ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

এই বিমানে একটা বোমা আছে

নাসিম হোসেন

প্রকাশিত : ০৯:১৫ পিএম, ২৫ আগস্ট ২০২১ বুধবার | আপডেট: ০৩:২৭ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একটি বিমান

চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে একটি বিমান

০৭ সেপ্টেম্বর ২০০৮। দুবাই এয়ারপোর্টে ঘণ্টা দুই অপেক্ষার পর এয়ার এরাবিয়ার সংযোগকারী ফ্লাইটে চড়ার ডাক পরলো। সুদানের রাজধানী খার্তুম থেকে ভোরে দুবাই এসেছি। তার আগে দক্ষিণ সুদানের জুবা থেকে ইউ এন ফ্লাইটে খার্তুমে আসতে ঘণ্টা দুয়েকের একটা অভ্যন্তরীণ ফ্লাইট নিতে হয়েছে। দেশে ফেরার এই দীর্ঘ যাত্রার এটাই শেষ অংশ। 

জর্ডানি মালিকানাধীন এয়ার এরাবিয়ার এই বিমানগুলো খুব ছোট আকারের কম পয়সায় যাতায়াতে ইচ্ছুক বাংলাদেশীদের কাছে আকর্ষণীয়। সস্তায় চলতে ইচ্ছুক বলে বিমানে বিনে পয়সায় কোন খাবার পরিবেশন করে না। ইনফ্লাইটে কিনে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। বিমানের সীটগুলো বিমানবালাদের মতোই আঁটো সাটো। তবে সস্তার তিন অবস্থার মতো নয় বিমানবালাদের দেহবল্লরী। লেবাননী বিমানবালাদের ভূমধ্যসাগরের তীরবর্তী লাল আপেলের মতোই গায়ের রং। চোখে পরার মতো।

ঢাকার পথে এয়ার এরাবিয়ার এই ফ্লাইটে সব সময় রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের ঠাসাঠাসি ভীড়। জাতিসংঘের শান্তি মিশনের ‘পিস মেকার’ নামের গালভারী নামের আড়ালে দুবাইতে আমিও একজন রেমিট্যান্স যোদ্ধা। মিশনের মাঝপথে ছুটিতে দেশে যাচ্ছি পকেটে বেশ কিছু সবুজ ডলারের বান্ডিল নিয়ে। 

আমার সহযাত্রী দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আসা ত্রিশোর্ধ এক যুবক। বেশ মলিন চেহারা। বিমানের অধিকাংশ যাত্রীই এখানে কায়িকশ্রমে জীবিকা নির্বাহ করা শ্রমিক শ্রেণীর মানুষ। 

বিমানবালারা বেশ ছুটোছুটি করে যাত্রীদের নিজ নিজ আসনে বসাতে সাহায্য করছে। পুরো বিমানের একটি আসনও খালি নেই। 

একটা গেটলক সার্ভিসের মতো। বিমান চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওনা হলো। বিমানের বেশীরভাগই বৃহত্তর চট্টগ্রামের অধিবাসী।

"বদ্দা ক্যান আঘো" - খাস চাটগাঁইয়া ভাষায় মুখরিত হয়ে উঠলো বিমানের বেশ কিছু সীটের যাত্রীদের সংলাপে। কেউ বিমানবালার উড্ডয়ন সংক্রান্ত করণীয়-বর্জনীয় নির্দেশাবলির ডেমনস্ট্রেশনের দিকে তেমন মনোযোগী নয়।
তবে বেশ নীচু স্বরে বিমানবালার শরীরের দর্শনীয় স্থান এবং বাকঁগুলি কেউ কেউ ‘চটি সাহিত্যের ভাষায় বর্ণনা করছিলো।  

বছর বছর বিদেশে স্ত্রীবিহীন জীবনযাপনে বাধ্য থাকা এই রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের রক্তচলাচল আরো দ্রুততর হয়ে যায় ভূমধ্যসাগরীয় লাল আঙ্গুরের মতো গালের রক্তিম আভা ছড়িয়ে যখন কেউ পাশ দিয়ে যায়।

কিছু সাহসী যোদ্ধা আবার নানা ছুতোয় বিমানবালাদের ডাক দিতো এটা ওটার জন্য। এসির ফ্যান এডজাস্ট করা সীটকে সুবিধাজনক এঙ্গেলে হেলানো-এসবের মাঝে বিমানবালার উর্ধাঙ্গের পিরামিডযুগলের একটু ক্লোজ ভিউ চেখে নেওয়া।

