করোনার চতুর্থ ঢেউ আটকাতে প্রয়োজন সংবেদনশীল আচরণ
ড. প্রণব কুমার পান্ডে
প্রকাশিত : ১২:২২ পিএম, ৩ সেপ্টেম্বর ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৪৫ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
ডেল্টা ভ্যারিয়েন্ট সৃষ্ট কোভিড-১৯ এর তৃতীয় ঢেউ যখন বাংলাদেশে তাণ্ডব চালাচ্ছিল, সেই পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য সরকার বাধ্য হয়ে গত জুন-জুলাইতে কঠোর লকডাউন বাস্তবায়ন করে। কঠোর লকডাউনের এক মাস পরে, সংক্রমণের হার কমতে শুরু করে। সরকার তৃতীয় ঢেউয়ের প্রভাবে বিপর্যস্ত মানুষের জীবন ও জীবিকার মধ্যে ভারসাম্য নিশ্চিত করতে করোনা সুরক্ষা বিধি মানার শর্তে কল-কারখানা, পরিবহন এবং অফিস পুনঃরায় খোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কঠোর লকডাউন বাস্তবায়নের কারণে সংক্রমণের হার কমে ১০ শতাংশে এসেছে। যা তিন সপ্তাহ আগেও ২৫-৩০ শতাংশ ছিল। একইসাথে, মৃত্যুর সংখ্যা ২০০-এর উপর থেকে ১০০-এর নিচে নেমে এসেছে। ফলে বলা যায়, এক মাস আগের তুলনায় দেশে করোনা পরিস্থিতির ব্যাপক উন্নতি হয়েছে। তবে একটি মৃত্যুও কাম্য নয়, বিধায় মৃত্যুর সংখ্যাকে শূন্যে নিয়ে আসতে হবে যেকোনো মূল্যে।
বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীর দল এবং বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনার আবির্ভাবের শুরু থেকেই করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলার ওপর গুরুত্বারোপ করে আসছে। সুরক্ষাবিধি মেনে জনগণকে বাড়িতে রেখে এবং লকডাউন কার্যকর করলে সংক্রমণের হার কমছে। এটি যেমন একটি সত্য, তেমনি কোভিড-১৯ মোকাবেলায় বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে দীর্ঘমেয়াদী লকডাউন বাস্তবায়ন কতটা যুক্তিসঙ্গত সেটিও আমাদের চিন্তা করতে হবে?
আমরা সকলে জানি যে, বাংলাদেশের জনসংখ্যার বড় একটি অংশ দিন আনে দিন খায়। লকডাউন এই শ্রেণির মানুষের জন্য একটি বোঝা। কারণ তারা একদিন কাজ না করলে পরের দিন কীভাবে তাদের জীবিকা নির্বাহ করবে তা নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকে। এই পরিস্থিতিতে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ বা মাসের পর মাস লকডাউন বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান বাস্তবসম্মত নয়।
২০২০ সালের মার্চ থেকে তৃতীয় ঢেউ আঘাত হানার আগ পর্যন্ত মহামারীর প্রথম এবং দ্বিতীয় তরঙ্গ মোকাবেলায় সরকারকে বারবার লকডাউন বাস্তবায়ন করতে হয়েছিল। খেটে খাওয়া মানুষের সেই সময়ে জীবন যাপনের ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা রয়েছে। তবে, সরকার বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদানের মাধম্যে দরিদ্রদের কষ্ট দূর করার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে। সরকারের পাশাপাশি, বেশ কয়েকটি সামাজিক সংগঠন, কর্পোরেট হাউজ এবং ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান এই সুবিধাবঞ্চিত মানুষকে মহামারীর শুরু থেকেই তাদের নিজ নিজ অবস্থান থেকে সহায়তা প্রদান করেছে।
