আফগানিস্তানে তালেবানের ক্ষমতা দখল এবং প্রেক্ষাপট বাংলাদেশ
অধ্যাপক ডাঃ মামুন আল মাহতাব স্বপ্নীল
প্রকাশিত : ০৬:২৮ পিএম, ৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ রবিবার | আপডেট: ০২:৫১ পিএম, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
আফগানিস্তানে তালেবানদের সাম্প্রতিক উত্থানের পরিপ্রেক্ষিতে সঙ্গত কারনেই বাংলাদেশ তথা এই অঞ্চলে এর কি প্রভাব পড়তে যাচ্ছে তা নিয়ে নানা রকম হিসেব কষাকষি চলছে। আফগানিস্তানে তালেবানি শাসন যে উপমহাদেশের জন্য অত্যন্ত বিপজ্জনক তা নিয়ে অবশ্য কারো কোন দ্বিমত নেই। এতে নিঃসন্দেহে ভারত ও বাংলাদেশের মৌলবাদী শক্তিগুলো নতুন করে উৎসাহিত হয়েছে। এই দুই দেশের সরকারই এখন পর্যন্ত তালেবানদের স্বীকৃতি না দিলেও দু’দেশেরই কিছু মানুষ এই সুযোগে ইসলামের নামে ফের তাদের কায়েমি স্বার্থ চরিতার্থে ব্যস্ত হয়ে উঠেছে।
জাতীয় শোক দিবসের আগের দিন এক প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের কমিশনার শফিকুল ইসলাম বলেছেন, যে তালেবানের ডাকে সাড়া দিয়ে বাংলাদেশের কিছু মানুষ আফগানিস্তানে পাড়ি জমিয়েছেন। অতীতেও তালেবানদের হয়ে যুদ্ধ করা বাংলাদেশিরা দেশে ফিরে এসে গড়ে তুলেছিল হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামি। বোমা হামলাসহ উগ্রবাদী কর্মকান্ডের অভিযোগে সরকার ২০০৫ সালে বাংলাদেশ সরকার এই সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করলেও, পরবর্তীতে তাদের প্রভাবেই এদেশে গড়ে ওঠে আনসার আল ইসলামসহ আরও কয়েকটি জঙ্গি সংগঠন। এখনও আমরা ভুলিনি আজ থেকে প্রায় আড়াই দশক আগে আফগানিস্তানে তালেবানরা প্রথমবার ক্ষমতা দখল করার পর ঢাকার রাজপথে সেই শ্লোগান, ‘আমরা সবাই তালেবান, বাংলা হবে আফগানিস্তান’।
শুধু বাংলাদেশই নয়, প্রতিবেশি ভারতেরও তালেবানের উত্থানে মৌলবাদীরা বেশ উৎসাহিত। সে দেশের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তাদের সেই উচ্ছাস প্রকাশও পাচ্ছে। সে দেশের একজন প্রবীণ সাংসদ, সমাজবাদী পার্টির নেতা সাফিকুর রহমান বার্ক প্রকাশ্যে আফগানিস্তানে তালেবান শাসনকে সমর্থন জানিয়েছেন। অল ইন্ডিয়া মুসলিম পার্সোনাল ল বোর্ডের সচিব মৌলানা ওমরেইন মেহফুজ রহমানী এবং মুখপাত্র মৌলানা সাজ্জাদ নোমানিও তালেবানের আফগানিস্তানে ক্ষমতা দখলকে সমর্থন জানিয়েছেন। একইভাবে বাংলাদেশেও স্বাধীনতা বিরোধী শক্তি তালেবানদের সমর্থনে গলা ফাটাচ্ছে। আর এতে মদদ দিচ্ছে বিএনপি ঘরানার বুদ্ধিজীবিরা। বাংলাদেশে, তাদের ভাষায়, সুষ্ঠ নির্বাচন হলে হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও কাবুলের হামিদ কারজাই আন্তর্জাতিক বিমানমন্দরের মত দৃশ্যপটের অবতারনা হবে বলে মন্তব্য করেছেন তেমনই একজন। আরেকজন সরকারকে নসিহত করেছেন আফগান শরনার্থীদের জন্য বাংলাদেশের দরজা খুলে দিতে।
বিএনপির এ ধরনের রাজনৈতিক অবস্থান অবশ্য নতুন কিছু নয়। সম্প্রতি বিএনপি সমর্থক একজন সম্পাদক প্রকাশ্যেই স্বীকার করেছেন যে ২০০৪ সালে আসামের বিচ্ছিন্নতাবাদী উলফার জন্য যে ১০ ট্রাক অস্ত্র চট্টগ্রাম বন্দরে খালাস করা হয়েছিল, সেটা সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র খালেদা জিয়ার সরকারের কারণেই। মনে রাখতে হবে, গতবার আফগানিস্তানে তালেবানের সাফল্যে উজ্জীবিত হয়েই বাংলাদেশে জেএমবি’র উত্থান হয়েছিল। যারা এসব বিষয়ে খবরা-খবর রাখেন, তারা এবারও তেমন কিছুর শংকা করছেন। নব্য-জেএমবির সক্রিয়তা গোয়েন্দাবাহিনীর নজরে রয়েছে।
পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের একজন উর্দ্ধতন কর্মকর্তা বলেছেন, ‘দেশে যে তালেবান অনুসারী নেই, এটা বলা যাবে না। তালেবানের ক্ষমতা দখলে তারা যে উজ্জীবিত হবে, এটাও ঠিক। কিন্তু তাদের মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে দেওয়া হবে না। পুরো পরিস্থিতি পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে’। অন্যদিকে বাংলাদেশর একটি গুরুত্বপূর্ন থিংক ট্যাংকের শীর্ষ এক কর্মকর্তাও সম্প্রতি বলেছেন, ‘বাংলাদেশে উগ্রবাদের জন্মের সঙ্গে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে আফগান যুদ্ধের সরাসরি সম্পর্ক ছিল। বাংলাদেশের উগ্র মতাদর্শে বিশ্বাসী বেশ কিছু যুবক আফগানিস্তানে যাওয়ার চেষ্টা করছে’। এটি প্রতিরোধের জন্য তিনি কঠোর ও নিবিড় নজরদারি এবং পাশাপাশি সাইবার যোগাযোগ আর আফগানিস্তানে যাওয়ার রুটগুলোয় নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
হিলারি ক্লিনটনের একটি উক্তি এক্ষেত্রে বিশেষ প্রনিধানযোগ্য। তিনি বলেছিলেন, পাকিস্তানের আইএসআই ও সৌদি ওহাবি ধারার সংমিশ্রনে তালেবান প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলে এই শক্তি থেকে বাংলাদেশের সতর্ক থাকাটা জরুরি। আশার কথা বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, এ বিষয়ে বাংলাদেশ যথেষ্টই সতর্ক। গণতান্ত্রিক ও বহুত্ববাদী আদর্শের প্রতি বাংলাদেশের আস্থার কথাও দ্ব্যর্থহীনভাবে জানিয়েছে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সরকার এবং সিভিল সোসাইটি আর পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সর্তকতা আর সমন্বিত উদ্যোগ বাংলাদেশকে প্রতিবেশির আঙ্গিনায় উগ্রবাদের আগুনের আচ থেকে রক্ষা করবে এমনটা প্রত্যাশা করা তাই বোধ করি ভুল হবে না।
লেখক : বিভাগীয় প্রধান, ইন্টারভেনশনাল হেপাটোলজি ডিভিশন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় ও সদস্য সচিব, সম্প্রীতি বাংলাদেশ।
কেআই//