বাজেট এয়ারক্রাফট বলে একটা সস্তা সস্তা দুর্নাম থাকলেও বিমানের সরু চলাচলের পথ ধরে এই লেবাননী বিমানবালারা যখন হেটেঁ যেত তাদের দেহবল্লরী দেখে মনে হতো অস্কার পুরস্কার নিতে আসা লাল কার্পেটে হেটে বেড়ানো কোন হলিউডি নায়িকা।

এই হলিউডের নায়িকারা সবার মনে রেড ওয়াইনের পুলক ছড়ালেও আমার পাশে থাকা সাতক্ষীরার যুবক হারুন ছিলো নির্বিকার। বেশ শুষ্ক মুখে বিমানের জানালা ধরে বাইরে তাকিয়ে ছিলো। ওর মুখটা যেন দুবাইয়ের শুষ্ক মরুভূমির চেয়েও শুষ্ক। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে শেষবারের মতো দেখছিলো দুবাইয়ের চাকচিক্য। 

আমার খুব একটা আগ্রহ ছিলো না সহযাত্রীর সঙ্গে পরিচিত হওয়ার।তাই দীর্ঘ বিমান যাত্রায় ক্লান্ত বলে একটু চোখ বোজার চেষ্টা করলাম।  

বাঙ্গালী বলে কথা-‘ভাই আপনার দেশের বাড়ি কোথায়?’ 

হারুনের প্রশ্নে ঘুমের পরিকল্পনায় ছেদ পরলো। বিরক্ত বোধ করলাম। এই বুঝি শুরু হলো 'খাজুরা' আলাপ, বেটা এরপরে জানতে চাইবে কোথায় চাকরি, বেতন কত, মালিক কেমন, বিয়ে করছেন কোন জেলায়, ছেলেপুলে ক’জন ইত্যাদি ইত্যাদি। 

নব্বই ভাগ যাত্রী শ্রমিক ওরা যে কি কষ্টকর জীবন যাপন করে আমরা তা বুঝতে পারিনা। কাউকে একটু ভালো অবস্থায় দেখলে সাহায্যে চায়, নিজের কষ্টের কথা জানায়। আর যদি ‘দেশী’ লোকের দেখা পায় তা হলে তো কথাই নেই। 
ঢাকা-আমার ছোট উত্তর।

শহরে-আরেকটু ব্যাখা করি, যেন আর সম্পূরক প্রশ্ন না করে।

কিন্তু ঐ ডা তো দেশের বাড়ি হইলো না, গ্রামের বাড়ি কোন জেলায়? - হারুন বেশ আগ্রহ ভরে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলো।

আমার যা ধারনা ছিলো তাই হলো

-ভাই কোন কোম্পানিতে চাকরী করেন?

হারুনের আগ্রহে কোন ভাটা নেই। 

আমি সুদানে থাকি
হারুনের প্রশ্নের উত্তরে বলি।

আর যায় কোথায়- ভাই আমিও তো ঐখান থেকে আসছি। হারুন বলা শুরু করলো তার স্বপ্ন ভঙ্গ আর প্রবঞ্চনার কাহিনীঃ

সাতক্ষীরার এই যুবককে সুইডেন পাঠাবে বলে দালাল আরো কয়েকজনের সাথে বিমানে উঠায়। নানা পথ ঘুরে সুদানের রাজধানী খার্তুমে এনে বলে, সুইডেন এসে গেছি। বিমানবন্দরের বাইরে রেখে দালাল পালিয়ে যায়। কায়দা করে দাঁত চিবিয়ে 'সুদানকে সৌদান (সুইডেন) বলায় ওরা বুঝতে পারেনি। ওদের বোধদয় হয় বিমানবন্দরের বাইরে চারপাশে শুধু কালো কালো লোক দেখে। শুনেছে সুইডেনের লোক হয় সাদা এখানে এসে দেখে সব কালো কালো লোক। নানা ঘাটের জল খেয়ে এখন ভগ্নহৃদয়ে কর্পদক শূন্য হয়ে দেশে যাচ্ছে। 

মানুষ এতো বোকা হয়!! 

