ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

‘এসিডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট!’

নবীউর রহমান পিপলু, নাটোর

প্রকাশিত : ১০:০৬ এএম, ২৩ আগস্ট ২০২১ সোমবার

ক’দিন আগেও খোলা জায়গায় দাঁড়িয়ে বুক ভরে মুক্ত বাতাস নিয়েছেন। প্রাণ খুলে নিঃশ্বাস নেওয়ার মত একমাত্র ফাঁকা জায়গাটি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। বাহাদুর শাহ পার্ক নামের ওই ফাঁকা জায়গাটিতে এখন শোভা পাচ্ছে বহুতল ভবন। সেখানেই গড়ে তোলা হচ্ছে সোনার দোকান। এখন বাড়ির ছাদে উঠে নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয়। সোনা গলানোর ধোঁয়ায় এলাকার বাতাস এখন দুষিত। 

নাটোর শহরের লালবাজার এলাকার বাসিন্দা আইনজীবী ভাস্কর বাগচীর সাথে এলাকার পরিবেশ নিয়ে কথা বলার সময় এসব কথা তিনি বলেন। এলাকার অপর বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক একই ধরনের অভিযোগ করে বলেন, এলাকায় চলাফেরা করতে সোনা গলানো এসিডের ধোঁয়ায় নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে। প্রতিদিন আমাকে লালবাজার থেকে নিচাবাজার যাতায়াত করতে হয়। আবাসিক এলাকায় গড়ে ওঠা স্বর্ণ পট্টির মধ্য দিয়ে চলতে বড় কষ্ট হয়। এসিডে সোনা-রুপার গলানো ধোঁয়ায় এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে বলে জানান তিনি।

নাটোর শহরের প্রাণকেন্দ্র লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টির আংশিক এবং পাশের পিলখানা মোড় পর্যন্ত বিস্তৃত প্রায় তিন শতাধিক সোনার দোকান গড়ে উঠেছে। এই এলাকার রাস্তার দুই ধারে গড়ে ওঠা উত্তরবঙ্গের মধ্যে নাটোর স্বর্ণকার পট্টি নামে সুখ্যাতি রয়েছে এই সোনার বাজারের। অভিজাত আবাসিক এলাকা পরিচিতি পেলেও সব পেশা ও শ্রেণীর কয়েক হাজার মানুষ এই এলাকায় বসবাস করেন। 

সম্প্রতি এই এলাকাগুলোতে নির্মিত হয়েছে বহুতল ভবন। এসব ভবনে মানুষের বসবাসের পাশাপাশি সোনার গহনার শো-রুম সহ গহনা তৈরির কারখানা গড়ে তোলা হয়েছে। গড়ে ওঠা প্রায় শতাধিক এসব কারখানায় গহনা তৈরির জন্য প্রতিনিয়ত গলানো হচ্ছে সোনা-রুপা। আর এ কাজে ব্যবহার করা হয় এসিড। দোকানের সামনে রাস্তার ধারে এসিড দিয়ে সোনা পোড়ানোর ফলে অসুবিধায় পড়ছেন পথচারী। 

এছাড়া স্বর্ণ শিল্প কারিগর নিজেরাও স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রয়েছেন। বিষাক্ত ধোঁয়া নাকে মুখে প্রবেশ করায় শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন জটিল রোগের সৃষ্টি হচ্ছে। প্রতিদিনই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত চলে সোনা গলানোর কাজ।

চৌকির পাড় এলাকার খোকন সাহা বলেন, এসিডের ঝাঁঝালো গন্ধে পিলখানা ও লালবজার জয়কালী মন্দির রোড়ের রাস্তায় চলতে সমস্যা হয়। রাস্তায় এসিডের ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন থাকে। এসিডের ঝাঁঝে পথ চলতে খুব কষ্ট হয়। এব্যাপারে মালিক ও কারিগরদের কাছে অভিযোগ করেও কোন প্রতিকার পাওয়া যায়নি। এসিড দিয়ে সোনা-রুপা গলানোর জন্য কারখানা সরিয়ে অন্যত্র নেয়ার দাবি করেন তিনি।

