ক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী-
কলারোয়া উপজেলার পাইকপাড়া গ্রামের আব্দুল মালেক গাজী কন্যা সানজিদা খাতুন। সানজিদা পাঁচ ভাই বোনের মধ্যে সবার ছোট। তার বাবা তাকে পোশাক পরিচ্ছদ ও পড়ালেখার কোনো খরচ যোগাতে পারতেন না। তিনি অনেক কষ্টে সংসার চালাতেন। তাই বিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত অবস্থায় টিউশনি করে নিজের খরচ নিজেই বহন করতেন। 

একদিকে পড়ালেখা, অন্যদিকে নিজের রোজগার তাকে খুব কষ্টে ফেলত। তবু তিনি দমে যান নি। এসএসসি ফরম পূরণ, এইচএসসিতে ভর্তির টাকা অনেক কষ্টে যোগাড় করতে হয়েছে। একের পর এক সংগ্রাম করে লেখাপড়া চালিয়ে গেছেন। একজন দরিদ্র দিন মজুরের কন্যা হয়েও অনেক সংগ্রাম করে মাস্টার্স পাশ করে বর্তমানে চাকুরী করছেন সানজিদা। যৌতুক, বাল্যবিবাহ, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধমূলক কাজও করে যাচ্ছেন তিনি।

সফল জননী নারী-
কলারোয়া উপজেলার নাথপুর গ্রামের কুতুবউদ্দীন আহমেদের কন্যা নারগিস বেগম। জন্মের পরপরই তার মা পৃথিবী থেকে বিদায় নেন। মাতৃহীন নারগিস নানা বাড়ীতে নানান সুবিধা বঞ্চিত হয়ে বড় হন। প্রবল পড়ালেখার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও ৫ম শ্রেণি পর্যন্ত যেতে পেরেছিলেন মাত্র। তারপর তার বিয়ে হয়ে যায়। অপূরণীয় আপসোস থেকে তার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ৭ সন্তানকে সুশিক্ষায় শিক্ষিত করে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। দুই পুত্রের মধ্যে একজন জনতা ব্যাংকের সিনিয়র প্রিন্সিপ্যাল অফিসার, অন্যজন মেডিকেল অফিসার। ৫ কন্যার মধ্যে ৩ জন কলেজের প্রভাষক, একজন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সিনিয়র সহকারী শিক্ষক ও একজন আদর্শ গৃহিনী। 

নারগিস বেগম তার সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করতে পেরে নিজের জীবনকে সার্থক মনে করেন। কলারোয়া সরকারি কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ মোঃ আব্দুল মজিদ তার ছায়াসঙ্গী হিসেবে সারা জীবন উৎসাহ যুগিয়েছেন।

সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রেখেছেন যে নারী-
কলারোয়া উপজেলার উত্তর দিগং গ্রামের আবুল হোসেনের কন্যা মমতাজ বেগম। এলাকার বিভিন্ন নারী মানসিক নির্যাতন, অত্যাচার, সংসারের অচ্ছলতা, বাল্যবিবাহ ও যৌতুকের শিকার হন। 

তিনি বলেন, ‘এসব নারীর সমস্যা নিরসনের লক্ষে কিছু নারীকে একত্রিত করে আমি সমিতির কাজ শুরু করি। উক্ত প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে আমি সঞ্চয় জমা ও ঋণ বিতরণ শুরু করি। এর পাশাপাশি তাদেরকে মৎস্য, কৃষি, হাঁস-মুরগি পালন, দর্জি প্রশিক্ষণ দিয়ে স্বাবলম্বী করি। আমাদের সাফল্য দেখে বর্তমানে অনেক নারী আমাদের সাথে যোগ দিচ্ছে। আমি এলাকায় যৌতুক, নারী নির্যাতন, বাল্যবিবাহ প্রতিরোধ করি। গরীব অসহায় ছাত্র-ছাত্রীদের পড়ালেখা ও চিকিৎসার খরচ দিই। সমাজ বিরোধী কর্মকাণ্ড প্রতিরোধ করি।’

এনএস//