অন্যদিকে, সরকার বিশাল অংকের অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার প্যাকেজ বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতিকে সচল রাখার চেষ্টা করেছে। সকলের অক্লান্ত প্রচেষ্টায়, আমরা হয়তো মহামারীর প্রথম এবং দ্বিতীয় তরঙ্গ কাটিয়ে উঠতে সফল হয়েছি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর যোগ্য নেতৃত্বে, যিনি পুরো প্রক্রিয়াতে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন, আমরা খুব অল্প সময়ের মধ্যে স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পেরেছিলাম।
করোনার তৃতীয় তরঙ্গের সময় দরিদ্রদের দুর্দশা আগের দুই তরঙ্গের মতো রয়েছে। এবারও, সরকার হত দরিদ্র, চাকুরি হারানো এবং দেশে ফিরে আসা প্রবাসী শ্রমিকসহ বিভিন্ন গোষ্ঠীকে আর্থিক সহায়তা প্রদান করেছে। তাছাড়া ওপেন মার্কেট সেলস (ওএমএস)-এর মাধ্যমে সুলভ মূল্যে নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য বিক্রি চালিয়ে যাচ্ছে।
লকডাউনের সময় জীবন ও জীবিকার ভারসাম্য রক্ষার জন্য পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ধীরে ধীরে কল-কারখানা, পোশাক শিল্প কারখানা ও অফিস খুলে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু গণপরিবহনের কর্মচারী, রিকশাচালক এবং দিনমজুরদের জন্য এটি একটি কঠিন সময় ছিল। বিগত দেড় বছরে সরকার বিভিন্ন গোষ্ঠীকে বিভিন্ন ধরনের সহায়তা প্রদান করলেও সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে তারা নিম্ন আয়ের পরিবারের সব চাহিদা পূরণ করতে পারেনি। শতাব্দীর সবচেয়ে খারাপ সময়ে শ্রমজীবী পরিবারগুলোকে সহায়তা প্রদানের জন্য সরকারের পাশাপাশি ব্যক্তি পর্যায় এবং বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
এ কথা ঠিক যে, করোনাকালে বিশেষত, লকডাউনের সময় ধনী-গরিব নির্বিশেষে সকলেই এক ধরনের ট্রমার মধ্যে দিয়ে দিন অতিবাহিত করছে। তবে আমাদের সকলকে একটা বিষয় উপলব্ধি করতে হবে যে, মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকার বাধ্য হয়ে লকডাউন বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত নিচ্ছে। এটি শুধু বাংলাদেশেই নয়, পৃথিবীর প্রায় সকল দেশের সরকার করোনা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য লকডাউন বাস্তবায়ন করতে বাধ্য হচ্ছে। করোনা এমন এক ধরনের ভাইরাস, যা উন্নত বিশ্বও মোকাবেলা করতে হিমশিম খাচ্ছে। অতএব, আমরা যে যন্ত্রণা সহ্য করছি তা আমাদের অবশ্যই মেনে নিতে হবে সকলের মঙ্গলের জন্য।
করোনার তৃতীয় তরঙ্গে সংক্রমণের হার হ্রাসের প্রবণতা দেখা দেবার পর থেকেই সাধারণ মানুষের মধ্যে বেপরোয়া ভাব লক্ষ্য করা যাচ্ছে। অনেক মানুষ কোভিড-১৯ সুরক্ষা বিধি অনুসরণ না করেই বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন এবং অবাধে চলাফেরা শুরু করেছে। কক্সবাজারে হাজার হাজার দর্শনার্থী সমুদ্র ভ্রমণে রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেওয়া শুরু করেছে, যেখানে সুরক্ষাবিধি মেনে চলা সম্ভব নয়।
আমরা সবাই জানি যে, দেশে জনসংখ্যার একটি বড় অংশের বেপরোয়া আচরণের কারণে দেশে করোনার তৃতীয় ঢেউ ভয়ঙ্কর রূপে আবির্ভূত হয়েছিল। ফলে, জনগণ যদি তাদের বেপরোয়া চলাচল অব্যাহত রাখে তবে কয়েক সপ্তাহের মধ্যে দেশে প্রাণঘাতী ভাইরাসের চতুর্থ ঢেউ আঘাত হানার আশঙ্কা রয়েছে। এই আশঙ্কায় দেশের বেশিরভাগ মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
