পাঠক হারাচ্ছে পাঠাগার
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ০২:২৪ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১ বুধবার
মানুষ আনন্দ সন্ধানী, তবে বস্তুগত ভোগ-বিলাস কিছুতেই জাগতিক জীবনকে আনন্দ দিতে পারে না। বই-ই পারে আনন্দ দিতে এবং নিবিড় আনন্দকে বাড়িয়ে তুলতে। শতাব্দী থেকে শতাব্দী ধরে মানুষের সব জ্ঞান জমা রয়েছে বইয়ের ভেতরে। অন্তহীন জ্ঞানের উৎস হলো বই, আর সেই বইয়ের আবাসস্থল হলো পাঠাগার। মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই পাঠাগার বা গ্রন্থাগারের উৎপত্তি।
পাঠাগার একটি জাতির বিকাশ ও উন্নতির মানদণ্ড। বই পড়ার মাধ্যমে মানুষ জ্ঞানের রাজ্যের সাথে পরিচিত হয়। শিক্ষার সর্বপ্রধান অঙ্গ হলো বইপড়া-সাহিত্যচর্চা। আর সাহিত্যচর্চা করতে হয় বই পড়ে জ্ঞানার্জনের মাধ্যমে। বই পড়া ছাড়া উপায় নেই। বই পড়ে কিংবা কিনে কেউ দেউলিয়া হয়েছেন এমন কোন রেকর্ডও নেই। বইয়ের সমাহার বা সুসসজ্জিত বাগানই হলো পাঠাগার। এটি মানুষের বয়স, রুচি ও চাহিদা অনুযায়ী সরবরাহ করে থাকে। যা সমাজ জাতি ও দেশ গড়া কিংবা রক্ষার কাজে অমূল্য অবদান রাখে।
জ্ঞান আহরণের সহজ মাধ্যম পাঠাগার বা গ্রন্থাগারের উপযোগিতা চিন্তাশীল মানুষের কাছে অনেক বেশি। আর আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশে পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা উন্নত দেশগুলোর চেয়ে অনেক বেশি। কারণ যেখানে মৌলিক চাহিদা মেটাতেই হিমশিম খাই, সেখানে আমাদের পক্ষে বই কিনে পড়া অনেক সময় সম্ভব হয় না।
মানুষের মধ্যে শিক্ষা বিস্তারের ক্ষেত্রে পাঠাগারের ভূমিকা অভাবনীয়, এটি জ্ঞানের আলো বিতরণ করে আলোকিত মানুষ-পরিবার সমাজ তথা জাতি গঠনে অবদান রাখে। তাই চিরায়ত বাংলায় বিদ্যুৎসাহী ব্যক্তি, ছাত্র-ছাত্রী তরুণ যুবকদের ব্যক্তিগত-সামষ্টিক উদ্যোগে স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, জনকল্যাণমূলক ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন জনহিতকর সংগঠনের উদ্যোগে গ্রামেগঞ্জে শহরের অলি-গলি-মহল্লাগুলোতে আবহমান কাল ধরে গড়ে উঠেছিল বই পড়ার আন্দোলন। ‘আলোকিত মানুষ চাই’, ‘পড়বো বই গড়বো দেশ’, ‘এসো বই পড়ি’ ইত্যাদি শ্লোগান নিয়ে শত-সহস্র পাঠাগার। চিড়ায়ত বাংলা থেকে আবহমান কালের সেই সব পাঠাগার গ্রামগঞ্জে ও শহরের অলি-গলি-মহল্লা থেকে হারিয়ে যাচ্ছে।
পাঠাগার কী এবং পৃথিবীর প্রথম গ্রন্থাগার
পাঠাগারের সন্ধিবিচ্ছেদ করলে হয় ‘পাঠ+আগার’ পাঠাগার। পাঠাগার হলো পাঠ করার সামগ্রী সজ্জিত আগার বা ঘর। অর্থাৎ নানা ধরনের বইয়ের সংগ্রহশালাই হচ্ছে পাঠাগার বা গ্রন্থাগার। পাঠাগারে সেই বিষয় সংক্রান্ত অন্যান্য বই পড়লে বিষয়টি সহজবোধ্য হয়ে ওঠে, মানুষের বই পড়ার আগ্রহ থেকেই গ্রন্থাগারের উৎপত্তি। শিক্ষার্থী পাঠাগারে প্রবেশ করলে তার সামনে খুলে যায় ভাবনার অপার দুয়ার। পাঠাগারের একেকটি বই তাকে একেক বিষয় সম্পর্কে ধারণা দেয়। এতে তার পরিধি বিস্তৃত হয়, যা তাকে একজন ভালো শিক্ষার্থী হতে সাহায্য করে। বই পড়ার মাধ্যমে শিল্প, সংস্কৃতি, ইতিহাস, বিজ্ঞান, ধর্ম ও সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে সে বিচরণ করতে পারে, যা তার পরবর্তী জীবনযাত্রাকে সহজ ও পরিশীলিত করে।
