আশ্রয়ণ প্রকল্প` থেকে যুবলীগের আশ্রয় কর্মসূচি
জয়দেব নন্দী
প্রকাশিত : ০৫:২৮ পিএম, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২১ মঙ্গলবার
ফাতেমা তুজ জোহরা। গাজীপুরের ৪৭ নম্বর ওয়ার্ডের মরকুন টঙ্গি এলাকার বাসিন্দা। গ্যাস সিলিন্ডার বিস্ফোরণে শরীরের প্রায় ২৫ ভাগ পুড়ে গেছে তার। স্বামী ক্যান্সারে আক্রান্ত। ১১ বছরের একমাত্র ছেলেকে নিয়ে থাকেন ময়লা-দুর্গন্ধময় এক ঝুপড়ি ঘরে। রোদ-বৃষ্টি-ঝড় তাদের নিত্য দিনের সঙ্গী।
বাসযোগ্য ঘরের অভাবে ফাতেমা স্বামী-সন্তান নিয়ে কখনও অঝর বৃষ্টিকে আলিঙ্গন করে, কখনও প্রচণ্ড রোদ, কখনওবা প্রচণ্ড ঝড় মাথায় নিয়ে থাকতে হয়। অসহায় ফাতেমার পাশে ছিল না কোনও মানুষ, পারিপার্শ্বিক পরিবেশ ও প্রতিবেশ। পরম করুণাময়ের কাছে সঁপে দেয়া তাদের জীবন। অর্থনৈতিক সংকট ও জীবন-যন্ত্রণাকে সঙ্গী করে দিন কাটায় ফাতেমা ও তার স্বামী-সন্তান।
এবার সেই ফাতেমা ও তার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ। ২টি কক্ষের একটি পাকা বাড়ি নির্মাণ করে দিয়ে ফাতেমা ও তার পরিবারের কষ্ট লাঘবে সহায়ক হয়েছে যুবলীগের স্থানীয় নেতৃবৃন্দ। পাকা ঘর পেয়ে ফাতেমা আবেগ আর উচ্ছ্বাস নিয়ে বলেন, "মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর পক্ষে যুবলীগের ভাইয়েরা আমার পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছে। নতুন বাড়ির চাবি পেয়ে আমি খুবই খুশি; এখন আর আমাদের বৃষ্টিতে ভিজতে হবে না, রোদে পুড়তে হবে না। আমি বাচ্চাদের আরবি পড়িয়ে সংসার চালাতাম। কিন্তু এমন ময়লা দুর্গন্ধময় ঝুপড়ি ঘরে কোন বাচ্চা একমুহূর্তেও বসতে চাইতো না। বাচ্চাদের আরবি পড়ানোও বন্ধ হয়ে গেল। আমার সংসার চালানোও দূরূহ হয়ে গেল। এখন যুবলীগের দেয়া নতুন বাড়িতে আমি আবার বাচ্চাদের আরবি পড়াতে পারবো। আশা করছি, ভালভাবে সংসার চালাতেও পারবো। আমি ধন্যবাদ জানাই গাজীপুর মহানগর যুবলীগের সাইফুল ভাইকে। সে কেন্দ্রীয় যুবলীগের নির্দেশে আমার এই বাড়িটি নির্মাণ করে দিয়েছে।"
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ এর চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ ও সাধারণ সম্পাদক মাইনুল হোসেন খান নিখিল এর নির্দেশে সারাদেশের প্রতিটি জেলায় অসহায় গৃহহীন মানুষকে বিনামূল্যে গৃহনির্মাণ করে দেবার কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। সেই কর্মসূচির নাম দেয়া হয় আশ্রয় কর্মসূচি। দেশব্যাপী যুবলীগের সকল ইউনিটকে নিজ নিজ এলাকার গৃহহীন মানুষ চিহ্নিত করে সচ্ছল যুবলীগ নেতাকর্মীর মাধ্যমে গৃহনির্মাণের নির্দেশনা প্রদান করা হয়। তারই ধারাবাহিকতায় গতকাল ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স মিলনায়তনে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা'র ৭৫তম জন্মদিন উপলক্ষে আশ্রয় কর্মসূচি'র শুভ উদ্বোধন ঘোষণা করেন যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ।
আশ্রয় কর্মসূচির উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রাথমিকভাবে গাজীপুর, ময়মনসিংহ, নরসিংদী ও শেরপুরের ১০টি পৃথক পৃথক স্থানের গৃহহীনের মধ্যে ১০টি গৃহের চাবি হস্তান্তর করা হয়।
গাজীপুর মহানগর যুবলীগের আহ্বায়ক কামরুল আহসান রাসেল সরকারের পক্ষ থেকে দুইটি ঘর প্রদান করা হয়। ঘর দুটি গ্রহণ করেন মো. ইমান আলী, প্রেম কুমার দাস। গাজীপুর মহানগর শাখার যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. সাইফুল ইসলামের পক্ষ থেকে পাঁচটি ঘর দেওয়া হয়। ঘরগুলো গ্রহণ করেন- ফাতেমা তুজ জোহরা (দুটি), আনোয়ারা বেগম (দুটি), নুর মোহাম্মদ কটু মিয়া (১টি)।
নরসিংদী জেলা শাখার সহ-সভাপতি মো. শামছুল ইসলাম মোল্লার পক্ষ থেকে একটি ঘর গ্রহণ করেন- রতন বালা, ময়মনসিংহ জেলা শাখার আহ্বায়ক অ্যাডভোকেটে আজহারুল ইসলামের পক্ষ থেকে একটি ঘর গ্রহণ করেন- বিউটি খাতুন, শেরপুর জেলা শাখার সভাপতি হাবিবুর রহমানের পক্ষ থেকে একটি ঘর গ্রহণ করেন- মোসা. খুশবান।
আশ্রয় কর্মসূচি উদ্বোধনকালে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশ বলেন, যুবলীগের নিজস্ব অর্থায়নে পরিচালিত আশ্রয় কর্মসূচি চলমান থাকবে এবং যুবলীগের যেসব নেতাকর্মী নিজ অর্থে গৃহহীনের মধ্যে গৃহদান করছে, তাদের প্রতি ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে যুবলীগের আশ্রয় কর্মসূচি প্রণয়ন এর মূল অনুপ্রেরণা ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা। "বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলায় কেউ গৃহহীন থাকবে না"- বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা এই বাক্যটি শুধু বলার জন্য বলেন নি। তিনি আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে লক্ষ লক্ষ অসহায় গৃহহীন মানুষকে চলমান মুজিব বর্ষে গৃহ নির্মাণ করে দিয়েছেন, এখনও দিচ্ছেন।
"জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ২০ ফেব্রুয়ারি, তৎকালীন নোয়াখালী বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার চর পোড়াগাছা গ্রামে ভূমিহীন-গৃহহীন, অসহায় ছিন্নমূল মানুষের পুনর্বাসন কার্যক্রমের যাত্রা শুরু করেন। তার দেখানো পথেই বঙ্গবন্ধুকন্যা ১৯৯৭ সালের ১৯ মে দেশের দক্ষিণ-পূর্ব কক্সবাজার জেলার সেন্টমার্টিনে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের দুর্দশা দেখে তাদের পুনর্বাসনের নির্দেশ দেন। আওয়ামী লীগ নেতার দান করা জমিতেই শুরু হয় পুনর্বাসন কার্যক্রম। আর ১৯৯৭ সালে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে সমগ্র দেশে শুরু করেন আশ্রয়ণ প্রকল্প। সর্বশেষ অগ্রগতিসহ ব্যারাক ও একক গৃহে এ পর্যন্ত ৪,৪২,৬০৮ ভূমিহীন ও গৃহহীন পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।
অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের আওতাধীন সমতলে বসবাসরত ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীভুক্ত ৪,৮৩২ পরিবারের জন্য গৃহ নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। পাহাড়ে বসবাসরত ৮,১০৬ পরিবারকেও গৃহ প্রদান করা হয়েছে। তাদের পেশা উপযোগী প্রশিক্ষণ ও ক্ষুদ্র ঋণ বিতরণ করা হয়েছে। পুনর্বাসনের জন্য স্থানীয় জনপ্রতিনিধির সহায়তায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নেতৃত্বে প্রকল্প স্থান বাছাইসহ ভূমি উন্নয়ন ও উন্মুক্ত পদ্ধতিতে স্থানীয় জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে উপকারভোগী নির্বাচন এ কার্যক্রমের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। কক্সবাজারের খুরুশকুলে জলবায়ু উদ্বাস্তুদের জন্য ২০ ভবনে ৬৪০ পরিবারকে পুনর্বাসন করা হয়েছে। এখানে আরও ৩,৭৬৯ পরিবারকে পুনর্বাসনের জন্য ১১৯ ভবন নির্মাণের কার্যক্রম চলমান। খুরুশকুল প্রকল্পটি বিশ্বের একক বৃহত্তম জলবায়ু উদ্বাস্তু পুনর্বাসন প্রকল্প হিসেবে ইতোমধ্যে দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