আমরা ইতোমধ্যেই জেনেছি, পরিবহন শ্রমিক এবং যাত্রীদের দুর্দশার কথা চিন্তা করে সরকার সুরক্ষাবিধি মানার শর্তে গণপরিবহন চলাচল উন্মুক্ত করে দিয়েছে। আমরা যদি কোভিড-১৯ সুরক্ষাবিধি মেনে গণপরিবহন ব্যবহার না করি, তাহলে আমাদের আবার সাম্প্রতিক মাসের ভয়াবহতার মুখোমুখি হতে হবে।
সরকার যে সিদ্ধান্তই গ্রহণ করুক না কেন, সেই সিদ্ধান্ত সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি গণপরিবহনসহ সবকিছু স্বাভাবিক রাখতে চায়, তাহলে সব পক্ষকেই সুরক্ষাবিধি মেনে চলার নিশ্চয়তা দিতে হবে। অন্যথায়, আমাদের চতুর্থ তরঙ্গের জন্য খুব বেশি সময় অপেক্ষা করতে হবে না।
আমরা কয়েক মাস আগে দেখেছি, কিভাবে করোনা রোগীরা চিকিৎসার জন্য হাহাকার করছে। দেশের অনেক অঞ্চলের হাসপাতালে নিয়মিত শয্যাসহ আইসিইউর সঙ্কট ছিল। অনেক মুমূর্ষু রোগীর পরিবারকে আইসিইউর জন্য এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে ছুটতে হয়েছিল। সংক্রমণের হার হ্রাস পাবার কারণে যদি আমরা সাম্প্রতিক অতীতের স্মৃতি ভুলে যাই, তবে আমাদের আবারও এটি মোকাবেলা করতে হবে।
বাঙালি জাতির ইতিহাস ভুলে যাওয়ার জন্য এক ধরনের প্রবণতা রয়েছে। সেই দিন বেশি দূরে নয়, যখন করোনার চতুর্থ ঢেউ মোকাবেলায় আমাদের এক হাসপাতাল থেকে অন্য হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হতে পারে। যদি আমরা সুরক্ষা বিধি লঙ্ঘন করি এবং আমাদের বিলাসিতার জন্য ভ্রমণ করি, তাহলে সরকারকে আবারো কঠোর লকডাউন প্রয়োগ করতে হতে পারে।
শতাব্দীর সবচেয়ে বড় দুর্যোগের সময় যদি সরকার এবং জনগণ একে অপরকে সহযোগিতা না করে, তাহলে করোনা-মহামারীর ট্রমা দীর্ঘস্থায়ী হবে বলেই মনে হচ্ছে। এখন পর্যন্ত, আমরা জানি না কতক্ষণ করোনা ভাইরাস আমাদের পৃথিবীকে কষ্ট দিতে থাকবে? এখন পর্যন্ত আবিষ্কৃত কোনো টিকাই করোনা ভাইরাস সংক্রমণের বিরুদ্ধে দীর্ঘস্থায়ী সুরক্ষা দিতে পারে সক্ষম নয়। ফলে, আমাদের অবশ্যই এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সঙ্গে লড়াই করেই এগিয়ে যেতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এবং সরকার কর্তৃক নির্ধারিত করোনা সুরক্ষাবিধি মেনে আমাদের চলতে হবে (যেমন- বাইরে যাওয়ার সময় মাস্ক পরা, ঘন ঘন হাত ধোয়া, সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা এবং ভিড় এড়িয়ে চলা)। দেশবাসীর জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণ ভ্যাকসিন সংগ্রহে সফল হবার জন্য মাননীয় প্রধানমন্ত্রী প্রশংসার দাবীদার।
তবে, জনগণের বেশিরভাগ অংশকে টিকা না দেওয়া পর্যন্ত আমাদের অবশ্যই কোভিড-১৯ সুরক্ষা বিধি কঠোরভাবে মেনে চলতে হবে। আমরা যদি অসংবেদনশীল আচরণ করতে শুরু করি, তাহলে চতুর্থ তরঙ্গের সংক্রমণের হার নিয়ন্ত্রণের জন্য সরকারকে আবারও লকডাউন আরোপ করতে হবে এবং আমাদের অবশ্যই আবার একটি ভয়াবহ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হবে। আসুন, আমরা সকলে মিলে করোনা সুরক্ষা বিধি মেনে চলি এবং করোনার চতুর্থ ঢেউকে আটকে দিয়ে বাংলাদেশকে রক্ষা করি।
লেখক- অধ্যাপক, লোক প্রশাসন বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
এনএস//