গ্রন্থাগারের ইতিহাস বেশ পুরনো। প্রথম দিকে মানুষ নিজের ঘরের কোণে, মসজিদ, মন্দির, উপাসনালয়ে এবং রাজকীয় ভবনে গ্রন্থ সংরক্ষণ করতে শুরু করে। সর্ব সাধারণের মধ্যে জ্ঞানের আলো বিস্তারের জন্য খ্রিস্টীয় প্রথম শতাব্দীতে রোমে প্রথম গ্রন্থাগার স্থাপিত হয়।
পাঠাগার শিক্ষার বাতিঘর
পুঁথিগত বিদ্যার ভারে জর্জরিত ছাত্রসমাজের মানসিক প্রশান্তির জন্য পাঠাগার অপরিহার্য। পাঠাগার শুধু ভালো ছাত্রই নয়, ভালো মানুষও হতে শেখায়। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলা ছাড়া জাতীয় চেতনার জাগরণ হয় না। আর তাই পাঠাগারের প্রয়োজনীয়তা অপরিসীম। পৃথিবীর বহুদেশ পাঠকের চাহিদা পূরণের জন্য গড়ে তুলেছে অগণিত পাঠাগার। শিক্ষার আলো বঞ্চিত কোনো জাতি পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারেনি।
শিক্ষার বাতিঘর বলা হয় পাঠাগারকে। এটি ছাড়া কোনো সমাজ বা রাষ্ট্র তার নাগরিককে পরিপূর্ণ শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে পারে না। তাই এর প্রয়োজনীয়তা প্রতিটি সমাজে অনিবার্য। বই পড়লে একজন শিক্ষার্থী হয়ে ওঠে আচরণে মার্জিত, চিন্তায় স্বতঃস্ফূর্ত ও কর্মে দৃপ্ত। পাঠাগার শুধু পড়াশোনায় নয়, মানসিক গঠনেও প্রভাবিত করে। পাঠাগার অতীত, বর্তমান, ভবিষ্যতের সেতুবন্ধন রচনার অনন্য মাধ্যম। মানুষের চিন্তা-ভাবনা, বাস্তবতা ও কল্পনা বইয়ের মাধ্যমে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চারিত হয়।
পাঠাগারের ভূমিকা বা প্রয়োজনীয়তা
বইয়ের প্রতি মানুয়ের ভালোবাসা বা দুর্নিবার টান আজন্মের। সেল ফোন, ইউটিউব নেটফ্লিক্সের যুগে এখনো মানুষ বই পড়ে। অনেকে বইয়ের বদলে ই-বুক পড়ে। তারপরও একটা বিতর্ক লেগেই আছে বইয়ের পাঠক কি কমে যাচ্ছে? যদিও এ ব্যাপারে সুনির্দিষ্ট জরিপ নেই। বই পাঠককে আলোকিত করে, পথ দেখায়, যুক্তিবুদ্ধি জোগায়, চিন্তাশীল করে, ভেতরের সম্ভাবনাগুলো জাগিয়ে তোলে। পরিপূর্ণভাবে বেড়ে ওঠার জন্য প্রয়োজন জ্ঞানের অবাধ ও উন্মুক্ত চর্চার শক্তি যোগায়। সভ্যতা ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটানোর জন্য বই পড়ার বিকল্প নেই। বই সৃজনশীল মননশীলতা তৈরি করে; নতুন ভুবনে প্রবেশ করায়। স্বপ্নময় স্বাধীন চেতনা সৌধ নির্মাণে সহায়তা করে। তাই মানব জীবনে পাঠাগারের ভূমিকা অপরিসীম এবং প্রয়োজনীয়তা অনস্বীকার্য।
আল্লাহ রাব্বুল আলামীন মানব জাতি সরল সঠিক পথ প্রদর্শনের জন্য নাযিলকৃত সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ মহাগ্রন্থে মানবতার মুক্তির মহানায়ক মুহাম্মদ (সাঃ) এর মাধ্যমে নির্দেশ দিচ্ছেন-
‘পড় (পাঠ কর) তোমার প্রভুর নামে, যিনি তোমাকে সৃষ্টি করেছেন’
অন্যত্র তিনি আরও বলেছেন- ‘যে জানে (জ্ঞানী) আর যে জানে না (জ্ঞানী নয়) কি সমান?
