করোনা পরবর্তী অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় প্রস্তুতি
প্রফেসর ড. মুহম্মদ মাহবুব আলী
প্রকাশিত : ১০:০২ পিএম, ৮ অক্টোবর ২০২১ শুক্রবার | আপডেট: ০৯:৩৫ পিএম, ১৩ অক্টোবর ২০২১ বুধবার
বৈশ্বিক পটভূমিতে কোভিড-১৯ এর কারণে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও অর্থনীতি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাণিজ্য ও কর্মসংস্থানের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এই ক্ষতি এখন কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকারি-বেসরকারি খাতকে একযোগে কাজ করতে হবে। বর্তমানে কোভিড-১৯ ভ্যাকসিন প্রদান কার্যক্রমে গতি সঞ্চারিত হয়েছে। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে আমাদের সবাইকে স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দায়িত্ব পালন করে নিজের পরিবার ও সমাজের জন্য কাজ করতে হবে। এ সময়ে অর্থনৈতিক বিপর্যয় কাটিয়ে উঠতে ব্যাষ্টিক ও সামষ্টিক অর্থনীতিতে চাহিদা ও জোগানের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টি করতে হবে। উত্পাদন বাড়াতে বিভিন্ন কলকারখানায় প্রয়োজনে ছুটিছাটা কমিয়ে আনতে হবে।
কল্যাণমুখী রাষ্ট্রে যথার্থ অর্থে নাগরিকদের মানবসমপদে রূপান্তরের ব্যবস্থা করতে হবে। এজন্য শিক্ষাব্যবস্থার পুনর্গঠন জরুরি। দীর্ঘদিন পর ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনায় মনোনিবেশ করা একটু কষ্টসাধ্য। তাদের মধ্যে কোনো ধরনের আচরণগত সমস্যা দেখা দিলে সেটিকে সুন্দরভাবে মোটিভেট এবং কাউন্সেলিং করে পড়াশোনার দিকে ফিরিয়ে আনতে হবে। কেননা দীর্ঘদিনের ব্যবধানে সব ছাত্রছাত্রী যে আবার পড়তে ইচ্ছুক হবে তা নয়। গ্রামীণ অঞ্চলে দেখা যায় যে, করোনাকালে অনেক ছাত্রীর বিয়ে হয়ে গেছে। এক্ষেত্রে তালিকা করে সংসারের পাশাপাশি পড়াশোনাতেও যাতে ছাত্রীরা ফিরে আসে, তার জন্য বিদ্যালয়ের প্রধান, শিক্ষক-শিক্ষিকা ও স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে একযোগে কাজ করতে হবে। অন্যদিকে দীর্ঘদিন পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলো খোলায় ছাত্রছাত্রীদের নিজেদের স্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে গণরুমে যাতে তাদের না থাকতে হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। এজন্য পরীক্ষা ভার্চুয়ালি ও ফিজিক্যালি দুই ব্যবস্থাতেই হওয়া বাঞ্ছনীয়।
এ দেশে কোভিড-১৯ ধরা পড়ার পর থেকে সরকারপ্রধান যথাযথভাবে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য নানামুখী কর্মসূচি হিসেবে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেন। এসএমই সেক্টরের জন্য গত বছরের দেওয়া বরাদ্দের ৮৪ শতাংশ নির্দিষ্ট সময়ের পর এ বছর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাস্তবায়িত হয়েছে। ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দেশে যে বৈপ্লবিক উন্নয়নের ছোঁয়া অদম্য গতিতে লেগেছিল, কোভিড সমস্যা সৃষ্টি হওয়ার পরও পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় বলতে গেলে আমরা খুব খারাপ অবস্থায় নেই। অবশ্য অনেক বেকার ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী অনিশ্চিত ভবিষ্যতের মুখোমুখি হয়েছে। এক্ষণে তা কাটিয়ে ওঠার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে সততা, ন্যায়নিষ্ঠা ও কর্মদক্ষতার সঙ্গে কাজ করতে হবে, যেন দেশের সামষ্টিক অর্থনীতির ব্যাষ্টিক ভিত্তিটি শক্তিশালী হয়ে ওঠে। শহর এলাকায় যারা বস্তিবাসী আছে, টিকা নিলেও যাতে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলে, সে ব্যাপারে আমাদের সচেষ্ট হতে হবে। বহুভাবে সরকার তাদের সচেতন করতে চেয়েছেন। অথচ তাদের অনেকে বিষয়টি মানতে চাইছেন না। অনলাইন ব্যবসায়ের ক্ষেত্রে গ্রাহকেরা যাতে প্রতারণার শিকার না হন, সেজন্য দেশের প্রচলিত আইন অনুযায়ী প্রতারকদের বিরুদ্ধে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতারিত গ্রাহকদের অর্থও ফেরত দিতে হবে।
করোনাকালে স্বাস্থ্যসেবা খাতের যে দুর্বলতা ধরা পড়েছে, তা দূর করতে হবে। সম্প্রতি মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে করে করোনা ভাইরাসের চিকিত্সাসেবা দিতে গিয়ে অন্য রোগের চিকিত্সা ব্যাহত না হয়। সেজন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ যেন খেয়াল রাখেন। তার এ নির্দেশনা আমাদের অন্যান্য চিকিত্সা-প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রেও সমভাবে প্রযোজ্য। চিকিত্সাসেবার ক্ষেত্রে জীবন রক্ষাকারী কার্যক্রমগুলোকে বজায় রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। এছাড়া বিশেষজ্ঞ চিকিত্সকদের ক্ষেত্রে এ দেশে রোস্টার ভিত্তিতে সাপ্তাহিক ও সরকারি ছুটির দিনে কর্তব্য পালন করার উদ্যোগ নিতে হবে। করোনা-পরবর্তী অবস্থায় কেউ যদি অর্পিত দায়িত্ব পালন না করেন, সেজন্য কঠোর তদারকি ব্যবস্থা এবং শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে হবে। কেননা আগে নাগরিকদের শরীর সুস্থ না থাকলে
অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করা যাবে না। করোনা নিয়ে হয়তো আমাদের দীর্ঘকাল বেঁচে থাকতে হবে। সেজন্য দেশেই করোনার টিকা উত্পাদনের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি প্রতিষ্ঠান এসেন্সিয়াল ড্রাগসের পাশাপাশি বেসরকারি সংস্থাকেও কাজ করতে হবে। বিদেশে তৃতীয় ও চতুর্থ জেনারেশনের করোনাবিরোধী ভ্যাকসিন তৈরি হচ্ছে। এর মধ্যে কিছু কিছু আছে, যা ছোটদেরও দেওয়া যায়। সেগুলো বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার অনুমোদন পাওয়ামাত্র সরকারি-বেসরকারি খাতের মাধ্যমে এনে টিকা দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া দরকার।
দেশে ধীরে ধীরে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের কাজ শুরু হয়েছে। এক্ষেত্রে সরকার রপ্তানিমুখী শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোকে নানামুখী পদক্ষেপের মাধ্যমে সাহায্য করছে। পোশাক রফতানির আবার বিশ্বের দ্বিতীয় স্থানে ফিরে যাওয়াটা চ্যালেঞ্জ স্বরূপ। বিজিএমই কর্তৃপক্ষকে এ ব্যাপারে স্ট্র্যাটেজি তৈরি করে বাস্তবতার আলোকে ব্যবস্থা নিতে হবে। আবার যেসব পোশাক খাত এখনো বিজিএমইয়ের সদস্য হয়নি তাদের জন্য সম্পদের যথাযথ পুনর্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। নতুন উদ্যোগ তৈরি করতে ব্যাংকিং খাতকে অবশ্যই সহায়ক ভূমিকা পালন করতে হবে। গবেষণা করতে গিয়ে দেখেছি যে, করোনাকালে পোশাক খাতে নারী শ্রমিকের সংখ্যা কমেছে যা উদ্বেগজনক। পোশাক শিল্পের নতুন বাজার হতে পারে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্যে রপ্তানিযোগ্য পোশাক তাদের দেশের চাহিদার সঙ্গে সংগতি রেখে ও ফ্যাশন ডিজাইনার দ্বারা তৈরি করে রফতানি করতে হবে। বিদেশস্থ বাংলাদেশ দূতাবাসগুলোর মাধ্যমে সেসব দেশের চাহিদা সংগ্রহ করে সেখানে নতুন বাজার তৈরির জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। রপ্তানি বহুমুখীকরণের ক্ষেত্রে ফার্মাসিউটিক্যালস ও লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং খাতের প্রতি জোর দিতে হবে। রপ্তানিলব্ধ আয় যাতে দেশে ঠিকমতো ফেরত আসে সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
