বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপথ বদলে দিয়েছেন শেখ হাসিনা
তাপস হালদার
প্রকাশিত : ১২:১৩ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ রবিবার | আপডেট: ০৯:৪১ পিএম, ৬ সেপ্টেম্বর ২০২১ সোমবার
বিশ্ব ব্যাংক যখন মিথ্যা অভিযোগে পদ্মা সেতুতে ঋণ চুক্তি বাতিল করেছিল, তখন বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা অত্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলেছিলেন, ‘আমরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ করব’। তখন অধিকাংশ মানুষই মনে করেছিল প্রধানমন্ত্রী হয়তো কথার কথা বলেছেন। অর্থনীতির পণ্ডিতগণেরাও বলেছিলেন, নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মাসেতু তৈরি করা অসম্ভব। সেই অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন শেখ হাসিনা।
কেবল পদ্মা সেতুই নয়, দেশি-বিদেশি অর্থায়নে তৈরি হচ্ছে মেট্রোরেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর ও মাতারবাড়ি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রসহ অসংখ্য মেগা প্রকল্প।
শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ৬ জানুয়ারি ২০০৯ সালে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। সেই থেকে টানা তিন মেয়াদে দেশ পরিচালনা করে একযুগ পূর্তি করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০০৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে দিনবদলের সনদ রূপকল্প-২০২১ এর মূল লক্ষ্য ছিল বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা। মাথাপিছু আয়, মানবসম্পদ এবং অর্থনৈতিক ও পরিবেশগত ভঙ্গুরতা- এই তিনটি সূচকের ভিত্তিতে জাতিসংঘ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উত্তরণের বিষয়টি পর্যালোচনা করে। সরকার তিনটি মানদণ্ডই নির্দিষ্ট সময়ের আগেই খুব ভালোভাবে পূরণ করে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে স্বল্পোন্নত দেশ হতে উন্নয়নশীল দেশ হওয়ার চূড়ান্ত সুপারিশ লাভ করে।
বিগত একযুগে বাংলাদেশের প্রতিটি ক্ষেত্রে অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধিত হয়েছে। আমি এ নিবন্ধে শুধু অর্থনৈতিক উন্নয়ন তথা জিডিপি প্রবৃদ্ধি, জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন, আন্তর্জাতিক বিশ্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সাফল্যের মূল্যায়ন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
একসময়ের খাদ্য ঘাটতির দেশ সরকারের উদার কৃষিনীতির কারণে খাদ্য সংকট মোকাবেলা করে খাদ্য রপ্তানির সক্ষমতাও অর্জন করেছে। কৃষির আধুনিকায়ন, নতুন নতুন বীজ উদ্ভাবন, পর্যাপ্ত সার ন্যায্যমূল্যে সরবরাহ এবং সর্বোপরি প্রতিবছর কৃষিতে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি দেয়ার ফলে খাদ্য শস্য উৎপাদন, শাকসবজি-ফলমূল, মাছ ও গবাদিপশু উৎপাদনে দেশ স্বয়ংসম্পূর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশের মোট দেশজ উৎপাদনে (জিডিপি) কৃষির অবদান ১৬.৬ %। 'জাতীয় কৃষিনীতি' ও 'ডেল্টাপ্লান: ২১০০' তৈরি করা হয়েছে। সরকার কৃষকদের জন্য সর্বমোট ৪৯৯টি 'কৃষি তথ্য ও যোগাযোগ কেন্দ্র' (এআইসিসি) স্থাপন করেছে। বাংলাদেশের কৃষিকে যান্ত্রিকীকরণ করার উদ্দেশ্যে হাওর ও দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় এলাকার কৃষকদের জন্য ৭০ শতাংশ এবং অন্যান্য এলাকার জন্য ৫০ শতাংশ হারে কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে ভর্তুকি প্রদান করে সরকার। কৃষি উৎপাদনে যার সুফল পাচ্ছে জনগণ। তারই কারণে বাংলাদেশ সবজি উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, ধানে চতুর্থ, মাছে চতুর্থ, আলুতে সপ্তম, আমে সপ্তম, পেয়ারায় অষ্টম এবং খাদ্যশস্য উৎপাদনে দশম স্থান অধিকার করতে সক্ষম হয়েছে।
