ঢাকা, শুক্রবার   ২২ নভেম্বর ২০২৪,   অগ্রাহায়ণ ৭ ১৪৩১

অবহেলিত মানসিক স্বাস্থ্য

একুশে টেলিভিশন

প্রকাশিত : ১১:৫৭ এএম, ১০ অক্টোবর ২০২১ রবিবার

মানসিক সুস্বাস্থ্য বিষয়ে বলার আগে প্রথমে দেখি মন কী? মনের শক্তির উৎস কোথায়? কারণ মনকে ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। আজ পর্যন্ত বিজ্ঞানীরা মনকে ল্যাবরেটরিতে নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতে পারেননি। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন মন মানুষের সকল শক্তির উৎস। মনের এই শক্তি রহস্যকে যথাযথভাবে উপলব্ধি করতে পারলেই এই শক্তিকে আমরা পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারবো। মানুষের শক্তির আসল উৎস দেহ নয়, চেতনা। দেহ হচ্ছে চেতনার বসবাস। আর মনের শক্তি এই চেতনারই একটা রূপমাত্র।

মনকে সুস্থ রাখতে পারলে সাফল্যের সবকিছুই নিয়ন্ত্রণে থাকবে। অর্থাৎ মানসিক সুস্থ্যতা তো সকল কিছুরই উৎস। মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি বা লক্ষ্য দ্বারাই মন নিয়ন্ত্রিত, আর মস্তিষ্ক পরিচালিত হয়। দৃষ্টিভঙ্গি আবার দুধরনের। ইতিবাচক নেতিবাচক। আত্মবিকাশী বা ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মানসিক সুস্থতা। আবার আত্মবিনাশী বা নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিই মানসিক অসুস্থতা।

অবিশ্বাস্য হলেও আমাদের দেশের অধিকাংশ মানুষের চিন্তা জগতের শতকরা ৭০-৮০ ভাগই দখল করে রাখে রাগ, ক্ষোভ, ঘৃণা, দুঃখ, অনুতাপ, অনুশোচনা, কুচিন্তা, বিষণ্নতা, হতাশা নেতিবাচক চিন্তারুপী আত্মবিনাশী ভাবনা। এসব থেকেই মানুষ ক্রমান্বয়ে মানসিক অসুস্থ্য হয়ে পড়ে। আবার আমরা যদি এই প্রক্রিয়াকে উল্টে দিতে পারি অর্থাৎ ৭০-৮০ শতাংশ চিন্তাকেই আত্মবিকাশী বা ইতিবাচক চিন্তায় পরিণত করতে পারি তাহলেই মানসিক সুস্থতা আসবে। বিজ্ঞানীরা বলেন মানসিক সুস্থ থাকার জন্য প্রয়োজন নিজের সিদ্ধান্ত। অর্থাৎ নিজের মনের চালক বা দায়িত্ব নিজেকেই নিতে হবে। ইতিবাচক চিন্তাকে ৭০ ভাগে উন্নীত করতে পারলে নেতিবাচক চিন্তা ধীরে ধীরে বিলুপ্তির পথে এগিয়ে যাবে।

মানুষের শক্তির উৎস দুটি। এক, দৈহিক শক্তি। দুই, মানসিক শক্তি। দৈহিক শক্তি সসীম, কিন্তু মনের শক্তি অসীম। দেহের পক্ষে অসম্ভব এমন প্রতিটি কাজ মন করে যেতে পারে অবলীলায়। কঠিন পর্বতমালার মধ্যে সে যেমন অনায়াসে ঢুকে যেতে পারে, তেমনি পারে পরমাণুর মাঝেও ঢুকে পড়তে। অতল সাগরের তলদেশে মন যেমন মুহূর্তে ডুব দিতে পারে তেমনি মহাবিশ্বের দূরতম গ্যালাক্সি পরিভ্রমণ করে আসতেও তার সময় লাগে না। দেহের অবস্থান স্থান-কালে সীমাবদ্ধ হলেও স্থান-কালের কোনো বেষ্টনী দিয়েই মনকে আবদ্ধ করা যায় না। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎকালের যে-কোনো স্তরে মন অত্যন্ত স্বাচ্ছন্দ্যে বিচরণ করতে পারে। দেহের ক্লান্তি আছে, কিন্তু মনের কোনো ক্লান্তি নেই। দেহের নিষ্ক্রিয় বিশ্রামের প্রয়োজন আছে, কিন্তু মনের কোনো নিষ্ক্রিয় বিশ্রামের প্রয়োজন নেই। দেহ যখন নিদ্রায় অচেতন থাকে, মন তখনো থাকে সজাগ, সচেতন।