করোনার পূর্বে বাংলাদেশে ঋণঝুঁকির মাত্রা কম ছিল। যেখানে ঋণ জিডিপি অনুপাত ২০১৯ সালে ছিল ৩৬ শতাংশ, সেটি বেড়ে ৪১ শতাংশ হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। বিদেশ থেকে ঋণ যত কম নেওয়া যায় তত অভ্যন্তরীণ উন্নয়নের জন্য মঙ্গলজনক। করোনাকালেও সরকার যথার্থ অর্থে কৃষিক্ষেত্রের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। এক্ষণে কৃষিনির্ভর শিল্পের ওপর অধিকতর গুরুত্ব দেওয়া বাঞ্ছনীয়। এ ব্যাপারে বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, রাকাব, বাংলাদেশ উন্নয়ন ব্যাংককে হোলিস্টিক অ্যাপ্রোচের আওতায় তৃণমূল পর্যায় থেকে উচ্চ পর্যায়, অর্থাত্ গ্রামীণ অর্থনীতির সঙ্গে শহুরে অর্থনীতির সরবরাহজনিত কর্মকাণ্ডের মধ্যে মেলবন্ধন ঘটাতে হবে। এদিকে যেভাবে রপ্তানিমুখী শিল্পায়নের জন্য সুযোগ-সুবিধার জোগান দিচ্ছে
ঠিক তেমনি আমদানি বিকল্প শিল্পায়নের জন্য সব সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে। পল্লী কর্মসহায়ক ফাউন্ডেশনকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো যেতে পারে, যাতে করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উন্নয়নের গতি বৃদ্ধি করা যায়। অন্যদিকে বাংলাদেশ এনজিও ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে প্রত্যন্ত অঞ্চলে অতি ক্ষুদ্র ও কুটিরশিল্পজাত এনজিওগুলোর মাধ্যমে দরিদ্র মানুষগুলোকে পুনর্বাসনের উদ্যোগ নিতে হবে। যারা বিদেশ থেকে ফেরত এসেছেন তাদের আবার বিদেশ প্রেরণের ব্যবস্থা করতে হবে কিংবা পুনর্বাসনে সহায়তা করতে প্রবাসী কল্যাণ ব্যাংককে প্রকল্প গ্রহণ করে বাস্তবায়ন করতে হবে। বিদেশস্থ দূতাবাসগুলোকেও এ ব্যাপারে সহায়তা করতে হবে। হঠাত্ করে যেন যুক্তিসংগত কারণ ছাড়া পুঁজিবাজারের শেয়ারে দাম ফটকা কারবারির মতো ওঠানামা না করে, সেজন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এ দেশের গ্রামীণ উন্নয়ন মডেল, যা করোনা-পূর্বকালে প্রশংসিত হয়েছিল এমনকি নোবেল পুরস্কার বিজয়ী অমর্ত্য সেন শেখ হাসিনার যোগ্য নেতত্বের প্রশংসা করেছিলেন, তা ধরে রাখতে হবে। এখন নিউনর্মাল অবস্থায় দারিদ্র্য হ্রাস ও কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে ব্যাপক উদ্যোগ নিতে হবে। এজন্য গ্রাম অঞ্চলে তথ্যভান্ডার তৈরি করে স্থানীয় পর্যায়ে চাহিদামাফিক প্রশিক্ষণ ও শিক্ষার ব্যবস্থা করতে হবে। ঢাকা স্কুল অব ইকোনমিকস বর্তমানে যে চার বছর মেয়াদি উদ্যোক্তা অর্থনীতি প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে, সেটিকে যথাযথভাবে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্পবিপ্লব এবং ব্যবসা অর্থনীতির মাধ্যমে কর্মসংস্থান উপযোগী মানবসম্পদ তৈরি করে দেশের উন্নয়নে আবার প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশের ওপরে আনতে হবে।
লেখক: ম্যাক্রো ও ফিন্যান্সিয়াল ইকোনমিস্ট, আইটি এক্সপার্ট ও সাবেক উপাচার্য, প্রেসিডেন্সি ইউনির্ভাসিটি, ঢাকা।