মনুষ্যরুপী শকুন কখনো তৃপ্ত হয় না!
মানিক মুনতাসির
প্রকাশিত : ০৯:০৯ এএম, ৪ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার | আপডেট: ০৯:৪৩ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
দিন তারিখ মনে নাই। তবে ঘটনাটা ৯০-এর দশকের। স্কুলে পড়ি। আমাদের বাড়ির অদূরে রাস্তার পাশে একটা বড় শিমুল গাছ ছিল। পাশের বাজারে দুটি বৃহৎ বট গাছও ছিল। ঐ গাছে জ্বিন থাকত- এমন রটনার ভয়ে সন্ধ্যার পর সে রাস্তা ব্যবহার করতে ভয় হতো। ঐ গাছে শকুনও থাকত। ঝাঁকে ঝাঁকে শকুন।
একদিন গ্রামে কারো একটা গরু মারা গেল। মরা গরুটা ফেলা হলো শিমুল গাছের পাশে কোনো উচু জায়গায়। শকুনগুলো দু'একদিনের ব্যবধানে গরুটা খেয়ে ফেলল। আমাদের গ্রামে তখন খুরা রোগে অনেক গরুই মারা যেত। মহিষও মারা যেত। শকুনদের তাই খাবারের অভাব হতো না। তবুও শকুনরা তৃপ্ত হতো না কখনোই। দেখতাম জীবিত গরু মাঠে ঘাস খেতে খেতে কখনো কখনো বিশ্রাম নিতে শুয়ে পড়ত। ঘাড় মাথাও মাটিতে লেপটে দিত। সেই জীবিত গরুর ওপর শকুনরা দল বেঁধে ঝাঁপিয়ে পড়ত। অবশ্য গরু জেগে উঠলে শকুনরা পালিয়ে যেতো।
আজ ৪ সেপ্টেম্বর, আন্তর্জাতিক শকুন সচেতনতা দিবস। প্রতি বছরের সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম শনিবার এ দিবসটি পালিত হয়। গত বছর দিবসটি ছিল ৫ সেপ্টেম্বর।
এখন তো শকুন এ দেশ থেকে প্রায় বিলুপ্ত। তবে ঘরে ঘরে, আপনার আশপাশে সবখানে মানুষরুপী শকুনের অভাব নেই। এরা ওঁত পেতে থাকে কখন আপনি বিশ্রামে, ছুটিতে কিংবা চোখের আড়ালে যাবেন। ব্যস তখন এরা আপনার স্থান দখলের জন্য মরিয়া হয়ে উঠবে। পারুক বা না পারুক। তেলবাজি, চাপাবাজি, ধাপ্পাবাজিসহ যত রকম বাজি আছে সবই খেলবে। তাও অন্যের আসন দখলের চেষ্টা করবে। এখানে অবশ্য অগ্রজদেরও প্রশ্রয় থাকে অনেক ক্ষেত্রে।
যাইহোক, আশপাশে তাকিয়ে দেখুন, শকুন কোথায় আছে? চিনতে পারলে এড়িয়ে চলুন। ফাঁদ এরা পাতবেই। পা দেয়া যাবে না। এদের গিফট, সহযোগিতা, সহায়তা, পাওনা কোনো কিছু দিয়ে তৃপ্তও করতে পারবেনা না। ফলে এদের এড়িয়ে চলুন। তারচেয়েও বড় কথা, শকুনের কখনো পেট ভরে না। শকুন সাধারণত লোকচক্ষুর অন্তরালে বাসা বাঁধে। মানুষরুপী শকুনরাও একই স্বভাবের হয়ে থাকে।
শকুনই একমাত্র প্রাণী, যা রোগাক্রান্ত মৃত প্রাণী খেয়ে হজম করতে পারে এবং অ্যানথ্রাক্স, যক্ষ্মা, খুরারোগের সংক্রমণ থেকে অবশিষ্ট জীবকুলকে রক্ষা করে। প্রসঙ্গত, অ্যানথ্রাক্স আক্রান্ত মৃতদেহ মাটিতে পুঁতে রাখলেও তা একশ বছর সংক্রমণক্ষম থাকে। তাই শকুন আমাদের বন্ধুও বটে।