পৃথিবীর সকল ধর্মগ্রন্থ, সকল আদর্শ, মতবাদ, জ্ঞানী-গুনী, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ সকলই বই পড়ার প্রতি সবিশেষ গুরুত্বারোপ করেছেন।
ফার্সি সাহিত্য তো বটেই বিশ্ব সাহিত্যের এক অনন্য বিস্ময়কর প্রতিভা পারস্যের কিংবদন্তী কবি গিয়াসউদ্দিন আবুল ফাতেহ ওমর ইবনে ইব্রাহিম আল-খৈয়াম নিশাপুরি বলেন- ‘রুটি মদ ফুরিয়ে যাবে, প্রিয়ার কালো চোখ ঘোলাটে হয়ে আসবে, কিন্তু বইখানা অনন্ত-যৌবনা যদি তেমন বই হয়।’
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর লাইব্রেরি প্রবন্ধে পাঠাগার সম্পর্কে লিখেছেন, ‘কত নদী সমুদ্র পর্বত লঙ্ঘন করিয়া মানবের কণ্ঠ এখানে আসিয়া পৌঁছিয়াছে কত শত বৎসরের প্রান্ত হইতে এই স্বর আসিতেছে।’ অর্থাৎ লাইব্রেরিতেই মানব হৃদয়ের উত্থান-পতনের শব্দ শোনা যায়। এজন্য রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রবন্ধটিতে লাইব্রেরিকে মহাসমুদ্রের কল্লোল ধ্বনির সঙ্গে তুলনা করেছেন। অন্যদিকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, ‘মানুষ বই দিয়ে অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যে সাঁকো বেঁধে দিয়েছে।’
প্রমথ চৌধুরী বলেছেন ‘সুশিক্ষিত লোক মাত্রই স্বশিক্ষিত’। প্রমথ চৌধুরীর মতে, ‘লাইব্রেরি হচ্ছে এক ধরনের মনের হাসপাতাল।’ সুশিক্ষায় শিক্ষিত হতে হলে মানুষকে বই পড়তে হবে।
সৃজনশীল ও মননশীলতা গঠনে পাঠাগার
সৃজনশীলতা-মননশীলতা ও ব্যক্তিত্ব বিকাশের শুরুর পর্ব হলো শৈশব। এটাই মানুষের প্রকৃত মানুষ হয়ে ওঠার প্রথম ধাপ। কিছুকাল আগেও দেশের গ্রামে ও শহরে শৈশব ছিল মোটের ওপর আনন্দদায়ক। গ্রামের ছেলেমেয়েদের সুযোগ ছিল প্রকৃতির নিবিড় সান্নিধ্যে খেলাধূলাসহ নানা ধরনের আনন্দ-বিনোদনের মধ্য দিয়ে বেড়ে ওঠার। বিস্তির্ণ মাঠে নানা ধরনের খেলাধুলা, নদী কিংবা দিঘি-পুকুরে সাঁতার কাটা, ঘুড়ি ওড়ানো, মেঠোপথ ধরে বিদ্যালয়ে যাওয়া এসবই দৈহিক ও মানসিক সুস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী। গ্রামের ছেলেমেয়েদের শৈশব এভাবেই কেটে যেত। যৌথ পরিবার প্রথায় সবার আদর-ভালোবাসা বরাদ্দ ছিল তাদের জন্য। রাতে দাদা-দাদির মুখে নানান শিক্ষণীয় ও রূপকথার গল্প শুনতে শুনতে তারা হারিয়ে যেত স্বপ্ন রাঙা রঙিন দেশে।
সবুজ-শ্যামল ফসলের আইল বেয়ে গড়ে উঠা বাংলার গ্রামে গঞ্জে, শহরের অলি-গলি-মহল্লাগুলোতে আবহমান কালে তৈরি হ্ওয়া পাঠাগারের মাধ্যমে সূচিত হয়েছিল বই পড়া আন্দোলন। সময়ের স্রোতে সে বই পড়ার-পাঠাগার হারিয়ে গিয়ে কমেছে পাঠাভ্যাস। ফলে একটি সৃজনশীল ও মননশীল জাতি হিসেবে আমরা প্রত্যাশিত মাত্রায় বিকশিত হতে পারছি না।
বইপড়া ও আড্ডায় ভাটার সুর
