অসংক্রামক রোগের ঝুঁকিতে মানুষ
একুশে টেলিভিশন
প্রকাশিত : ১১:৫০ এএম, ২ সেপ্টেম্বর ২০২১ বৃহস্পতিবার | আপডেট: ০২:৫৬ পিএম, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
দুনিয়াজুড়ে অসংক্রামক ব্যাধি দিনে দিনে ভয়াবহ রূপ নিচ্ছে। ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, হৃদরোগ, মাইগ্রেন ইত্যাদি অসংক্রামক ব্যাধি এখন মারণ ঘাতক। যেসব রোগ জীবাণু দিয়ে হয় না, যে রোগগুলো একজন থেকে আরেকজনে ছড়ায় না; অর্থাৎ ছোঁয়াচে না তাদের অসংক্রামক ব্যাধি (Noncommunicable diseases, or NCDs) বলা হয়। চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় এটি একটি চিকিৎসা সংক্রান্ত শারীরিক অবস্থা বা রোগ যেটা এক প্রাণী থেকে অন্য প্রাণীতে ছড়ায় না।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা ও বাংলাদেশ স্বাস্থ্য অধিপ্তরের পরিসংখ্যান অনুযায়ি, বিশ্বের মোট মৃত্যুর ৬০ ভাগের জন্য দায়ি অসংক্রামক রোগ। সেই সূত্রে বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে প্রায় ৬২ শতাংশই অসংক্রামক রোগের কারণে। হাসপাতালে ভর্তিকৃত রোগীদের মধ্যে এক তৃতীয়াংশ অসংক্রামক। এর মধ্যে কিডনী, ক্যান্সার, যকৃতে প্রদাহ, ফুসফুস, অ্যাজমা, ডায়াবেটিস ও উচ্চ রক্তচাপের রোগীই বেশি।
কিভাবে হতে পারে অসংক্রামক ব্যাধি?
অসংক্রামক ব্যাধি আক্রান্ত মানুষের মধ্যে তাদের পূর্ব পুরুষের রোগের জোরালো পারিবারিক ইতিহাসই থাকে। এই রোগগুলোর ক্ষেত্রে পারিবারিক বা জিনগত (জেনেটিক) ইতিহাস খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার সঙ্গে যোগ হয় পরিবেশগত উপাদান (Environmental factors) যেমন- পরিবেশ দূষণ, অস্বাস্থ্যকর ও বাজে খাদ্যাভ্যাস, কায়িক শ্রমের অভাব, ধূমপান, মানসিক চাপ ইত্যাদি। এই দুয়ে মিলে বর্তমান সময়ে অনেক কম বয়সেই মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে এ ধরনের রোগে। ফলে সারা পৃথিবীজুড়ে অনেক মানুষ কম বয়সে কর্মক্ষমতা হারাচ্ছেন, বাড়ছেপারিবারিক ব্যয়।
সাধারণত চার ধরনের অসংক্রামক ব্যাধি আছে। সেগুলো হল- হৃদরোগ (cardiovascular diseases) যেমন- হৃদযন্ত্রের বৈকল্য (heart attacks) এবং উচ্চ রক্তচাপ জনিত মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ (stroke); ক্যান্সার, দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের রোগ (chronic respiratory diseases) যেমন- দীর্ঘকালস্থায়ী শ্বাসযন্ত্রের বিশেষত ফুসফুসের বাধাগ্রস্থতার রোগ এবং হাঁপানি এবং বহুমূত্র বা ডায়াবেটিস।
হৃদরোগ
দেশে মধ্যবয়সী নারীদের হৃদরোগে মৃত্যুর ঘটনা বাড়ছে। বিশ্বজুড়ে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পরিস্থিতির শিকার হচ্ছে বাংলাদেশের নারীরাও। কর্মক্ষেত্রে চাপ, সামাজিক চাপ, অর্থনৈতিক চাপ এর অন্যতম কারণ। জীবনযাত্রার পরিবর্তন ও পরিবর্তিত সময়ে তাল মিলিয়ে চলতে না পারায় এই মৃত্যুহার বাড়ছে বলছেন সংশ্লিষ্ট বিশ্লেষকেরা। সবচেয়ে আশঙ্কার বিষয়, এ বয়সী পুরুষরা হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে সাধারণত প্রথমবার রক্ষা পেলেও নারীদের ক্ষেত্রে খুব কমজনেরই সে সৌভাগ্য হয়।
