ঢাকা, শনিবার   ২৩ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৮ ১৪৩১

এবার কৃত্রিম হাত বানিয়ে সাড়া জাগালেন সাদ্দাম উদ্দিন

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ০৫:৫৫ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৬:০১ পিএম, ১ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার

সাদ্দাম উদ্দিন আহমদ

সাদ্দাম উদ্দিন আহমদ

হাত মানুষের অতি প্রয়োজনীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ দুটি অঙ্গ। যে কোনো কাজে এই হাতই যে সবার আগে সাড়া দেয়। কিন্তু আমাদের চারপাশে এমন বহু মানুষ আছেন, যাদের জন্ম থেকেই দুই হাত নেই। আবার অনেককে দুর্ঘটনার শিকার হয়ে হাত কেটে ফেলতে হয়েছে। কারও আবার হাত আছে কিন্তু তা দিয়ে কাজ করতে পারেন না- পক্ষাঘাতগ্রস্ত। শারীরিকভাবে অক্ষম এমন অসহায় মানুষের জন্য ব্যতিক্রমী কৃত্রিম হাত আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দিয়েছেন ঢাকার যুবক সাদ্দাম উদ্দিন আহমদ। 

জন্মের পর থেকেই যারা হাতহীন কিংবা দুর্ঘটনায় যারা শরীরের গুরুত্বপূর্ণ এই অঙ্গটি হারিয়েছেন, তাঁর আবিষ্কৃত কৃত্রিম এই হাতের সাহায্যে দৈনন্দিন কাজকর্ম করতে পারবেন সেসব অসহায়রা। মূলত মানবসেবার উদ্দেশেই স্বল্প ব্যয়ে যান্ত্রিক এ হাতের ব্যবহার করতে পারবেন তারা। এমনটাই জানিয়েছেন সাদ্দাম উদ্দিন।

তিনি জানান, তাঁর আবিষ্কৃত কৃত্রিম এই হাতের সাহায্যে মোবাইল ফোন ও রিমোট কন্ট্রোলের ব্যবহার করা যাবে। ১০ কেজি পর্যন্ত ওজনের জিনিসও উত্তোলন করতে পারবেন ব্যবহারকারী। অন্যের সাহায্য ছাড়াই চামচের মাধ্যমে খাবার খাওয়া যাবে এবং লেখাও যাবে কৃত্রিম এই হাত দিয়ে।

এছাড়াও যেসব ঝুঁকিপূর্ণ কাজ হাত দিয়ে করা সম্ভব নয়, যেমন- বিদ্যুতের সুইচ, ফ্যান মেরামতের কাজ কিংবা যে কোনো ইলেকট্রিক পণ্য মেরামতের কাজও করা যাবে কৃত্রিম এই হাতের সাহায্যে। মূলত বডি কন্ট্রোল সুইচের মাধ্যমে পরিচালিত হবে এই হাত। সুইচ দিয়ে নির্দেশনা দিলেই কাজ করবে হাতের আঙুলগুলো। 

কৃত্রিম এই হাত তৈরির বিষয়ে সাদ্দাম উদ্দিন বলেন, আমাদের চারপাশে যাদের হাত নেই তাদের জন্য কিছু একটা করা দরকার বলেই মনে হয়েছে আমার। সেই মানবিক চিন্তা থেকেই নেয়া এ উদ্যোগ। পঙ্গু-প্যারালাইজড রোগী, যারা হাত নড়াচড়া করতে পারেন না, তাদের জন্য এই ডিভাইসটি কাজে লাগবে। এছাড়া বাজারে যেসব কৃত্রিম হাত পাওয়া যায়, সেগুলো খুব একটা কাজ করে না। আবার যেসব হাত কাজ করে, সেগুলো কিনতে খরচ বেশি হয়। তাই আমি কম খরচে এই হাত তৈরি করেছি, যেটি মানবকল্যাণে কাজে আসবে। 

কৃত্রিম এই হাতের ব্যবহার সম্পর্কে আহমদ জানান, কেবল ছোট্ট একটি ডিভাইসের সাহায্যে সহজেই হাতটি শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে লাগিয়ে দেওয়া হবে। যার কব্জি নেই, সেই মাপে হাত বানিয়ে কব্জিতে ডিভাইসটি বসিয়ে দেওয়া হবে। যার কনুই পর্যন্ত বিচ্ছিন্ন, তার জন্য সেই মাপমতো হাত তৈরি করে শরীরের নির্দিষ্ট স্থানে বসিয়ে দেওয়া যাবে। ওই ডিভাইসটির সাহায্যেই মূলত নির্দেশনা পাবে হাত। আর কাজও করবে সেই অনুযায়ী।

মূলত দুই ধরনের হাত তৈরি করেছেন সাদ্দাম। হাইব্রিড হাত ও রোবটিক হাত। দুটির কাজও প্রায় একই। রোবটিক হাতে খরচ বেশি আর হাইব্রিড হাতে খরচ তুলনামূলক কম।

সাদ্দাম জানান, জন্ম থেকে হাত নেই অথবা দুর্ঘটনায় হাত হারিয়েছেন এমন ১০০ শিক্ষার্থীকে বিনামূল্যে কৃত্রিম এই হাত দেয়ার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর। অসহায় এই মানুষগুলো হাইব্রিড হাতের সাহায্যে দৈনন্দিন কাজ করতে পারলেই তার পরিশ্রম সার্থক হবে।

তিনি বলেন, ‘প্রথমে একশ’ শিক্ষার্থীকে কৃত্রিম হাত দিতে চাই। নিজ খরচে হাতগুলো তৈরি করছি। এগুলো মানুষের উপকারে এলে আমি তৃপ্তি পাব।’