প্রাণীকুলে শকুনের যে আধিপত্য, সেটি বেশ আগেই ভেঙে গেছে। এখন এটি শুধু বিলুপ্তির ঝুঁকিতে থাকা প্রাণী নয়, একেবারে নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথেই বলা যায়। মাত্র তিন দশক আগেও কমপক্ষে ১০ লাখ শকুনের বিচরণক্ষেত্র ছিল বাংলাদেশের আকাশ-জমিন। কিন্তু সেই সংখ্যা এখন নেমে এসেছে ২৬০-এ। ১৯৯০ থেকে ২০১২ সালের মধ্যেই প্রায় ৯৯ শতাংশ শকুন হারিয়ে গেছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। দেশে থাকা অল্পসংখ্যক শকুন রক্ষায় নানা পদক্ষেপ নিয়েছে সরকার। তবে মানুষরুপী শকুনের সংখ্যা বাড়ছে চক্রবৃদ্ধি হারে। সমাজে, ব্যাংকে, চাকরিক্ষেত্রে, বাড়িতে সর্বত্র মানুষরুপী শকুনের অবাধ বিচরণ।
উইকিপিডিয়ার তথ্যমতে, শকুন এই পৃথিবীতে আছে অনেক আগে থেকে, প্রায় ২৬ লক্ষ বছর ধরে। শকুনের সাধারণ একটা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে- এদের মাথায় পালক নেই, চঞ্চু খুব ধারালো। এরা ময়লার ভাগাড় থেকে খাবার খুঁজে খায়। অনেক উপর থেকে এরা মৃত পশুর দেহ দেখতে পায়, তারপর সেখানে নেমে আসে, তারপর সেই মৃত পশুর দেহ দ্রুত সাবাড় করে। তাদের পাকস্থলীর ধারণ ক্ষমতা অসাধারণ। মৃত পশুর দেহ তো বটেই, তাদের হাড় পর্যন্ত হজম করে ফেলতে পারে শকুন।
বিবিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৭০ এবং ১৯৮০র দশকে শকুনের সংখ্যা এতো বেশি ছিল যে, ভারত বা পাকিস্তানের মতো দেশে শকুনকে একটা উপদ্রব বলে গণ্য করা হতো। এগুলোকে যে সংরক্ষণ করা দরকার, সেটার কথা কারও মাথাতেই ছিল না। দেশ দুটি মনে করত, সেই সময়ে এরা বড় ধরণের উপদ্রব হয়ে দেখা দিয়েছিল। সেসময় সারা পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি দেখা যেত ওরিয়েন্টাল হোয়াইট রাম্পড ভালচার বা প্রাচ্যদেশীয় সাদা পাকা শকুন। ধারণা করা হয়, ৭০-এর দশকের শুরুর দিকে ভারতের জয়পুর-আগ্রা এবং দিল্লির মধ্যবর্তী অঞ্চলেই কেবল ৪ কোটি এ রকম শকুন ছিল। এখন তা প্রায় বিলুপ্ত।
তবে সেইসব মানুষের ধারণা আজ সত্যিই হয়েছে। মনুষ্যরুপী শকুন তো সমাজের মাঝে উপদ্রব হয়েই দেখা দিয়েছে। এই উপদ্রব থেকে বাঁচতে হলে মানুষরুপী শকুনের বিরুদ্ধে গড়ে তুলতে হবে সামাজিক আন্দোলন। আসুন সেটাই করি। নিপাত যাক মনুষ্যরুপী শকুন। বংশবৃদ্ধি হোক পরিবেশ বন্ধু শকুনের।
এনএস//