তথ্য প্রযুক্তির ব্যাপক বিস্তার ঘটেছে; ইন্টারনেটের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো হয়ে উঠেছে খুব জনপ্রিয়। বই পড়া কমেছে, কমেছে বইয়ের উপযোগিতা। বিভিন্ন ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্র এখন শিক্ষিত তরুণ সমাজের দিনরাত্রির সঙ্গী। মননশীলতা চর্চার অভাবে সুকুমার বৃত্তিগুলো যেন হারিয়ে যেতে বসেছে। একটা সময় ছিল যখন তরুণদের অনেকেরই অবসর কাটত বই পড়ে। নতুন বইয়ের ভাঁজ খুলে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টে পড়ার মধ্যে তাঁরা অন্য রকম এক আনন্দ পেতেন। নব্বইয়ের দশকে জন্ম নেওয়া কিশোরদের মধ্যে কাজী আনোয়ার হোসেনের গোয়েন্দা সিরিজ মাসুদ রানা কিংবা মুহম্মদ জাফর ইকবালের বইগুলো অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। এই শতকের প্রথম দশকের শুরুতেও বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের সবুজ ঘাসে কিংবা চায়ের দোকানে তরুণদের সাহিত্য আড্ডা বসত। সেসব আড্ডায় গল্প হতো শিল্প, সাহিত্য, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি বিষয় নিয়ে। ক্রমে সে ধরনের আড্ডায় ভাটা পড়েছে।
পাঠাগার যেন হারানো দিনের স্মৃতি
বড় শহর ছোট ছোট মফস্বল শহর ও আমাদের শেকড় প্রোথিত গ্রামের ও শৈশব ছিল অনেক আনন্দময়। কিন্তু কালের পরিক্রমায় আজ সবকিছুই সংকুচিত হয়ে এসেছে। খেলাধুলা, নাটক, গানবাজনার অনুষ্ঠান আর আগের মতো হয় না। আগের মতো ক্লাব ও শিশু-কিশোর সংগঠনও নেই। এখন ব্যাগভর্তি বইখাতা নিয়ে বিদ্যালয়ে ছুটে যাওয়া; বিদ্যালয় থেকে ফিরেও ‘কোচিং’ করতে এক শিক্ষকের কাছ থেকে অন্য শিক্ষকের কাছে ছোটা। এভাবে ছেলেমেয়েদের শৈশব পার হয়ে যাচ্ছে। শৈশব-কৈশোরের প্রায় সব আনন্দই যেন হারিয়ে যাচ্ছে। এভাবে যারা তরুণ বয়সে পা রাখছে, তাদের মানসিক বিকাশ যথেষ্ট নয়। তারা ফেসবুক, টুইটার ইত্যাদি সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমের সর্বগ্রাসী প্রভাবের মধ্যে বই পড়ার সংস্কৃতি দূরে সরে যাচ্ছে।
নেই বই পড়ার আগ্রহ-উদ্যোগ। ঝিমিয়ে পরছে পাঠাগার তৈরি আন্দেলন। পাঠাগারগুলোতে এখন হতাশাব্যঞ্জক শূন্যতা। বইয়ের দোকানও কমে যাচ্ছে। ডিজিটাল যোগাযোগ প্রযুক্তির ফলে তথ্য ও জ্ঞান বিস্তারের অভূতপূর্ব সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। পৃথিবীর অনেক দেশে ছাপা বইয়ের বিকল্প হিসেবে ইলেকট্রনিক বুক বা ই-বুকের প্রচলন বাড়ছে। আবহমান চিরায়ত বাংলায় স্কুল, কলেজ, অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন ধরনের ক্লাব ও সংগঠনের উদ্যোগে পাড়া-মহল্লাগুলোতে গড়ে উঠা পাঠাগার যেন হারানো দিনের শুধুই স্মৃতি।
আড়ালে পড়ে যাচ্ছে আলোর মশাল জ্বালানো পাঠাগার