আমাদের সকল সচেতনতার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে মন। শিল্প-সাহিত্য, বিজ্ঞান প্রযুক্তির ক্ষেত্রে যা কিছুই আমরা এখন বাস্তবে দেখতে পাচ্ছি তার সবকিছুর ধারণাই প্রথম এসেছে মনে। সুস্থ, সুন্দর মনের ধারণার বীজই পরবর্তীতে পত্র-পুষ্পে প্রস্ফুটিত হয়ে বাস্তব রূপ নিয়েছে।

আমরা জানি, মস্তিষ্ককে বেশি পরিমাণে ব্যবহার করার জন্যে প্রয়োজন সুসংহত মানসিক প্রস্তুতি। আর সুসংহত মানসিক প্রস্তুতির ভিত্তি হচ্ছে যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি। আর যথাযথ দৃষ্টিভঙ্গি অনুসরণের পথে প্রথম পদক্ষেপ হচ্ছে মনের সুস্থ শক্তি তৎপরতার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা। নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে কোনো শক্তিকেই নিজের বা মানুষের কল্যাণে লাগানো যায় না। আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারার ওপরই নির্ভর করে তা সভ্যতা গড়ার কাজে লাগবে, না তা সবকিছু পুড়িয়ে ছাই করে দেবে। যে পারমাণবিক শক্তি হিরোশিমা-নাগাসাকিতে মুহূর্তে প্রলয় ঘটিয়েছিল, সে শক্তির নিয়ন্ত্রিত সৃজনশীল প্রয়োগই বিদ্যুৎ, চিকিৎসা, কৃষি শিল্প ক্ষেত্রে ঘটিয়েছে বিপ্লব। নিয়ন্ত্রণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে নেহাত জড় পদার্থও পরিণত হতে পারে শক্তিতে, শক্তি পরিণত হতে পারে মহাশক্তিতে।

প্রাকৃতিক শক্তির ক্ষেত্রে নিয়ম যেমন স্বতঃসিদ্ধ তেমনি মানুষের ক্ষেত্রে তা সমভাবে প্রযোজ্য। মানুষের অসীম শক্তিকে ব্যক্তি বা মানবতার কল্যাণে নিয়োজিত করার পন্থাও এই একটিই-শক্তির নিয়ন্ত্রণ সৃজনশীল প্রয়োগ।

প্রবাদ আছে, মানুষ তার স্বপ্নের সমান বড়। মানুষ নিজেকে যা ভাবতে পারে, একসময় তাই করতে পারে। আত্মবিকাশি চিন্তা, ইতিবাচক চিন্তা প্রয়োজন মানসিক ভালো থাকা, সাফ্যলতার জন্য, সুন্দর সুখী জীবনের জন্য। সুস্বাস্থ্যই জীবন। আর সুস্বাস্থ্য মানেই মানসিক, শারীরিক, আত্মিক সুস্থ্যতা।

আগেই বলেছি, মানসিক সুস্থ্যতার ভিত্তি হচ্ছে দৃষ্টিভঙ্গি, লক্ষ্য বা অভিপ্রায়। মন পরিচালিত হয় দৃষ্টিভঙ্গি লক্ষ্য বা অভিপ্রায় দিয়েই। আর মস্তিষ্ককে চালায় মন। বিজ্ঞানীরা বলেন, একজন প্রোগ্রামার যেভাবে কম্পিউটারকে পরিচালিত করে, তেমনি মন মস্তিষ্ককে পরিচালিত করে।

মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে আমরা একেবারেই অসচেতন। আমরা লাখ লাখ টাকা ব্যয় করে শরীরের যত্ন নেই, চিকিৎসা করি কিন্তু মানসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে থাকি একেবারেই উদাসীন। মানসিক সুস্থ্যতা বা মানসিক শক্তি দিয়ে মানুষ দৈহিক পঙ্গুত্বকেও উপহাস করতে পারে। তার অনেক প্রমাণ আছে। বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং লিখতে বা কথা বলতে পারতেন না। কিন্তু বিশেষ কম্পিউটারের সাহায্যে বিজ্ঞান জগতের আলোড়ন সৃষ্টিকারী গ্রন্থ রচনা করেছেন।

মানুষের অসীম শক্তি সম্ভাবনাকে সবসময় শৃঙ্খলিত পঙ্গু করে রাখে সংস্কার ভ্রান্ত বিলাস নেতিবাচক ভাবনা। অনন্ত সম্ভাবনা নিয়ে জন্মগ্রহণ করলেও একজন মানুষ পারিবারিক, সামাজিক রাষ্ট্রীয় পরিমণ্ডলে প্রচলিত ধারণার শৃঙ্খলে সে ক্রমান্বয়ে বন্দি হয়ে পড়ে। পরিবেশ যা তাকে ভাবতে শেখায় সে তাই ভাবে, যা করতে বলে তাই করে।

সমাজের ভ্রান্ত বিলাস নেতিবাচক চিন্তা, কুসংস্কার ত্যাগ করা সহজ নয়। হাজার বছরের কুসংস্কার আমাদের জীবনের গহীনে গেথে গেছে। কখনো কখনো এসব ভাবনাকে নেতিবাচক চিন্তাকে আমরা নিয়তি হিসেবে নিয়ে থাকি। বিজ্ঞান বা ধর্মের প্রবল বিশ্বাসের কথা বলে থাকলেও জীবনে অনুসরণ করি অবৈজ্ঞানিক বা কু-ধর্মীয় চিন্তাধারা।

মানসিক রোগ সাধারণ রোগের চিকিৎসা নিয়ে প্রচলিত কুসংস্কার থেকে সহজে বেরিয়ে আসার তেমন কোন সহজ পথ পরিলক্ষিত হচ্ছে না। এখানে একটা উদাহরণ দেই- আমরা যে কোন ধরনের হৃদরোগীদের প্রচলিত চিকিৎসা দিয়ে থাকি এনজিও প্লাস্টি বা বাইপাস বা প্রচলিত ওষুধ। আমরা জানি হৃদরোগ শুধু খাওয়া, খারাপ অভ্যাসের কারণে হয় না মানসিক চাপ বা টেনশন থেকেও হতে পারে। এখন একজন স্ত্রীর বা অফিমের বসের সাথে মানসিক বিরোধ বা ঝগড়ার কারণে হৃদরোগে আক্রান্ত হলেন। প্রচলিত চিকিৎসা করে সাময়িক সুস্থ্ হলেন, কিন্তু আবারও ফিরে সে বিরোধ শুরু হলো। এখন এটাকে কী বলবেন? অর্থাৎ মানসিক বা শারীরিক চিকিৎসা দিতে হবে সবকিছু বুঝে বিশ্লেষণ করে। কিন্তু আমাদের দেশের বেশির ভাগ ক্ষেত্রে চিকিৎসা পদ্ধতি প্রচলিত।

আমাদের চিকিৎসক, শিক্ষক বা গণমাধ্যম কর্মিরা ও মানসিক স্বাস্থ নিয়ে যথাযত ভাবে সচেতন বা অবগত নন। মানসিক স্বাস্থ্যের গুরুত্বকে সর্বসাধারণের মধ্যে পৌঁছে দেয়ার জন্য চিকিৎসা বিজ্ঞানে আরও গুরুত্ব দিয়ে গবেষণা দরকার। অধ্যাপক এম.ইউ আহমেদের ন্যায় মন চিকিৎসকদের উদ্যোগ দরকার। যাদের গবেষণা, লেখালেখি, কথাকে রাষ্ট্র গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করবে। অর্থাৎ মানসিক স্বাস্থ্যের সুস্থতা প্রচলিত ওষুধে হবে না। মনের চিকিৎসা বা মনের নিয়ন্ত্রণ করতে পারাই মানসিক চিকিৎসা এটা সর্বসাধারণকেও বোঝাতে হবে।

