টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার প্রাকৃতিক অক্সিজেন কারখানা সিআরবি
প্রফেসর ড. মো. সেলিম উদ্দিন
প্রকাশিত : ১১:৪৫ এএম, ২৮ আগস্ট ২০২১ শনিবার
শতবর্ষী বিভিন্ন প্রজাতির গাছ, উঁচু-নিচু পাহাড়, লেকের অবকাঠামো, আঁকাবাঁকা রাস্তা, ছোট ছোট মাঠ, রেলওয়ের সেই ঐতিহ্যবাহী লাল দালান, বৃক্ষরাজি জুড়ে নানা প্রজাতির জীবের সমাহার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অপরূপ লীলাভূমি চট্টগ্রামের সিআরবি। চট্টগ্রামের এই সিআরবি প্রকৃতির নন্দনকাননের সৌন্দর্যমন্ডিত কোনো সার্থক চিত্রশিল্পীর নিখুঁত চিত্রকর্মের সঙ্গে তুলনীয় একটি নাম। এটির নৈসর্গিক সৌন্দর্য যেমন অপরূপ, তেমনি মোহনীয় বিচিত্র আর অফুরন্ত সৌন্দর্যের ডালি সাজানো এই সিআরবি।
সিআরবির রূপ-মাধুর্য-ঐশ্বর্যে মুগ্ধ চট্টগ্রামের তথা এদেশের মানুষ। সিআরবিও তার রূপ আর ঐশ্বর্যের হাত বাড়িয়ে দেয় মানুষের দিকে। প্রকৃতি ও মানুষের ভালোবাসার সেতুবন্ধন রচনা করে সিআরবি। সৌন্দর্য প্রেমী, ভ্রমণপিপাসু, সংস্কৃতিমনা ও প্রকৃতিবাদী উৎসাহী মানুষকে আকৃষ্ট করে আসছে এই সিআরবি যুগ যুগ ধরে। সিআরবির মতো প্রকৃতি রাজ্যের বিশাল সম্ভার চট্টগ্রামের তথা সারাদেশের আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেরই দৃষ্টির নেশা ও মনের ক্ষুধা দুটোই মিটায়। কর্মক্লান্ত জীবনের অবসরে সকল শ্রেণি ও পেশার মানুষ পরিচ্ছন্ন মনের খোরাক যোগাতে প্রতিনিয়ত সিআরবির প্রকৃতির মাঝে অপার সুখ ও শান্তি খুঁজে নিচ্ছে ভয়ভীতিহীন ভাবে। এছাড়া আমাদের ঐতিহাসিক, জাতীয় ও ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলো সিআরবির এই প্রাকৃতিক পরিবেশে ভিন্ন এক রোমাঞ্চকর আমেজ সৃষ্টি করে। একদিকে প্রকৃতির অপার সৌন্দর্য যেমন মানুষকে করে স্নিগ্ধ-কোমল অনুভূতিপ্রবণ, তেমনই প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অন্যায়, অবিচার, দুর্নীতি, শোষণ ইত্যাদি ক্ষেত্রে এদেশের মানুষকে করে তুলেছে সাহসী ও সংগ্রামী। তাইতো চট্টগ্রামের নগরের ফুসফুস খ্যাত সিআরবিতে প্রকৃতি ধ্বংসের মাধ্যমে স্থাপনা নির্মাণের সিদ্ধান্ত বাতিলের জন্য এদেশের সচেতন নাগরিক তথা সকল বয়সের সকল পেশার ও শ্রেণির লোক ফুঁসে উঠেছে। চলমান আন্দোলনে একাত্মতা ঘোষণা এবং ক্ষোভ প্রকাশ অব্যাহত রয়েছে। বক্তব্য, বিবৃতি, সভা, সেমিনার, প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর বিভিন্ন ধারাবাহিক কর্মসূচি অব্যাহত রেখেছে চট্টগ্রামের সিআরবিকে রক্ষা করতে। একবার ভাবুন তো, প্রকৃতি সৃষ্ট শতবর্ষী কয়েকশ গাছসহ অজস্র ছায়াতরু ও গুল্মলতা বিশিষ্ট কয়েকশ’ একর এই সিআরবি’র প্রকৃতিকে ঝুঁকিতে ফেলে স্থাপনা নির্মাণের বিরুদ্ধে এত কেন সমালোচনার ঝড় উঠল? সারাদেশের মানুষ প্রকাশ্যে ও মৌন সমর্থন জানাচ্ছে তার কারণগুলো স্বল্প প্রয়াসে খুঁজে দেয়ার চেষ্টা করব।
প্রথমত, গাছ আমাদের পরম বন্ধু, শুধু পরম বন্ধু নয়। পরম আত্মীয় এবং এ ধরণীতে নিঃস্বার্থ, উপকারী ও প্রকৃত বন্ধু হলো বৃক্ষ। শুধু তাই নয়, গাছের অপর নাম জীবন। কেননা মানুষ ও সমগ্র প্রাণিজগতকে অক্সিজেন দিয়ে অনবরত বাঁচিয়ে রাখছে। তাই প্রতিটি গাছ এক একটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরি এবং গাছপালা ছাড়া পৃথিবীতে আমাদের জীবন অচল। কেননা বাতাসে শ্বাস নিতে না পারলে আমাদের মৃত্যু অনিবার্য।
আমরা সবাই জানি যে, নিঃশ্বাসের সঙ্গে আমরা কার্বন ডাই অক্সাইড নামে বিষাক্ত গ্যাস বাতাসে ছাড়ি। অন্যদিকে, গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রহণ করে ও বাতাসে অক্সিজেন ছাড়ে। সেই জন্য আমাদের সিআরবি একটি বড় ধরনের প্রাকৃতিক অক্সিজেন কারখানা। গবেষণায় দেখা যায়, একটি পরিপক্ক গাছ প্রতিদিন ২ থেকে ১০ জন লোকের জন্য যথেষ্ট অক্সিজেন যোগান দিতে পারে। কৌশলগতভাবে স্থাপিত গাছগুলো প্রাকৃতিকভাবে ঘরের রুমগুলোকে ঠাণ্ডা রাখে এবং শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। যার কারণে শুধু আর্থিক সাশ্রয় হয় না। এটি বিদ্যুৎ উৎপাদনের কারণে সৃষ্ট কার্বন-ডাই-অক্সাইড নির্গমন ও হ্রাস করবে। কথিত আছে যে, একটি পরিপক্ক গাছের ১৫টি কক্ষের এয়ার কন্ডিশনার সমান শীতল শক্তি রয়েছে। সঠিক স্থানে অবস্থানকারী গাছগুলো ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ জ্বালানি ব্যয় হ্রাস করতে পারে। তাইতো নিউইয়র্ক সিটির সেন্ট্রাল পার্কের কাছে ফ্ল্যাটগুলো অত্যন্ত পছন্দসই, আকর্ষণীয় এবং ব্যয়বহুলও বটে। গাছের একটি বড় স্ট্যান্ড যেমন সিআরবি একটি বড় শহরের তাপের পরিমাণও হ্রাস করতে পারে। আমরা জানি, কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমনই বৈশ্বিক উষ্ণতার জন্য দায়ী। আমি আগেই বলেছি, গাছগুলো বাতাস থেকে কার্বন-ডাই-অক্সাইড গ্রাস করে বৈশ্বিক উষ্ণতার বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, বৃক্ষরাজি বায়ুদূষণের সবচেয়ে বড় অবদানকারী কার্বন মনোক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই-অক্সাইড এবং সালফার ডাই-অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাস শোষণ করে বায়ু পরিষ্কার করে।
অনেকগুলো গবেষণায় দেখা গেছে একটি একক গাছ বছরে ২২ কিলো কার্বন শোষণ করতে পারে এবং একটি গাছের ৪০ বছর সময়ের মধ্যে প্রায় ১ টন কার্বন শোষণ করে নেয়, যেটি ১১০০০ মাইল গাড়ি চালানো থেকে নির্গমিত দূষণের সমান। এছাড়া এক একর গাছের বার্ষিক ৫ টন কার্বন ডাই-অক্সাইড এবং ১৩ টন অন্যান্য কণা ও গ্যাস অপসারণ করার ক্ষমতা রয়েছে।
গাছের উপরোক্ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মাত্র গুটিকয়েক অবদান পর্যালোচনায় বলা যায় যে, গাছ মানুষ এবং গ্রহের জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আমরা সবাই স্বীকার করি যে, গাছগুলো পরিবেশ রক্ষায় অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে, কিন্তু সম্ভবত এই অবিশ্বাস্য জীবের প্রকৃত অবদানের পরিমাণকে পুরোপুরি মূল্যায়ন করতে অসমর্থ হই।
অসংখ্য গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, গাছ এবং শহরের প্রকৃতির উপস্থিতি মানুষের মানসিক এবং শারীরিক স্বাস্থ্য, শিশুদের মনোযোগ, পান করার বিশুদ্ধপানি, অন্য প্রাণীদের খাবার যোগান, নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস, মাটি শক্তিশালীকরণ, ক্ষয় নিয়ন্ত্রণ, পানি দূষণ প্রতিরোধ ইত্যাদি রকমের বহুমাত্রিক সুবিধার কথা। এক পর্যালোচনায় দেখা যায় যে, গাছগুলো যে সুবিধাগুলো প্রদান করে সেগুলো যেকোন দেশ এবং শহর জাতিসংঘ কর্তৃক ঘোষিত ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার মধ্যে ১৫টি এসডিজির (টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা) লক্ষ্যমাত্রা পূরণে সহায়তা করে। তাই চট্টগ্রামের সিআরবি টেকসই উন্নয়নের হাতিয়ার। ছোট পরিসরের এই আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা নির্দ্বিধায় বলতে পারি যে, সিআরবি শুধুমাত্র একটি স্থানের নাম নয়, এটি স্বাস্থ্য সুরক্ষা এবং আর্থ-সামাজিক প্রাকৃতিক পরিবেশ সংরক্ষণের একটি জীবনের নাম। তাই সচেতন মানুষ এই জীবনকে বাঁচানোর জন্য প্রায় প্রতিদিনই শান্তিপূর্ণভাবে বিভিন্ন আলোচনা সভা, সেমিনার, মানববন্ধন, র্যালি এবং আরো প্রতিবাদী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে প্রস্তাবিত হাপসাতাল নির্মাণের বিরুদ্ধে তাদের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া, ক্ষোভ, আশংকা এবং বিরূপ অনুভূতি প্রকাশ করছে।
টেকসই উন্নয়নের অন্যতম হাতিয়ার তথা আমাদের পরিবেশ এবং মানুষের সুস্থতার জন্য গাছের অমূল্য গুরুত্ব আমলে নিলে কোন সচেতন মহল সিআরবিতে হাসপাতাল নির্মাণ কোনভাবেই মেনে নিবে না। তাছাড়া সিআরবির মত প্রাকৃতিক একটি স্বাস্থ্যকেন্দ্রকে ধ্বংস করে বাণিজ্যিক হাসপাতাল নির্মাণের পরিকল্পনা শুধু বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুস্থ পরিবেশে বাঁচার অধিকারকে অনিশ্চিত করা নয়, এটি বেআইনি এবং নৈতিকতা বিরোধীও বটে। এই গ্রহের জীব এবং জীবনকে রক্ষা করার স্বার্থে চট্টগ্রামের এক অসাধারণ স্থান সিআরবিতে কোন স্থাপনা নির্মাণ থেকে সরকারসহ যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিরত থাকবে এমন প্রত্যাশা করছি। কেননা, বর্তমান সরকার অত্যন্ত পরিবেশবান্ধব এবং আমরা জানি আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা নিজে পরিবেশ সচেতন। তিনি প্রতিবছরই বৃক্ষরোপণের সময় হলেই দেশের জনগণকে বৃক্ষরোপণের মাধ্যমে বনাঞ্চল সৃষ্টির মাধ্যমে সুন্দর ও সুস্থ পরিবেশ উন্নতির তাগিদ দেন। আমরা এটাও জানি একমাত্র আমাদের প্রধানমন্ত্রী বনভূমি বা বনাঞ্চল, কৃষিজমি এবং উৎপাদনশীল সমতল ভূমি নষ্ট করে কোন স্থাপনা তৈরি করার ঘোর বিরোধী। তাইতো পরিবেশ রক্ষায় অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চ্যাম্পিয়ন অব দি আর্থ বিষয়ক আন্তর্জাতিক পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ পুরস্কার সারাদেশের জন্য এবং সারাদেশের মানুষের জন্য অত্যন্ত সম্মানের এবং গৌরবের।
লেখক : প্রফেসর, হিসাব বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ হাউস বিল্ডিং ফাইন্যান্স কর্পোরেশন এবং
নির্বাহী কমিটির সদস্য, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড।
এসএ/