জীবনের এপিঠ ওপিঠ
মানিক মুনতাসির
প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ২১ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
ঘটনাপ্রবাহ-১:
খিলগাঁও তালতলা মেইন রোডের ওপর গত কয়েকদিন যাবৎ টিসিবির ট্রাক সেল চলছে। ডাল, তেল, পিঁয়াজ, চিনি বিক্রি হচ্ছে ভর্তুকি মূল্যে। ট্রাক আসে ১০টার পর, তবে মানুষ লাইনে দাঁড়ায় ৮টার দিকেই, বিশেষত: নারীরা। কেউ কেউ তাদের শিশুদেরও কোলো করে নিয়ে আসেন। হয়তো কারো কাছে রেখে আসবেন, এমন নিরাপদ কেউ নেই বাসায়।
আমিও সকালে কোথাও গেলে আমার বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে যাই, যদি আমার মা গ্রামের বাড়িতে থাকেন। কারণ আমার স্ত্রীর অফিস বেশ সকালে শুরু হয়।
যাইহোক, ট্রাকের সামনে নিম্ন-মধ্য আয়ের মানুষ লাইনে দাঁড়িয়ে কিছুটা কম দামে পণ্য কিনেন প্রিয়জনের প্রয়োজন কিংবা ক্ষুধা মেটানোর জন্য। টানা দুদিন দেখলাম, শার্ট-প্যান্ট এবং চকচকে জুতা পরা, ক্লিন সেভ করা এক লোক লাইনে না দাঁড়িয়েই ট্রাকের পাশ থেকে পণ্য কিনলেন। আজকে তাকে কৌতূহলবশত: ধরেই ফেললাম। বললাম- ভাই, কাজটা কি ঠিক হলো?
লোকটা হতচকিত হয়ে বলল, কোন কাজ? লাইনে দাঁড়ানো, নাকি ট্রাক থেকে কেনা! কোনটা? আমি নিম্নস্বরে বললাম, কোনটাই না। সে তো অবাক! আমি বললাম, আপনি কালকেও কিনলেন। আজকেও একই জিনিস কিনলেন, কারণ কি? লোকটা লজ্জা পেয়ে বলল, ভাই পরিবার বড়, কিন্তু আয় কম। যদিও আমি ব্যাংকে চাকরি করি। এখনও ডিউটিরত, তারপরও এসেছি এটা নিতে। আরও বললেন, আসার সময় টাই-টা খুলে রেখে আসছি।
ঘটনাপ্রবাহ-২:
একই স্থানে প্রতিদিন বিকাল থেকে মধ্য রাত অবধি এক কাপ কফির জন্য লাইনে দাঁড়িয়ে থাকে শত শত মানুষ। দামী বাইক, গাড়ী নিয়ে কপোত-কপোতীরা কফিতে চুমুক দেন আয়েশি ভঙ্গিতে। এখানে এক কাপ কফি ন্যুনতম ৯০ টাকা। তাদের দেখলে বোঝার উপায় থাকে না, সকালে এখানে কি অবস্থা ছিল। বিকাল থেকে রাত দুপুর পর্যন্ত এখানে রীতিমত মেলা/হাট/বাজার বসে। রাস্তায় হাঁটাই যায় না। পার্কিং করেই বন্ধ হয়ে যায় অর্ধেক রাস্তা।
ঘটনাপ্রবাহ-৩:
প্রায় প্রতিদিন দুপুরে একটা মানসিক ভারসাম্যহীন ছেলেকে দেখি একই জায়গায়। বয়স ১৮-২০ হবে। জানলাম, তার বাবা নাকি পুলিশ সদস্য। পরিবার তাকে আটকে রাখতে পারে না। তাই সে যাযাবরের মতো ঘুরে বেড়ায়। প্রায় সময় তার হাতে থাকে পিৎজা। টাকা দিতে চাইলে নেয় না। কথাও বলে না। শুধুই হাঁটে, আর ফ্যাল ফ্যাল করে তাকায়। তবে প্রতিদিন নিয়ম করে তালতলার একটি কফি শপ থেকে ৩০ টাকা দিয়ে এক বোতল পানি আর একটা কোক কিনে নেয়। আমার সামনেও কয়েকদিন কিনেছে। সে নাকি বাইরের পানিও খায় না।
ঘটনাপ্রবাহ-৪:
এই স্থানের সামান্য দূরত্বে একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে একটি ফার্মেসিতে কাজ করে। সকাল ৯টা থেকে রাত ১১টা ডিউটি করে। মাঝে দুই ঘণ্টার বিশ্রাম পায়। কাস্টমার না থাকলে সে দোকানে বসেই বই পড়ে। নিজের খরচ মেটানোর পাশাপাশি সে পরিবারকে সহায়তাও করে। তার জন্য শুভ কামনা।
শেষকথা:
বাজারে সবকিছুর দামই এখন বেশি। ডিম, সবজি, মাছ, মাংস, চাল, ডাল, তেল, চিনি এমনকি বাসা ভাড়া, কোনো কিছুতেই লাগাম নেই। নেই কোনো তদারকি। কালকে চিনি কিনলাম ৮২ টাকা। অথচ প্যাকেটের গায়ে বড় করে লেখা ৭৫ টাকা। কে শোনে কার কথা। নেপালি ডাল কিনলাম ৮০ টাকা। যা এক বছর আগে ছিল ৫৫-৬০ টাকা।
তিনদিন আগে উবারের গাড়ীতে একই স্থান থেকে ফার্মগেট গেলাম ৩৬৫ টাকায়। অথচ করোনার শুরুরদিকে ধানমন্ডি যেতাম ২০০-২২০ টাকায়। একই স্থান থেকে একদিন আগে রিক্সায় করে প্রেসক্লাব গেলাম ৮০ টাকায়। ছয় মাস আগে যেতাম ৬০ টাকায়। জীবনের হিসাব মেলে না। মেলে না ফলাফলটাও।
তবে হাতে যে ফলাফল আসে তাতে সিংহভাগ মানুষই সন্তুষ্ট হতে পারে না। কারণ এই ফলাফলে তার কোনো হাত থাকে না। এটা নির্ধারিত হয় সৃষ্টিকর্তা কর্তৃক। আর তাঁর প্রতি মানুষ মোটেও সন্তুষ্ট নয়। কেননা মানুষ যা চায় তা পায় না। আর যা পায় তা চায় না। ফলে জীবনের প্রকৃত হিসাব আর ফলাফলটাও রয়ে যায় দুষ্প্রাপ্য।
একুশ নয় ২১।
এনএস//