মানসিক স্বাস্থ্য দৈহিক স্বাস্থ্য যে ভিন্ন বিষয় বিষয়ে গণমাধ্যম জানলেও সেটা তেমন পরিলক্ষিত হয় না। অর্থাৎ প্রচলিতভাবে সবার ন্যায় গণমাধ্যমও একইভাবে ঢালাও বিবেচনা করে থাকে। সেটা প্রতিদিনের সংবাদ বা প্রকিাশিত ফিচার দেখলেই স্পষ্ট হয়ে যাবে। আমাদের অধিকাংশ সংবাদপত্র বা টেলিভিশন, অনলাইনে স্বাস্থ্যপাতা বা বিভাগ থাকলে সেখানে প্রকাশিত অধিকাংশ লেখাই দেহ রোগের চিকিৎসা নিয়ে। খুব অল্প কিছু লেখা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে। আমরা শুধু গণমাধ্যমের কথা বলছি কেন, অধিকাংশ চিকিৎসকেরাও মানসিক স্বাস্থ্যকে তেমন আমলে নেননা।

বিজ্ঞানীরা মনকে ভাগ করেছেন তিন ভাগে। সচেতন, অবচেতন এবং অচেতন। সচেতন মন সবকিছুকেই নিজের ধারণা, যুক্তি বিশ্বাসের প্রেক্ষিতে বিচার-বিবেচনা করে। কিন্তু অবচেতন মন ভালো-মন্দ কোনোকিছুই বিচার করার চেষ্টা করে না। সে যে তথ্য, পরিকল্পনা বা আইডিয়া পায়, সেভাবেই প্রভাবিত হয়ে কাজ শুরু করে দেয়। প্রভাবটা আপনার জন্যে ভালো হোক বা ক্ষতিকর সে বিবেচনা করে না। ভয়, ক্রোধ বা বিশ্বাস দ্বারা গভীরভাবে তাড়িত হলে যে-কোনো ধরনের প্রভাবে অবচেতন মন সহজেই সাড়া দেয়।

মনের অবচেতন অংশ আবার সচেতন অংশের কথা সহজেই শোনে। ভয়, সীমাবদ্ধতা বা ভুল বিশ্বাসের বশবর্তী হয়ে সচেতন মন সবসময় অবচেতন মনের দরজা বন্ধ করে রাখতে চায়। অথচ প্রজ্ঞার সাথে সচেতন মনের যোগাযোগের মাধ্যম হচ্ছে অবচেতন মন। কারণ সচেতন অচেতন মনের মাঝখানেই অবস্থান করছে অবচেতন মন।

বিজ্ঞানীরা যাকে মনের অচেতন অংশ বলে মনে করেন, সাধকরা সেটাকেই মনে করেন মনের মহাচেতন অংশ। শুধুমাত্র অবচেতন অচেতনের মাঝখানের দরজা খুলতে পারলেই সচেতন মন প্রজ্ঞা বা মহাচৈতন্যের সাথে যোগাযোগ স্থাপনে সক্ষম হয়।

আমরা আগেই জেনেছি- অবচেতন মন ভালো-মন্দ বিচার বিবেচনা করতে পারে না। আর অবচেতন মন আলাদীনের দৈত্যের মতো কখনো অলস বসে থাকতে পারে না। তার চাই কাজ। সুস্থ মনকে যদি নিজের কল্যাণে ইচ্ছানুসারে ব্যস্ত না রাখেন তাহলে সে আপনার পারিপার্শ্বিকতা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে কাজ করবে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই এই কাজের কাঁচামাল হবে আপনার ভয়, ভীতি, অপছন্দনীয় অবাঞ্ছিত বিষয়সমূহ। খারাপ বা ভালো যে বিষয় সে পাক না কেন অবচেতন মন সে চিন্তাকে যুক্তিসঙ্গত পরিণতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে।