যেখানে ব্যতিক্রম শেখ হাসিনার সরকার
সুমন ভট্টাচার্য
প্রকাশিত : ০৩:৩৯ পিএম, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০২১ শনিবার
পুজোর আগে এপারের বাঙালির পাতে সুস্বাদু ইলিশ পৌঁছে দিতে বাংলাদেশ সরকারের সিদ্ধান্তের জন্য দু’হাত তুলে আর্শীবাদ বা প্রয়োজনে-অপ্রয়োজনেও নয়াদিল্লির দিকে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেওয়ার জন্য কৃতজ্ঞতা জানানো ছাড়া শেখ হাসিনাকে এই ৭৪তম জন্মদিনে আমরা কিভাবে মনে রাখতে চাইব?
প্রতিবেশী দেশের একজন সাংবাদিক এবং রাজনীতির ছাত্র হিসেবে আমি বলব, মালয়েশিয়ার জন্য মহাথির যেটা ২৫ বছর ধরে করেছিলেন, সেটা শেখ হাসিনা গত ১৩ বছরে করে দেখিয়েছেন। অর্থাৎ বিশ্বের উন্নয়নের মানচিত্রে বাংলাদেশকে এমন জায়গায় পৌঁছে দেওয়া, যা নিয়ে ভবিষ্যতের সোনালী দিনের স্বপ্ন দেখা যায়। এই ২০২১ এ আমি যখন এই লেখা লিখছি, তখন আওয়ামী লীগ নেত্রীর বাংলাদেশ জিডিপি বৃদ্ধির হারকে এমন জায়গায় ধরে রেখেছে যে, আমাদের, মানে ভারতের মতো বিশাল অর্থনীতির কাণ্ডারিরাও প্রতিযোগিতার নিরিখে চাপে আছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতির এই ঊর্ধ্বমুখী হার আন্তর্জাতিক মহলে এখন চর্চার বিষয়।
অর্থনীতি, গ্রামীণ বাংলাদেশের উন্নয়ন এবং মহিলাদের ক্ষমতায়ন যদি শেখ হাসিনার শাসনকালের মাইলফলক হয়, তাহলে অবশ্যই তাকে প্রশংসা করতে হবে শেখ মুজিবের মতো ধর্মনিরপেক্ষতার ঝাণ্ডাকে স্বমহিমায় উড়িয়ে রাখার জন্য। বাংলাদেশের মতো একটি মুসলিম সংখ্যাগুরু রাষ্ট্রে ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে মূলধন করে রাষ্ট্র এবং শাসন ক্ষমতা চালানো কতটা মুশকিল, তা বোধহয় আমাদের আফগানিস্তান দেখে বুঝে নেওয়া উচিত। যেহেতু দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ায় ধর্ম, সমাজ এবং রাজনীতি পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে হাঁটে এবং পাকিস্তানের মতো রাষ্ট্র থাকে সবসময় ধর্মীয় আইডেন্টিটিকে খুঁচিয়ে তোলার জন্য, সেখানে শেখ হাসিনা কত সযত্নে ভারসাম্য রক্ষা করে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন, সেটা বোধহয় আলাদা করে উল্লেখ করতেই হবে।
অবশ্যই এই বিষয়ে শেখ হাসিনার বড় ফিক্সড ডিপোজিট তার বাবা, স্বাধীন বাংলাদেশের জন্মদাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের আদর্শ। যে মতাদর্শকে হয়তো এখন ‘মুজিবইজম’ বলবার সময় এসে গিয়েছে।
মোহনদাস করমচান্দ গান্ধী যেমন প্রবলভাবে হিন্দু থেকেও ধর্মনিরপেক্ষ ভারত গড়ে তোলার কথা বলে গিয়েছেন, তেমনই মুজিব তার ধর্মীয় আইডেন্টিটির সঙ্গে কোনোরকম সমঝোতা না করেও বাঙালি জাতীয়তাবাদকে সুউচ্চ বা সুমহান চেহারা দিয়ে গিয়েছেন। ইউরোপ সেকুলার বলতে যা বোঝে, এই এশিয়ায় সেইভাবে ধর্মকে সমাজের থেকে বিযুক্ত রাখা যায় না, এটা গান্ধী বুঝতেন। তাই গান্ধী সব ধর্মকে সমান মর্যাদা দেওয়ার কথা বলেছেন,বঙ্গবন্ধুও ধর্মকে গুরুত্ব দিয়েও ধর্মনিরপেক্ষ বাংলাদেশের ভিত রচনা করেছেন। এটা জিন্নার দ্বি-জাতি তত্ত্বের উল্টো পথে হেঁটে যেমন এথনিক আইডেন্টিটিকেই অগ্রাধিকার দেয়, তেমনই সাংস্কৃতিক এবং ভাষাগত আবেগকেও অগ্রাধিকার দেয়। বঙ্গবন্ধু আজ থেকে ৫০ বছর আগে যে রোল মডেল দাঁড় করিয়েছিলেন, ধর্মান্ধতার প্রতিস্পর্ধী হিসেবে যে রাষ্ট্রের মডেলকে সামনে এনেছিলেন, তা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় এখন আইকনিক মর্যাদা পেয়ে গিয়েছে।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে যেমন কামাল আতাতুর্ক আধুনিক তুরস্ক রাষ্ট্র গঠনের মধ্যে দিয়ে মুসলিম বিশ্বর জন্য একটা রোডম্যাপ তৈরি করেছিলেন, পশ্চিমের সঙ্গে পায়ে পা মিলিয়ে চলার, আধুনিক রাষ্ট্র গঠনের আর্কিটাইপ তৈরি করেছিলেন, সেটা যেমন অনেকদিন আদর্শ হিসেবে ছিল, তেমনই এই শতাব্দীতে ‘মুজিবইজম’ এর কোনো বিকল্প নেই। ৯/১১ থেকে কাবুলে ফের তালেবানদের ফেরত আসার মধ্যে দিয়ে বিশ্বরাজনীতিতে যে উথালপাতাল হল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশ এবং শেখ হাসিনার সরকার এক উজ্জ্বল ব্যতিক্রম।
আমাদের মনে রাখতে হবে, গত দশকে এমন সময় গিয়েছে যখন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলের নেত্রী, সংসদের স্পিকার এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যন্ত মহিলা ছিলেন। মহিলাদের ক্ষমতায়নের এমন চমকপ্রদ উদাহরণ এশিয়ায় তো বটেই, আলোকপ্রাপ্ত বলে পরিচিত ইউরোপেও বিরল।
আমি যেমন নিজে আরও অনেক ভারতীয় সাংবাদিকের মতো মনে করি, বঙ্গবন্ধু গত শতকের শ্রেষ্ঠ বাঙালি রাজনীতিক, যিনি একটা স্বাধীন রাষ্ট্রের জন্ম দিয়ে গিয়েছেন, তেমনই শেখ হাসিনাও গত ২৫ বছরে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অন্যতম সফল নেত্রী, যিনি একটানা ১৩ বছর ক্ষমতা ধরে রাখতে পেরেছেন। পাকিস্তানের মতোই যে বাংলাদেশে একসময় সামরিক শাসন এবং রাজনৈতিক অস্থিরতা নিত্যনৈমিত্তিক ছিল, সেখানে শেখ হাসিনা ঢাকাকে স্থিতিশীল সরকার দিয়েছেন এবং সেটা বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও নিয়মিত নির্বাচনের মধ্যে দিয়েই।
গত দশ বছরে এশিয়া এবং আফ্রিকা যেসব রাজনৈতিক উথালপাথাল দেখেছে, এমনকি নোবেলজয়ী রাষ্ট্রনায়কও যেভাবে গণহত্যা, জাতিদাঙ্গায় হাত রক্তাক্ত করেছেন, সেখানে বাংলাদেশ উজ্জ্বলতম জ্যোতিষ্ক। নাগরিক সমাজ এবং শিক্ষিত মধ্যবিত্ত যেখানে রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পূর্ণ বৈরিতায় চলে যায়নি, বরং নিজেদের আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন নিয়ে নিয়ত রাষ্ট্রের সঙ্গে সংলাপ করছে।
আমার কাছে ব্যক্তিগতভাবে যেটা আগ্রহজনক মনে হয়, যে সামাজিক সূচকগুলোর জন্য আমার দেশ, মানে ভারত গোটা পৃথিবীর নজর কাড়ে, বাজার হিসেবে আমাদের দিকে সকলের নজর, বাংলাদেশও দ্রুত সেই দিকে হেঁটেছে। বাজার হিসেবে বাংলাদেশ এখন যথেষ্ট বড়, এর পাশাপাশি সক্ষম এবং গতিশীল, ইংরেজিতে বললে aspiring class, বা মধ্যবিত্ত শ্রেণি সংখ্যায় বাড়ছে। পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের বিশ্বজোড়া খ্যতি পুরনো কথা, অর্থনীতির ঊর্ধ্বমুখী গ্রাফ আসলেই ঢাকাকে ভিয়েতনামের সঙ্গে এক ব্র্যাকেটে নিয়ে এসেছে। অর্থাৎ বিশ্ব ব্যাংক বা আইএমএফ অর্থনৈতিক উন্নতির জন্য বিভিন্ন মহাদেশের যে ২০টি দেশকে চিহ্নিত করেছে, তার মধ্যে হো চি মিনের দেশের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর দেশও রয়েছে।
আমি ইচ্ছে করেই বাংলাদেশ এবং ভিয়েতনামের এক ব্র্যাকেটে আসাটা উল্লেখ করলাম, কারণ কলকাতার বাঙালি হিসেবে এটা আমাদের কাছে শ্লাঘার বিষয়, বিশেষ করে গত শতকের ছয় এবং সাতের দশক যেহেতু আমার শহরের রাজপথে অনেক মিছিল হয়েছে এই দুটি রাষ্ট্রের সমর্থনে, ভিয়েতনাম আর বাংলাদেশের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর স্লোগান তুলে, সেই দুটি দেশ অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি এবং বৃদ্ধির নিরিখে G20 গোষ্ঠীতে ঢুকে পড়েছে। এটা কলকাতাবাসীকে গর্বিত এবং দূরদৃষ্টির জন্য পিঠ চাপড়ানি জুটিয়ে দেয়।
বাঙালি হিসেবেই, কলকাতাবাসী হিসেবেই শেখ হাসিনাকে যেমন জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাব, তেমনই লক্ষ্য রাখব তিনি আগামীদিনের জন্য বাংলাদেশের মননে কি গেঁথে দিয়ে যাচ্ছেন। ধর্মনিরপেক্ষ এবং উন্নয়নের হাইওয়ে ধরে চলতে থাকা যে বাংলাদেশকে তিনি এতদূর নিয়ে এলেন, তার ব্যাটন তিনি কিভাবে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে তুলে দিয়ে যান, সেটাও একটা রোল মডেল হতে পারে।
লেখক : পশ্চিমবঙ্গের সাংবাদিক, রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
এসএ/