মানুষের খাদ্যাভ্যাসে এসেছে পরিবর্তন। চর্বি ও জাংক ফুড গ্রহণের প্রবণতা বেড়ে গেছে। যা হৃদরোগে আক্রান্ত হওয়ার অন্যতম কারণ। এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করছে।
স্ট্রোক
স্ট্রোক একটি মস্তিষ্কের রক্তনালির জটিলতাজনিত রোগ। মস্তিষ্কের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণের ফলে অক্সিজেন সরবরাহে ব্যাঘাত ঘটলে মস্তিষ্কের কোষগুলো যখন দ্রুত ক্ষতিগ্রস্ত হয় সে অবস্থাকে স্ট্রোক বলে। স্ট্রোক মস্তিষ্কের এক ধরনের রক্তবাহী নালির দুর্ঘটনা। এই দুর্ঘটনায় রক্তনালি বন্ধও হতে পারে, আবার ফেটেও যেতে পারে। এ কারণে মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা নষ্ট হয়ে যায়।
দিনে দিনে এই স্ট্রোক রোগটির প্রবণতা বাড়ছে। বর্তমানে স্ট্রোকের ঘটনা আগের চেয়ে বেশি সংখ্যায় দেখা যাচ্ছে। আগে ষাট বা তারও বেশি বয়সে এই রোগ থেকে সাবধান হতে হত। এখন বয়স চল্লিশ পেরোলেই স্ট্রোকের আশঙ্কা তৈরি হয়। বর্তমানে বয়সের দিক থেকে আর কোনও নিম্নসীমা বা ঊর্ধ্বসীমা নেই।
ক্যান্সার
বিশ্বজুড়েই ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। প্রতি পাঁচজন পুরুষের মধ্যে একজন আর প্রতি ছয়জন নারীর মধ্যে একজন ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে- জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে ক্যান্সার আক্রান্ত মানুষের সংখ্যাও বেড়েছে। এক্ষেত্রে জীবনযাপনের মানকেই বিবেচ্য হিসেবে দেখছেন গবেষকরা।
চিন্তার বিষয় হচ্ছে- ক্যান্সার আক্রান্তে বিশ্বর মোট মৃত্যুর অর্ধেকই হচ্ছে এশিয়ার দেশগুলোতে। যেখানে তালিকায় অনেক দেশের উপরে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। সেই হিসেবে প্রতিবছর দেড় লাখ মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে।
বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সার হচ্ছে দ্বিতীয় মারণব্যাধি রোগ। বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল বিশ্বে ক্যান্সার আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। দেশের বিপুল জনগোষ্ঠী মরণব্যাধি এই রোগে আক্রান্ত। যাদের অধিকাংশই থাকছে চিকিৎসার বাইরে।
বাংলাদেশে ক্যান্সারে আক্রান্ত পুরুষের সংখ্যাই বেশি। তুলনামূলকভাবে এখানে নারীদের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা কম। তবে দিন দিন এ ব্যবধান কমে আসছে। নারীরাও এখন অনেক বেশি ক্যান্সারে আক্রান্ত হচ্ছেন। এদের মধ্যে মুখ, ফুসফুস, ব্রেস্ট ও জরায়ু মুখের মতো ক্যান্সারের প্রবণতা বেশি। বাংলাদেশে সবচেয়ে ঝুঁকিতে নারীদের স্তন ক্যান্সার। এছাড়া জরায়ু মুখ ও গল ব্লাডারের ক্যান্সারে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিও যথেষ্টই।
হাঁপানি রোগ