বাংলাদেশের ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের আবাসন নিশ্চিতকল্পে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার অন্যতম উদ্ভাবন হচ্ছে ‘আশ্রয়ণ প্রকল্প’। একটি ঘর একটি ছিন্নমূল পরিবারের দারিদ্র্য হ্রাসসহ সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার, এটি এখন প্রমাণিত। প্রতিটি নিরাপদ গৃহ পরিবারের সকলকে করে তোলে আস্থাবান, প্রত্যয়ী এবং বর্তমান ও ভবিষ্যতের পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে উদ্যোগী। মুজিববর্ষে এসে দ্রুততম সময়ে গৃহহীন ও ভূমিহীন মানুষকে গৃহ প্রদানের মাধ্যমে জাতির পিতা সূচিত গৃহায়ন কর্মসূচীকে তিনি নতুনরূপে উপস্থাপন করেন। জাতির সামনে আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পকে অধিকতর যুগোপযোগী ও টেকসই করার লক্ষ্যে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নতুন ডিজাইনের গৃহ নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ করেন। ব্যারাক নির্মাণ কর্মসূচীর পাশাপাশি প্রতিটি দুস্থ পরিবারের জন্য ২ শতক জমি প্রদানসহ দুই কক্ষবিশিষ্ট গৃহ, প্রশস্ত বারান্দা, রান্নাঘর ও টয়লেট নির্মাণের জন্য কর্মসূচী গ্রহণ করা হয়। এ লক্ষ্যে ২৩ জানুয়ারি ২০২১ সালে তিনি প্রথম পর্যায়ে ৬৯ হাজার ৯০৪ পরিবারের মালিকানা স্বত্বসহ গৃহ প্রদান করেন। দ্বিতীয় পর্যায়ে ২০ জুন, ২০২১ সালে ৫৩ হাজারের অধিক পরিবারকে অনুরূপভাবে গৃহ প্রদান করা হয়। একইসঙ্গে এই বিপুল সংখ্যক পরিবারকে গৃহ প্রদানের ঘটনা পৃথিবীতে আর কোন দেশে সম্ভব হয়নি"
মাননীয় প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা আশ্রয়ণ প্রকল্পের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ সহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদেরকে নিজ নিজ এলাকার ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের তথ্য সংগ্রহ করতে বলেন। কেননা, বঙ্গবন্ধুকন্যা চান, বঙ্গবন্ধুর বাংলায় যেন কোন মানুষ গৃহহীন না থাকে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সেই মহৎ কর্মোদ্যোগ 'আশ্রয়ণ প্রকল্প'কে অনুপ্রেরণা হিসেবে নিয়ে যুবলীগ চেয়ারম্যান শেখ ফজলে শামস পরশের নেতৃত্বে পরিচালিত হতে থাকে যুবলীগের আশ্রয় কর্মসূচি। প্রাথমিকভাবে যুবলীগ ১০ টি গৃহহীন পরিবারের মাঝে গৃহদান করেছে। আগামী ডিসেম্বর মাসের শেষ দিন পর্যন্ত মুজিব বর্ষের কার্যক্রম অব্যাহত থাকবে। যুবলীগের টার্গেট, আগামী সেই ৯০ দিনের মধ্যে অর্থাৎ মুজিব বর্ষ চলাকালীন সময়ে ন্যুনতম ১০০ গৃহহীন পরিবারের মাঝে যুবলীগ গৃহদান করবে।
শেখ ফজলে শামস পরশের নেতৃত্বে যুবলীগ বিশ্বাস করে- আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা ভূমিহীন-গৃহহীন অসহায় মানুষের গৃহ নির্মাণ করে দেবার যে সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছেন; সেই সংগ্রামে বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ রাষ্ট্রনায়ক শেখ হাসিনা'র মহৎ কর্মোদ্যোগের পাশে থেকে আশ্রয় কর্মসূচি পরিচালনা ও বাস্তবায়নে ভূমিকা রেখে যাবে।
লেখক: প্রচার সম্পাদক, বাংলাদেশ আওয়ামী যুবলীগ।
এসি