রসুলের মোড় এলাকার মুক্তার হোসেন বলেন, এলাকায় সোনা-রুপা গলানোর কারণে এলাকার জনস্বাস্থ্য হুমকির মুখে। এলাকার সিংহভাগ মানুষ শ্বাকষ্টে ভুগছেন। প্রতিটি বাড়িতে অন্তত একজন করে মানুষ শ্বাসকষ্টে আক্রান্ত। এছাড়া চর্মরোগ রোগসহ হৃদরোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। এবিষয়ে জেলা প্রশাসনসহ পরিবেশ অধিদপ্তরে একাধিকবার মৌখিক ও লিখিতভাবে অভিযোগ করা হয়। কিন্তু জেলা প্রশাসন থেকে প্রতিকারের প্রতিশ্রুতি পাওয়া গেলেও পরিবেশ অধিদপ্তরের কোন উদ্যোগ বা প্রতিকারে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করতে দেখা যায়নি। 

নাটোর সদর হাসপাতালের মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাঃ মোঃ রবিউল আওয়াল বলেন, এসিডের ধোঁয়া মানব দেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকারক। এই ধোঁয়ার কারণে মানুষের শ্বাসকষ্ট বা হাঁপানি ও চর্মরোগ হতে পারে। এমনকি হৃদরোগসহ নানা ধরনের শারিরিক সমস্যা দেখা দিতে পারে। প্রাথমিকভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি হলেও র্দীঘমেয়াদী বিষাক্ত এই ধোঁয়ার প্রভাবে মানুষের শরীরে ক্যান্সারের মত জটিল রোগও হতে পারে। হাসপাতালে আসা শ্বাসকষ্ট বা চর্মরোগীদের অধিকাংশই এই স্বর্ণপট্টি এলাকার বাসিন্দা বা স্বর্ণ কারিকর।

স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেন বলেন, বহুকাল ধরে লালবাজার ও কাপুড়িয়াপট্টিসহ আশেপাশের এলাকায় গড়ে উঠেছে সোনার গহনা তৈরিসহ স্বর্নালংকারের দোকান। লালবাজার এলাকার সোনার গহনার সুখ্যাতি রয়েছে ভারতসহ দেশ-বিদেশে। এক সময় হাতে গোনা কয়েকজন মানুষ এই সোনার গহনা তৈরি ও বিক্রির সাথে জড়িত ছিলেন। এখন ক্রমেই বিস্তৃতি লাভ করেছে। প্রায় দোকানের সাথেই রয়েছে গহনা তৈরির কারখানা। এসব কারখানায় এসিডে সোনা গলানো হয়। কিন্তু এসিড ব্যবহারের বিধিনিষেধ মানছে না কেউ।  

এসব কারখানার প্রতিষ্ঠিত মালিকরা তাদের প্রয়োজনে তৈরি করছেন অভিজাত অট্টালিকা। ওই সব ভবনে একদিকে চালু করা হচ্ছে সোনার দোকানসহ কারখানা। এসব ভবনের পিছন দিকে এসিডের ধোঁয়া নির্গমণের পাইপ সংযুক্ত করায় এসিডের ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ছে গোটা এলাকায়। এছাড়া বিল্ডিং কোড না মেনে এলাকায় অপরিকল্পিতভাবে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে করে আগামীতে পানি নিষ্কাসনসহ নানা সমস্যার সৃষ্টি হবে বলে জানান ওয়ার্ড কাউন্সিলর।

কাউন্সিলর ফরহাদ হোসেনসহ এলাকাবাসীর দাবি, বিষাক্ত ধোঁয়া বের হওয়া কারখানাগুলোকে জনবহুল এলাকা থেকে সরিয়ে লোকবসতি যেখানে কম এমন স্থানে স্থানান্তর করা হোক। এ বিষয়ে তারা পরিবেশ অধিদপ্তরসহ জেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। 

লালবাজার এলাকার বাসিন্দা ব্যবসায়ী আনিসুল ইসলাম বলেন, এলাকার মানুষদের জন্য মুক্ত বাতাস গ্রহণের জন্য বাহাদুর শাহ পার্ক নামের একটি খোলা মাঠ ছিল। এখানে অনেকেই শরীর চর্চাসহ মুক্ত বাতাস গ্রহণ করতেন। ’৮০র দশকে তৎকালীন পৌর পরিষদ সেখানে মার্কেট তৈরির উদ্যোগ নেয়া হয়। এলাকাবাসীর আবেদনের প্রেক্ষিতে সে সময়ের চেয়ারম্যান প্রয়াত শংকর গোবিন্দ চৌধুরী ওই মার্কেট নির্মাণ কাজ বন্ধ করে দেন। দীর্ঘদিন পর বর্তমান পরিষদ সেখানে বহুতল মার্কেট নির্মাণ করেছে। নির্মাণ কাজ শুরু করার পর আদালতে মামলা করা হয়। পরে উচ্চ আদালতের অনুমতি সাপেক্ষে মার্কেট নির্মাণ চলমান রয়েছে।

নাটোর জেলা জুয়েলারি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ভবেশ চক্রবর্তী ভক্ত জানান, এসিড ব্যবহারের কারখানাগুলো স্থানান্তরের কথা ইতিপূর্বে শুনেছিলাম। নিরাপত্তার কারণেই হয়তো স্থানান্তর করা হয়নি। প্রশাসনিকভাবে যদি কারখানাগুলো স্থানান্তর করেন এবং নিরাপত্তার ব্যবস্থা করেন তাহলে স্থানান্তরে আমাদের কোনো আপত্তি থাকবেনা। তবে সোনার দোকানের কাছাকাছি কারখানা থাকলে ভাল হয়।

এবিষযে বগুড়াস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের পরিচালক সুফিয়া নাজিমের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি কর্মস্থলে নতুন যোগদান করেছেন বলে জানিয়ে এই প্রতিবেদককে রাজশাহীস্থ পরিবেশ অধিদপ্তরের উপপরিচালকের সাথে কথা বলার পরামর্শ দেন। 

রাজশাহীর সিনিয়র কেমিস্ট মিজানুর রহমান জানান, রাজশাহী অফিসের উপপরিচালক মাহমুদা পারভিন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে রয়েছেন। তবে মিজানুর রহমান বলেন, জনগুরুত্বপুর্ণ বিষয়টি উর্ধতন কতৃপক্ষকে জানিয়ে পরবর্তী পদক্ষেপ নেয়া হবে। দুই একদিনের মধ্যে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করাসহ জেলা প্রশাসন ও জুয়েলারি সমিতির নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলে কারখানা সরিয়ে নেয়ার বিষয়ে সহায়তা চাওয়া হবে। এছাড়া এনিয়ে কি পদক্ষেপ নেয়া যায় সে ব্যাপারে স্থানীয় বিশিষ্টজনদেরও পরার্মশ নেওয়া হবে। 
 
নাটোরের জেলা প্রশাসক শামীম আহমেদ বলেন, তিনি কিছুদিন হল নাটোর কর্মস্থলে যোগদান করেছেন। অনেক কিছুই তিনি এখনও অবগত হতে পারেননি। তবে আবাসিক এলাকায় এসিডে সোনা গলানোর বিষয়টি সমর্থণযোগ্য নয় বলে জানান তিনি। 

তিনি জানান, পরিবেশ অধিদপ্তরের এবিষয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। তবে সমস্যার সমাধানে এলকাবাসীসহ বিশিষ্টজনদের সাথে আলাপ করে সমন্বিত উদ্যোগ নেয়া যেতে পারে। এ বিষয়ে স্বর্ণ ব্যবসায়ীসহ জুয়েলারি মালিক সমিতিকে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। তাদের সার্বিক সহযোগিতার প্রয়োজন রয়েছে।

এএইচ/