দেশে হাঁপানি রোগীর সংখ্যা বেড়েই চলছে। দুই দশক আগে রোগীর সংখ্যা যেখানে ছিল ৭০ লাখ, তা বেড়ে এখন কোটির ওপরে। তবে হাঁপানিতে মৃতের সংখ্যা কমেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নগরায়ণ, পরিবেশদূষণের মাত্রা বাড়ায় মানুষের মধ্যে হাঁপানি রোগটিও বাড়ছে।
দেশে এখন কোটির ওপরে হাঁপানি রোগী রয়েছে। এ ছাড়া বক্ষব্যাধি হাসপাতালের বহির্বিভাগে প্রতিদিন যে পরিমাণে রোগী চিকিৎসা নিতে আসে, তার ৩০ শতাংশ হাঁপানি রোগী।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসাবে ২০১৯ সালে হাঁপানিতে মারা গেছেন ৩৮ হাজার ২৯০ জন ও ২০২০ সালে ৩২ হাজার ৭৫ জন মারা যান।
ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ
দেশে প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিদের ১৫ শতাংশ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘদিন ধরে ঘরবন্দি থাকায় এ রোগে আক্রান্ত মানুষের হার বাড়ছে। গবেষণা ও চিকিৎসকদের নিজেদের অভিজ্ঞতায় এ প্রবণতা উঠে এসেছে।
আন্তর্জাতিক ডায়াবেটিস ফেডারেশনের (আইডিএফ) দেয়া সবশেষ তথ্য বলছে, ২০১৯ সালে বাংলাদেশে মোট জনগোষ্ঠীর ৮ দশমিক ২ শতাংশ মানুষ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত ছিল। চলতি বছরের মার্চ মাসে এই রোগীর সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে মোট জনগোষ্ঠীর ৮ দশমিক ৪ শতাংশ।
২০১৯ সালে বাংলাদেশের স্থান শীর্ষ ১০ ডায়াবেটিস সংখ্যাধিক্য দেশের মধ্যে দশম। কিন্তু আরও ভয়াবহ তথ্য হলো, ২০৩০ ও ২০৪৫ সালে বাংলাদেশ নবম অবস্থানে থাকবে।
অসংক্রামক রোগে বাড়ছে মৃত্যু/পরিসংখ্যান
স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে করোনার বছরে (২০২০) দেশে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যু সাড়ে ২২ ভাগ বেড়েছে। ব্রেইন ক্যান্সারে মৃত্যু বেড়েছে ৪৮ ভাগ, ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যু বেড়েছে প্রায় ৮৮ শতাংশ। কিডনি রোগে মৃত্যুহার দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে আত্মহত্যাও। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে এমন অস্বাভাবিক মৃত্যুর তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, দেশে ২০১৯ সালে হার্ট অ্যাটাকে মৃত্যুবরণ করেছিল ১ লাখ ৪৭ হাজার ২৫৯ জন। ২০২০ সালে এই সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ১ লাখ ৮০ হাজার ৪০৮ জন। ব্রেইন স্ট্রোকে মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৫ হাজার ৫০২ জন, ২০২০ সালে এটি বেড়ে হয়েছে ৮৫ হাজার ৩৬০ জনের। ব্লাড ক্যান্সারে মৃত্যুর সংখ্যা ১৮ হাজার ৬২০ থেকে এক বছরের ব্যবধানে বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার ৪৭১ জনে।
সাবধানতা ও প্রতিকার
ওজন বেড়ে যাওয়া, অতিরিক্ত ফাস্ট ফুড বা কোমল পানীয় গ্রহণ, ধূমপান—ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় বহুগুণ। ছেলেবেলা থেকে কায়িক শ্রম, ব্যায়াম ও খেলাধুলায় উৎসাহী করতে হবে এদের। কাঁচা শাকসবজি, ফলমূল ও আঁশযুক্ত খাবার খেতে হবে বেশি।