আমার বিস্ময়ের ঘোর কাটলো যখন বিমানবালা ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করার কাগজটা হাতে ধরিয়ে দিলো।

সুইডেন স্বপবিলাসী হারুন প্রায় নিরক্ষর ইংরেজি দূরে থাক বাংলাই তো পড়তে পারে না। হারুন তার স্বল্প শিক্ষার ফাঁদে পড়ে আফ্রিকায় সুইডেন খুঁজে না পেয়ে দেশে ফিরছে। 

অন্যদিকে আমার সীট থেকে দুধাপ আগে বসা আরেক দেশি ভাইয়ের মনে তখন ভূমধ্যসাগরীয় আপেলের স্বাদ চেখে নিতে না পারার আক্ষেপে তার মনের বেদনা প্রকাশ করতে একটি চিরকুটে লিখে দিলো-
‘এই বিমানে একটা বোমা আছে সাড়ে বারোটায় ফাটবে।’

চলাচলের পথে যেন দৃশ্যমান হয় এমনভাবেই চিরকুটটা ফেলে রাখলো।

লেবাননী বিমানবালা তার এক পুরুষ সহকর্মীর হাতে ওটা ধরিয়ে দিয়ে জানতে চায় কি লেখা আছে তাতে!

ভারতীয় বংশদ্ভূত বাঙ্গালি বাবুর হাতে ওটা পরা মাত্র উনি তার শাব্দিক অর্থ ধরে এগুলেনঃ

‘বোমা মানে বোমা- বিমানবালার যুগল পিরামিড নয়!’

‘মে ডে মে ডে!!’ রব উঠলো বিমানে।

বিমান দুপুর সাড়ে বারোটা নাগাদ চট্টগ্রামে ল্যান্ড করবে। মায়ানমারের উপর দিয়ে যেতে যেতে ককপিট থেকে ইংরেজিতে ছোট্ট করে ঘোষণা হলোঃ

‘নিজ নিজ আসনে বসে থাকুন, পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত সিট বেল্ট পরিধান করে থাকুন।’

ঘোষণাটি বেশ কয়েকবার হলে আমার কেন জানি একটু সন্দেহ হলোঃ ব্যাপারটা কি!

ফিস ফিস করে কথা বলতে বলতে সকল ক্রু বিমানের চলাচলের পথের উপর দূরত্ব ভাগাভাগি করে দাঁড়িয়ে গেল।

অধিকাংশ রেমিট্যান্স যোদ্ধাই ওদের এভাবে দাঁড়ানোকে তেমন গুরুত্ব দিলো না। হয়তো বা তারা ঘোষণাটি বুঝতেই পারেনি-যেমন হারুন বুঝেনি সুইডেন আর সৌদান(সুদানের) মাঝের ফারাক।

আর ককপিটে থাকা পাইলটগুলো এমন স্কটিস উচ্চারণে দ্রুত কথা বলে যার অর্থ করা সচরাচর না শোনা যাত্রীর জন্য তো সহজ বিষয় নয়।

শুরু হলো ওভার হেড কেবিন খুলে চেক, যাত্রীদের আসনের আশে পাশে চেক, সীটের সামনের পকেটে চেক। 

লাল গোলাপি বিমানবালাদের কপালের ভাজে দেখা মিললো চিকন ঘামের রেখা।

এক আত্মঘাতী বোমার খোঁজে গলদঘর্ম সবাই। 

কিছুক্ষণ পরে ককপিট থেকে ঘোষণা এলো, ‘আমরা মায়ানমার ভূখণ্ডের উপর দিয়ে যাচ্ছি, অল্প সময় পর আমার চট্টগ্রাম বিমানবন্দরে অবতরণ করবো, সকল যাত্রী সাধারণকে পরবর্তী নির্দেশনা না দেওয়া পর্যন্ত নিজ নিজ আসনে বসে থাকতে অনুরোধ করা হলো।’

যাত্রীদের মধ্যে ঘোষণাতে মনোযোগ দেওয়ার অবকাশ নেই। অনেকেই উঠে দাড়িঁয়ে কেবিন থেকে মালামাল নামাতে উঠে দাঁড়াতেই লাল গোলাপি বিমানবালারা রে রে করে ছুটে এলো, ‘স্টপ ইট, স্টপ ইট’, রিমেন ইন ইয়র সীট।’

বঙ্গোপসাগরের নীল জল রাশি দেখা যাচ্ছে, বিমানটা ধীরে ধীরে নামছে সাগরের নীল জল পেরিয়ে কর্ণফুলি মোহনার ঘোলা জল এবার স্পষ্ট। 

কিন্তু ততক্ষণে বিমানবন্দরে অবস্থাও সাগরের ঘোলা জলের মতোই - রানওয়ের চারপাশে বিমানবাহিনীর সৈনিকবাহী গাড়ি, এমওডিসির খাকি পোশাকের সৈনিক, ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি, আনসারসহ নানা কিসিমের এক যৌথবাহিনীর দেখা মিললো।