শিল্পোন্নয়নের বিকাশের ক্ষেত্রে প্রথম দরকার ছিল বিদ্যুৎ ও গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করা। ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর বিদ্যুৎ উৎপাদনের দিকে সবিশেষ গুরুত্ব দেয় সরকার। ২০০৫-০৬ সালে যেখানে দৈনিক বিদ্যুৎ উৎপাদনের পরিমাণ ছিল সাড়ে চার হাজার মেগাওয়াট, সেখানে ২০২১ সালে দৈনিক উৎপাদন সক্ষমতা দাঁড়িয়েছে প্রায় ২৫ হাজার মেগাওয়াট। বিদ্যুৎ সুবিধাপ্রাপ্ত লোকসংখ্যা ২০০৫-০৬ সালের ৪৭ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে বর্তমানে ৯৯ শতাংশেরও বেশি, যা এবছরই শতভাগে পৌঁছাবে। বিদ্যুৎ সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য রামপাল, পায়রা, বাঁশখালী, মহেশখালী ও মাতারবাড়ী ও রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র মিলে প্রায় ৩২ হাজার মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের কাজ চলছে।
বর্তমান সরকার শহর ও গ্রামের দূরত্ব কমিয়ে আনতে ব্যাপক অবকাঠামোগত উন্নয়ন করেছে। গ্রামীণ এলাকায় অসংখ্য রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, ঢাকা-ময়মনসিংহ, ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গাসহ ৪৫৩ কিলোমিটার জাতীয় মহাসড়ক চার বা তদূর্ধ্ব লেনে উন্নীত করা হয়েছে। ঢাকা-সিলেটসহ আরও ৬৬১ কিলোমিটার মহাসড়ক ছয় লেনে উন্নীত করার কাজ চলছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি হলো তৈরি পোশাক শিল্প। এই শিল্প দেশীয় উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। মোট প্রবৃদ্ধির ৬-৮% আসে পোশাক খাত থেকে। বারবার দেশি ও বিদেশি ষড়যন্ত্রকে মোকাবেলা করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম গার্মেন্টস পণ্য রপ্তানিকারক দেশ। বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় রপ্তানি খাত হচ্ছে এই পোশাকশিল্প। এ খাত থেকেই আসছে মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ।
রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর আন্তর্জাতিক বাজার নষ্ট করার জন্য ব্যাপক অপপ্রচার করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল বাংলাদেশের গার্মেন্টেস শ্রমিকদের কর্মপরিবেশ নেই। অবাক করার বিষয়, সকল অপপ্রচার মোকাবেলা করে বিস্ময়করভাবে ঘুরে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ। পৃথিবীর দশটি সেরা গার্মেন্টেসের সাতটি এখন বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভের প্রধান উৎস বৈদেশিক আয় বা রেমিট্যান্স। ২০১৯ সালের হিসাব অনুযায়ী, বিশ্বব্যাপী বেশি রেমিট্যান্স আসা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান অষ্টম। সরকার নতুন নতুন শ্রম বাজার তৈরি, দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা, বিদেশে থাকা শ্রমিকদের কর্ম পরিবেশ তৈরি করা, অনলাইনে পাসপোর্ট রিনিউ সুবিধাসহ প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয় ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের যৌথ প্রচেষ্টায় বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। যার সুফল পাচ্ছেন প্রবাসীরা। সেইসঙ্গে বৈধ পথে দেশে অর্থ প্রেরণে দুই শতাংশ প্রণোদনা এবং প্রবাসীদের অর্থ বিনিয়োগের বিভিন্ন সুযোগ তৈরি করার কারণে রেমিট্যান্স হার দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। যার কারণে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বিশ্বের শ্রম বাজারে নতুন সম্ভাবনা তৈরি করেছে বাংলাদেশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিকভাবে বিস্ময়কর উত্থান ও অগ্রযাত্রা এখন সারা বিশ্বে স্বীকৃত। বাংলাদেশকে এখন বিশ্বের অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোও সম্মানের চোখে দেখে। প্রভাবশালী ম্যাগাজিন ইকোনমিস্টের ২০২০ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৬৬টি উদীয়মান সবল অর্থনীতির দেশের তালিকায় বাংলাদেশের স্থান নবম। ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০৩০ সাল নাগাদ বাংলাদেশ হবে বিশ্বের ২৪তম বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ।