এদিকে, নিজের আবিষ্কৃত এই হাইব্রিড ও রোবটিক হাতের মেধাস্বত্ব পাওয়ার জন্য মন্ত্রণালয়ে আবেদন করার প্রস্তুতিও নিচ্ছেন জানিয়ে সাদ্দাম বলেন, ‘রোবটিক হাত তৈরি করতে আমার ২০ হাজার টাকা খরচ হচ্ছে। আর হাইব্রিড হাত তৈরি করতে খরচ ৫ হাজার টাকার মতো। মেধাস্বত্ব পাওয়ার পর আমি হাতগুলো সরবরাহ করব।’

তবে কৃত্রিম এই হাত আবিষ্কারের নেপথ্যে একটি গল্প রয়েছে বলেও জানান বিরল প্রতিভার অধিকারী সাদ্দাম। তিনি জানান, ছোটবেলা থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি তার ঝোঁক ছিল। কিছু একটা পেলেই তা নিয়ে গবেষণা শুরু করতে ভালো লাগত। এমনকি শিশুকন্যার ইচ্ছাপূরণে এ পর্যন্ত বেশ কিছু ডিভাইস আবিষ্কার ও উদ্ভাবন করেছেন বলেও জানান তিনি। কৃত্রিম হাতও তার একটি। 

সাদ্দাম বলেন, একদিন বাসায় খেলা করার সময় জানালা দিয়ে সানশেডে খেলনা পড়ে যায় মেয়ের। তখন মনে হলো কৃত্রিম একটি হাত থাকলে তো সেটির সাহায্যে শিশুকন্যা নিজেই খেলনাটি তুলে নিতে পারত। সেই ভাবনা থেকেই গবেষণা শুরু। গবেষণার এক-দেড় মাসের মধ্যেই রোবটিক হাত আবিষ্কার করতে সক্ষম হন সাদ্দাম। পরে দেখলেন, এই হাত মানবকল্যাণেও ব্যবহার করা যাবে।

এই ডিভাইস ব্যবহারের কারণে শরীরের কিংবা রক্ত চলাচলে কোনো সমস্যা হবে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে সাদ্দাম বলেন, এ রকম স্বাস্থ্যঝুঁকি দেখা দেয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। তবু ডাক্তারের পরামর্শ নিয়েই হাত ব্যবহার করতে বলব আমি।

উদ্ভাবক সাদ্দাম উদ্দিন আহমদের অবশ্য এটিই প্রথম উদ্ভাবন কিংবা আবিষ্কার নয়; এর আগে তিনি হ্যাকপ্রুপ লেজার টকি উদ্ভাবন করেন। এর মাধ্যমে তার ছাড়াই কথা বলা যাবে দূর-দূরান্ত পর্যন্ত। তবে এ ক্ষেত্রে লাগবে আলোর সাহায্য। আলো যতদূর পৌঁছাবে, লেজার টকির সাহায্যে ততদূর নিরবচ্ছিন্ন যোগাযোগ করা সম্ভব হবে তার ছাড়াই।

হ্যাকপ্রুপ এই ডিভাইসটি আবিষ্কারের ফলে ঝড়ঝঞ্ঝা, সাইক্লোনকবলিত এলাকার লোকজনের উপকার হবে। ঝড়-সাইক্লোনের পর ওইসব এলাকায় মোবাইল নেটওয়ার্ক ও টেলিফোন লাইন সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়লে লেজার টকির সাহায্যে যোগাযোগ করা সম্ভব হবে বলেই জানান তিনি।

এছাড়া পাহাড়ি দুর্গম এলাকা যেখানে নেটওয়ার্ক দুর্বল, সেখানে এই ডিভাইসের সাহায্যে সহজেই যোগাযোগ করা যাবে। যারা গভীর সাগরে মাছ ধরতে যান, তাদের ক্ষেত্রেও যোগাযোগে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

সাদ্দাম উদ্দিন আহমদের আবিষ্কারের মধ্যে আরও রয়েছে— রোবট ট্রলি, যেটি রিমোট দিয়ে পরিচালিত হবে। করোনাকালে তিনি এটি আবিষ্কার করেছেন। রিমোটের সাহায্যে পরিচালিত এই ট্রলি এক ঘর থেকে অন্য ঘরে খাবারসহ জরুরি সামগ্রী পৌঁছে দেবে। করোনা আক্রান্ত রোগী নিজ ঘরে কোয়ারেন্টাইনে থাকলে তার ধারেকাছে না গিয়েও এই ট্রলির সাহায্যে প্রয়োজনীয় ওষুধ, খাবার ও জিনিসপত্র পৌঁছে দেওয়া যাবে।

এছাড়া পানি ঠাণ্ডা করার পাত্রও আবিষ্কার করেছেন সাদ্দাম। চার্জারের সাহায্যে মোবাইল থেকে চার্জ দিয়ে পানি ঠাণ্ডা করা যাবে।

গবেষক, উদ্ভাবক সাদ্দাম উদ্দিন আহমদের জন্ম ময়মনসিংহে। সপরিবারে থাকেন ঢাকার ওয়ারীতে। চাকরি করেন বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে। ভারতের বেঙ্গালুরু বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার অ্যাপ্লিকেশনে ব্যাচেলর ডিগ্রি সম্পন্ন করে দেশে ফিরে কাজ শুরু করেন তিনি। বর্তমানে ওয়ারীর বাসাতে-ই বিভিন্ন বিষয় নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন মানবকল্যাণকামী সাদ্দাম উদ্দিন।

এনএস//