এবার আমার স্পষ্ট ধারণা হলো ‘ডাল মে কুচ কালা হ্যায়’। ইতিপূর্বে বার বার দেওয়া ঘোষণাগুলির সঙ্গে নিচের জমায়েতের একটা সম্পর্ক আছে বুঝতে পারলাম। 

কিন্তু ঘাপলাটা কি নিয়ে সেটাই বুঝতে পারছিলাম না।

একটা বিমান হাইজ্যাকের গন্ধ পেলাম। ইতিপূর্বে সিনেমা বা ডকুমেন্টারি ফিল্মে কত গল্পই না পড়েছি তবে আজ কি তেমন কিছুর স্বাক্ষী হতে যাচ্ছি!?

বিমান টাচডাউন করার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের পাশ ঘেঁষে অনেক ফায়ার সার্ভিসের গাড়িও চলতে থাকলো। একসময় বিমানটা ট্যাক্সীওয়ের পাশে স্থিত হলো। বেশ কিছুসময় পরে সামনের দরজাটি খুলে দেওয়া হলো। বেশ যুদ্ধ সাজে বিমানবাহিনীর এক কর্মকর্তা বিমানে প্রবেশ করলেন। আমরা ভাবছিলাম হয়তে বিমানে কোন সন্ত্রাসী আছে বা চোরাই কোন বস্তুর সন্ধানে তারা আসছেন।

কর্মকর্তা বিমানে এসে বাহিরের এতো সব আয়োজনের শানে নুজুল ব্যাখ্যা দিলেন, ‘আমাদের কাছে সংবাদ আছে বিমানে কোন বিস্ফোরক আছে, আপনারা সব লাগেজ বিমানে রেখে শুধু পাসপোর্ট হাতে করে নেমে যান, লাউঞ্জে অপেক্ষা করুন, আমরা তল্লাশী শেষ করে আপনাদের যেতে দিবো।

উদ্বেগ উৎকণ্ঠা অবসানের একটা পথ পাওয়া গেল।

দুপাশে নিরাপত্তাকর্মী পরিবেষ্টিত হয়ে যুদ্ধ ক্ষেত্রে আত্মসমর্পনকারী সৈনিকের মতো লাইন ধরে আমরা লাউঞ্জের দিকে এগুতে থাকলাম।

লাউঞ্জে এনে সকলকে অপেক্ষা করতে বলা হলো। কিছুসময় পর বিমান বাহিনীর আরো বড়সড় কর্মকর্তারা হাজির হলেন।

তিনি এবার আসল ঘটনাটি বললেনঃ ‘আপনাদের মধ্যে কোন যাত্রী বিমানে বোমা রাখা আছে বলে একটি চিরকুটে উল্লেখ করেছেন, যিনি এটা লিখেছেন তিনি যদি আমাদের সহায়তা করেন তবে আপনারা তাড়াতাড়ি ‘ছাড়া’ পাবেন। যিনি লিখেছেন তিনি যদি স্বেচ্ছায় এগিয়ে আসেন তবে তার বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেওয়া হবে না। 

লাউঞ্জের সকল যাত্রী পরস্পরের দিকে সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকাতে লাগলো। আমি ভাবলাম এই নাটকের জন্য আজ সবাইকে ভোগান্তি পোহাতে হবে। বোমা থাকলেতো ফেটেই যেত। এখন সবাইকে জঙ্গী কলংক নিয়ে সময় কাটাতে হবে। তবে এতোক্ষণে দেশের ‘টিআরপি’ পাগল টিভি চ্যানেলগুলি নিশ্চয়ই ব্রেকিং নিউজ দিয়ে দর্শকদের মাথা ঘোলা করতে লেগেছে – ‘চট্টগ্রামে এয়ার এরাবিয়ার বিমানে বোমাতংক-বিমানবন্দরে যাত্রীবাহী বিমানের অবতরণ বন্ধ-বিমানটি তল্লাশি করতে সামরিক বাহিনীর বিস্ফোরক টীমের তল্লাশী’ ইত্যাদি ইত্যাদি। 

যাইহোক কিছু সময় পরে যাত্রীদের এক টুকরো কাগজ আর কলম দিয়ে নিজের নাম ঠিকানা বাংলায় লিখে দিতে বলা হলো।