পুঁথিগত বিদ্যায় প্রায় বন্দি হয়ে গেছে আমাদের শিক্ষা। পাঠ্যপুস্তক বা সিলেবাসনির্ভর পড়ালেখা ছাত্রছাত্রীদের জ্ঞানের জগৎ খণ্ডিত করে দিচ্ছে, দেশে পাসের হার বাড়লেও শিক্ষার মানে তেমন উন্নতি নেই। নতুন নতুন প্রযুক্তির কল্যাণে দৈনন্দিন জীবনে আধুনিকতার ছোঁয়া লেগেছে; কিন্তু মানুষের মননে, মূল্যবোধে তার প্রভাব পড়ছে না। বিজ্ঞান যখন অর্থনীতিকে এগিয়ে নিচ্ছে, মানুষ হয়ে পড়ছে আরো বেশি আত্মকেন্দ্রিক ও স্বার্থপর। এই ভারসাম্যহীনতা ঘোচাতে চাইলে মানুষকে শেষ পর্যন্ত বইয়ের কাছেই ফিরতে হবে। তা না হলে প্রকৃত জ্ঞানের সন্ধান মিলবে না। বিকাশ ঘটবে না নৈতিক ও মানবিক মূল্যবোধের।
সমাজে অপরাধপ্রবণতা বেড়ে যাওয়ার পেছনে বিশেষজ্ঞরা মানুষের মূল্যবোধের পতনকেই বেশি দায়ী করে থাকেন। ভারসাম্যপূর্ণ শিক্ষা ছাড়া ছাত্রছাত্রীদের দৃঢ় মূল্যবোধ গড়ে ওঠে না। ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন, ফেসবুক সুলভ হওয়ায় তারা বই দূরে ঠেলে দিচ্ছে। অতিমাত্রায় প্রযুক্তিনির্ভরতা তাদের আচরণেও নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে। বিশিষ্টজনরা বলছেন, শিশু-কিশোর ও তরুণদের সিলেবাসের সংকীর্ণ গণ্ডি থেকে বের করতে পারে পাঠাগার।
দেশে বইও বেরোচ্ছে প্রচুর কিন্তু কমেছে পাঠক ও পাঠাগারের সংখ্যা। অল্প বয়সীদের বেশির ভাগই বইবিমুখ। দেশে কত সংখ্যক গ্রন্থাগার আছে, তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। এ ব্যাপারে কখনো কোনো জরিপ হয়নি। অতীতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উপস্থিতিতে সরগরম থাকত পাঠাগারগুলো। পাঠাগারকেন্দ্রিক সাহিত্য আন্দোলন গড়ে উঠত। এখনকার ব্যস্ত জীবনে ছোট বা বড়দের পাঠাগারে যাওয়ার সময় কই! পাঠকের অভাবে আড়ালে পড়ে যাচ্ছে একসময় আলোর মশাল জ্বালানো একেকটি পাঠাগার। তবে আশার কথা এখনো কোথাও কোথাও বিদ্যানুরাগী ব্যক্তি, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ক্লাব, জনকল্যাণমূলক ফাউন্ডেশন ও ট্রাস্ট ইত্যাদি বিভিন্ন জনহিতকর সংগঠনের উদ্যোগে দু’ একটি পাঠাগার হারিকেনের আলোর মতো টিমটিম করে জ্বলছে।
একটি সহনশীল ও মানবিক সমাজ গঠনে বই পড়ার বিকল্প নেই। বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তোলার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। প্রতিটি ঘরে পাড়া-মহল্লায় গ্রামেগঞ্জে হাটে-বাজারে প্রতিষ্ঠানে আমাদের হারিয়ে যাওয়া বইপড়া অভ্যাস পাঠচক্র গড়ে তোলা ও পাঠাগার তৈরি আন্দোলন শুরু করা দরকার। এ ক্ষেত্রে ই-বুকও অবশ্যই এর অন্তর্ভুক্ত হতে পারে। একটি সমাজের রূপরেখা বদলে দিতে পারে একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার। আজকের ছাত্ররাই আগামী দিনের জাতির কর্ণধার। তাদের মানসিক বিকাশের মাধ্যমে সমগ্র জাতির উন্নতি সম্ভব। তাই শহর, গ্রাম ও মহল্লা থেকে হারিয়ে যাওয়া পাঠাগার নতুন করে গড়তে হবে।
এএইচ/