ইদানীং বলা হচ্ছে- স্তন ক্যানসার, অন্ত্রের ক্যানসারসহ কিছু ক্যানসারেরও পারিবারিক ইতিহাস গুরুত্বপূর্ণ। আর স্থূলতা, ওজনাধিক্য প্রতিরোধ করা গেলে, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন আনতে পারলে এ ধরনের ক্যানসারকেও প্রতিরোধ করা যায়। পরিবারে মা-বাবার ডায়াবেটিস থাকলে তাঁদের তরুণী কন্যাসন্তানের গর্ভকালীন ডায়াবেটিসেরও ঝুঁকি বেড়ে যায়। তাই এ ধরনের পরিবারের মেয়েদেরও হতে হবে সচেতন। মুটিয়ে যাওয়া এবং কায়িক শ্রমের অভাব এই ঝুঁকি বাড়াবে। তাই তাঁদের উচিত সন্তান নেওয়ার আগেই ওজন নিয়ন্ত্রণ করা, নিয়মিত ব্যায়াম করা ও খাদ্যাভ্যাস পাল্টানো। পাশাপাশি নিয়মিত নিজেদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা করানো। ৩৫ বছর বয়সের পর থেকেই বছরে অন্তত একবার রক্তে শর্করা, চর্বির পরিমাণ পরীক্ষা করা, রক্তচাপ মাপা উচিত। মাত্রা বর্ডার লাইনে হলেও চিকিৎসকের পরামর্শ নেওয়া উচিত। উচ্চতা অনুযায়ী ওজন ঠিক আছে কি না দেখুন। এ ধরনের পরিবারের সন্তানদের সামান্য উপসর্গকেও উপেক্ষা করা যাবে না। মেয়েরা গর্ভকালীন সময়ে অবশ্যই রক্তের শর্করা দেখে নেবেন। থাইরয়েডের সমস্যা পরিবারে থেকে থাকলে তা-ও দেখে নেওয়া ভালো। মা-খালাদের স্তন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে নিজের ব্যাপারে সতর্ক থাকুন। নিয়মিত নিজের স্তন পরীক্ষা করে দেখুন। প্রয়োজনে আলট্রাসনোগ্রাম বা ম্যামোগ্রাফি করান চিকিৎসকের পরামর্শে। কোলন ক্যানসারের ইতিহাস থাকলে পারিবারিক খাদ্যাভ্যাস পাল্টে ফেলুন। লাল মাংস (গরু-খাসি) কম খাবেন, বেশি খাবেন আঁশযুক্ত খাবার ও ফলমূল। এ ছাড়া কিছু জিনগত রোগ আছে, যেমন থ্যালাসেমিয়ার জিন বংশগতভাবে সন্তানেরা পেয়ে থাকে। এসব ক্ষেত্রে শিশুকাল থেকেই তার যথাযথ স্ক্রিনিং, রোগ নির্ণয় প্রয়োজন। বড় হলে প্রয়োজনে যেন ব্যবস্থা নেওয়া যায় এ জন্য সচেতন হতে হবে। এ ধরনের পরিবারে নিজেদের মধ্যে বিয়ে না হওয়াই ভালো। ‘কাজিন ম্যারেজ’ পরবর্তী প্রজন্মের সমস্যাকে আরও প্রকট করে তুলতে পারে। এমনকি বিয়েশাদির সময় জীবনসঙ্গীও এ ধরনের জিনের বাহক কি না তা জেনে নেওয়া ভালো।
প্রতিরোধে সরকারি পদক্ষেপ
২০১৮ সালে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর গৃহীত ‘অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য বহু খাতভিত্তিক কর্মপরিকল্পনা ২০১৮-২৫’-এর দুই ধাপের প্রথম ধাপ শুরু হয় ২০১৮ সালের জুলাই মাসে। এখন দেখার বিষয় হলো, এই কর্মপরিকল্পনা হাতে নেওয়ার ফলে অসংক্রামক রোগে মৃত্যুহার কতটুকু কমানো সম্ভব হয়েছে। স্বাস্থ্য বুলেটিন ২০১৮ অনুযায়ী, অসংক্রামক রোগের কারণে ৩০ থেকে ৭০ বছর বয়সী জনসংখ্যার মধ্যে প্রতি এক লাখে মারা গেছে ৩৬৯ দশমিক ৭৮ জন। এই মৃত্যুহার কমাতে পারলেই টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা-৩ অর্জন অনেকাংশে নিশ্চিত হবে।
এসএ/