বুঝলাম শৈশবে পড়া কিরীটী রায়ের গোয়েন্দাদের মতো আমাদের সামরিক কর্মকর্তারাও অপরাধী সনাক্তকরণের বেসিক পদ্ধতি ‘হস্তলেখার’ সাহায্য নিচ্ছেন।  

সবার মতো আমিও লিখে জমা দিলাম। চারপাশে সামরিক কর্মকর্তাদের সংখ্যা ক্রমেই বাড়তে থাকলো। তারা শেন্যদৃষ্টিতে আমাদের পাসপোর্ট আর মুখের দিকে তাকিয়ে বোমাবাজকে সনাক্ত করার চেষ্টা করতে থাকলেন। আমার সামরিক পরিচয় বাহ্যিকভাবে এবং পাসপোর্টের মাধ্যমে প্রকাশ পেলেও বিমানসেনা আমাকেও সন্ত্রাসী রাডার বীমের আওতায় রাখলো। তবে ততক্ষণে আমি এসবকে উপভোগ করা শুরু করেছি। ভাবলাম আজকে এরা একটা পয়েন্ট স্কোর করার সুযোগ পেয়েছে করুক না। নিজেকেও ঐ রেমিট্যান্স যোদ্ধাদের কাতার থেকে আলাদা করার কোন চেষ্টা করলাম না।

এবার আরো বড় কর্মকর্তা ঘোষণা দিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের মধ্যে কাউকে কিছু লিখতে দেখেছেন? যদি দেখে থাকেন তবে তাকে দেখিয়ে দেন।’

আমার সামনের কয়েক ধাপ আগে বসা সেই চাটগাঁইয়া যুবক আমার দিকে আংগুল তুলে দেখিয়ে দিলো। মনে মনে বলে উঠলাম, ‘হাউ ফানি’।

একজন কর্মকর্তা এসে জিজ্ঞেস করলেন পরিচয়। UNMIS (United Nations Mission in Sudan) - Major এসব পরিচয় থাকলেও সেদিকে তেমন গুরুত্ব দিলেন না। আমিও সেসবের তোয়াক্কা না করেই বললাম, ‘হ্যাঁ, আমার সহযাত্রীকে ইমিগ্রেশন ফর্ম পূরণ করে দিয়েছি। 

বেশ সময় ধরে অপরাধী খোঁজার এই ‘হরকত’ চলতে থাকলো। আমি উঠে টয়লেটে যাবো বলে হাঁটা শুরু করলাম। স্ট্যান্ডিং ইউরিনালের পাশে দাড়িঁয়ে জিপারে হাত দিতেই দেখলাম দু'জন এমওডিসির সৈনিক দুপাশে খুব কাছ ঘেঁষে উঁকি দিচ্ছে।

‘কি দেখবে নাকি?’ - আমি বললাম। 

ওরা একটু সরে দাড়ালো, তবে বেশ আড়চোখে নজর রাখলো আমি আবার টয়লেটে কিছু ফেলে দেই কিনা।

মনে মনে আনন্দ পাওয়ার চেষ্টা করলাম-হিসু করতে গিয়ে এরকম সশস্ত্র স্কর্ট পাওয়া খারাপ কিছু না।

ফিরে এসে দেখি আমাকে সনাক্তকারী যুবককে ঘিরে কর্মকর্তাদের জটলা- 
‘পাইছি তোমারে’ - এমন একটা ভাব।

এতক্ষণ পর্যন্ত স্মার্ট স্মার্ট ভাব নিয়ে থাকা যুবক কর্মকর্তাদের পা জড়িয়ে আছেন।

‘স্যার আমি মজা করার জন্য লিখেছি-বিমানবালাদের ফিগার দেখে।’

যাইহোক বিমানের বোমা রহস্যের সমাধান হলো ঘণ্টাদুয়েকের সম্মিলিত হেনস্তা হওয়ার মধ্য দিয়ে। আর এই হেনস্তা করার সাজা নিতে জেলে গেল আমার চাটগাঁইয়া ‘বদ্দা’।

বিমানবন্দরের বাইরে স্থানীয় সাংবাদিক, টিভি কর্মীদের ভীড় ঠেলে একটু হালকা হয়ে আমাকে নিতে আসা গাড়ির খোঁজ করছি। গাড়িতে উঠতে সুইডেন যেতে চেয়ে সুদূর সুদান ঘুরে আসা হারুনের মলিন মুখটি দেখতে পেলাম।
বেশি বুঝে 'বদ্দার' কম বুঝে হারুনের বারোটা বেজে গেছে।