ওয়ার্ল্ড ইকোনিক লিগ টেবল ২০২১, আগামী ১৫ বছরে বিশ্বের কোন দেশের অর্থনীতি কি হবে সে বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করে বলেছে, ২০৩৫ সালে বিশ্বের ১৯৩টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান হবে ২৫তম, যা এখন ৪১তম। চীন থাকবে প্রথম, দ্বিতীয় হবে ভারত।
সম্প্রতি যুক্তরাজ্যভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড বিজনেস রিসার্চের (সিইবিআর) এক জরিপে বলা হয়েছে, ২০৩৩ সালের মধ্যে বাংলাদেশ বিশ্বের ২৫তম অর্থনীতিতে পরিণত হবে। বাংলাদেশের অর্থনীতির বর্তমান আকার ৩০২ বিলিয়ন ডলার, যা ২০৩৩ সালে হবে ৮৫৫ বিলিয়ন।
সফল রাষ্ট্রনায়ক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের ২০০৯-২০১৯ পর্যন্ত এক দশকে বাংলাদেশের জিডিপিতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে শতকরা ১৮৮ ভাগ। যা বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ চীন ও ভারতের চেয়েও বেশি। চীনের প্রবৃদ্ধি হয়েছে ১৭৭ ভাগ ও ভারতের ১১৭ ভাগ। এছাড়া ইন্দোনেশিয়া ৯০, মালয়েশিয়া ৭৮, অস্ট্রেলিয়া ৪১, মেক্সিকো ৩৭, ইতালি ৮, জার্মানি ১৫, মিশর ৫১ এবং ব্রাজিল ১৭ ভাগ প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পেরেছে।
এভাবে চলতে থাকলে ২০৩৩ সালের মধ্যে মালয়েশিয়া, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, সিঙ্গাপুর, ভিয়েতনাম ও দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশকেও টপকে যাবে বাংলাদেশ। গত ১৫ বছরে বাংলাদেশ ১২টি দেশকে টপকে গেছে। আগামী ১৫ বছরে টপকে যাবে আরও ১৭টি দেশকে।
বিশ্বের বহু দেশ যখন করোনা মোকাবেলায় হিমশিম খাচ্ছে, বাংলাদেশ সেখানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অত্যন্ত দক্ষতার সাথে করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে সক্ষম হয়েছে। করোনা ভাইরাস মোকাবেলার সক্ষমতায় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় প্রথম এবং বিশ্বে ২০তম। বিশ্বের বহু উন্নত দেশকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশের মানুষের জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহ করছে সরকার। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা শুরু থেকেই বলেছেন, যেখানে ভ্যাকসিন পাওয়া যাবে সেখান থেকেই আনা হবে। টাকার কোনো সমস্যা হবে না। আজ কোটি কোটি ভ্যাকসিন বাংলাদেশে আসছে। করোনা মোকাবেলা, প্রণোদনা ঘোষণা ও বাংলাদেশের মত বৃহৎ জনগোষ্ঠীর জন্য ভ্যাকসিন সরবরাহ এদেশের অর্থনীতির মজবুত সক্ষমতারই পরিচয় বহন করে।
দেশরত্ন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের অর্থনীতি। তিনিই বদলে দিয়েছেন বাংলাদেশের অর্থনীতির গতিপথ। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এখন বিশ্বের অনেক দেশের জন্যই উদাহরণ। অর্থনীতি ও আর্থ-সামাজিক বেশিরভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়ার প্রায় সবগুলো দেশকে।
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত আত্মমর্যদাশীল সোনার বাংলাদেশ গড়তে চেয়েছিলেন, আজ তারই সুযোগ্য কন্যা দেশরত্ন শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে সে পথেই দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।
লেখক: সদস্য, সম্প্রীতি বাংলাদেশ ও সাবেক ছাত্রনেতা।
এনএস//