ঢাকা, মঙ্গলবার   ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪,   পৌষ ৯ ১৪৩১

১০৮টি নীলপদ্ম উৎসর্গের দিন

শেখ সাদী

প্রকাশিত : ০৯:০৭ এএম, ১৩ অক্টোবর ২০২১ বুধবার

চলছে আশ্বিন। আজ শুক্লপক্ষের অষ্টমী তিথি।
দিনটি দেবীর জন্য খুবই প্রীতিকর। প্রিয় তিথি। কারণ, মহালয়ায় দেবী পক্ষের যে শুভ সূচনা হয়েছিল তারই পূর্ণ ও সার্থক প্রকাশ ঘটবে আজ, অষ্টমীতে। সে কারণেই মহাষ্টমী বাঙলির মনে আর ঠোঁটে লেগে থাকার দিন।
আজ সন্ধিপূজার প্রহর। ১০৮টি নীলপদ্ম উৎসর্গ করার দিন। নিবেদনের সময় জ্বলে উঠবে ১০৮টি প্রদীপ। আর, মন্ত্রের অণুরণনে মুখর হয়ে উঠবে রাত। যে রাতে শঙ্খধ্বনি, ঢাকের বাদ্য আর উলুধ্বনিতে ছড়িয়ে পড়বে ভক্তি আর উৎসবের বার্তা। ঠিক এই সময়ে মন্ত্রোচ্চারণ আর ১০৮টি প্রদীপের আলোয় উদ্ভাসিত হয়ে উঠবে দেবীর মুখশ্রী।
আজ অষ্টমীর অন্তেই বলিদান। কারণ, আজকের দিনটিই তো বিজয়ের। দুর্গতিনাশিনী মাহামায়া এদিন মহিষাসুরকে বধ করেছিলেন। এই সময়েই দেবী নিজেকে প্রকাশ করেন, দেবীবৈষ্ণবী থেকে উগ্রচণ্ডা রূপে। বিশ্বাস করা হয়- আজকের মহাসন্ধিক্ষণে দেবী প্রতিমায় আবির্ভূত হবেন। অষ্টমীর সন্ধিতে হবে ডাকিনী যোগিনীর পুজো; আর মণ্ডপে মণ্ডপে দেবী পাবেন লুচি-সুজির ভোগ।
সবমিলে অষ্টমীর পূজা শারদীয়ার গুরুত্বপূর্ণ অংশ। পুষ্পাঞ্জলি দিয়ে দেবীদুর্গাকে মনের ইচ্ছা জানিয়ে রাখার দিন।

সন্ধিপূজা অষ্টমীর বিশেষ পূজা।
সন্ধির সময়কাল ৪৮ মিনিট। অষ্টমী তিথির শেষ ২৪ মিনিট আর নবমী তিথির প্রথম ২৪ মিনিট- এই ৪৮ মিনিট।
অষ্টমী ও নবমী তিথির সংযোগ স্থলে পূজা হয় বলেই সন্ধিপূজা। অর্থাৎ, সন্ধি-কালিন পূজা।
কেউ কেউ জানতে চেয়েছেন, সন্ধিক্ষণেই কেন বলিদান?
জানাচ্ছি উত্তরটা, সন্ধি শব্দটার মধ্যেই গভীর ব্যঞ্জনা লুকিয়ে আছে। সন্ধিপূজা সমাপন কালে দেবীর চরণে ১০৮টি পদ্ম নিবেদন করতে চাইলেন রামচন্দ্র; পদ্মফুল জোগাড় করতে হনুমানকে বললেন, ‘দেবীদহ থেকে ১০৮টি পদ্মফুল নিয়ে এসো’। অনেক সন্ধানের পর ১০৭টি পদ্ম জোগাড় করতে পারল হুনুমান। একটা বাকি রইল। দেবীদহে আর একটিও পদ্ম নেই। এদিকে দীর্ঘদিন অসুর নিধনের লড়াইয়ে দেবীর শরীরে ১০৮টি ক্ষত হয়ে যায়। ক্ষত-বিক্ষত শরীরের অসহ্য যন্ত্রণায় কাতর তিনি। দুর্গার যন্ত্রণার মুখ দেখে কষ্ট পাচ্ছেন মহাদেব; বললেন, দেবীদহে স্নান করতে হবে। ওখানে স্নান করলেই চলে যাবে শরীরের যন্ত্রণা। সেরে যাবে শরীরের সবগুলি ক্ষত।
দুর্গা নামলেন দেবীদহে। তখন, একশ সাতটি ক্ষত থেকে জন্ম হয় একশ সাতটি পদ্মের। ক্ষত সেরে গেল কিন্তু একটি ক্ষত রয়ে যায়, রয়ে যায় যন্ত্রণা। দুর্গার যন্ত্রণার মুখ দেখে রামচন্দ্রের চোখ থেকে একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে ১০৮তম ক্ষতের ওপর। ঝরে পড়া অশ্রুবিন্দু থেকে জন্ম হয় একটি পদ্মের। এটা দেবী নিজেই লুকিয়ে ফেললেন। কারণ, স্বামীর অশ্রুসিক্ত পদ্মফুলটি কেমন করে তিনি চরণে নেবেন?  

শ্রী শ্রী চণ্ডি জানাচ্ছে, মহাসন্ধিক্ষণেই অসুরদলনী দেবী দুর্গা অশুভ শক্তির প্রতীকরূপী মহিষাসুরকে দমন করেছিলেন। বৃহদ্ধর্ম পূরাণ মতে, রাবনবধের জন্য দেবীদুর্গার বোধন করলে ব্রহ্মার স্তবে খুশি হয়ে বলেন, সপ্তমী তিথিতে রামচন্দ্রের ধনুর্বানে তিনি প্রবেশ করবেন আর অষ্টমী ও নবমীর সন্ধিক্ষণে রামচন্দ্রের হাতে প্রাণ যাবে রাবনের। তাই হলো, নবমীর সন্ধিক্ষণেই প্রাণ যায় রাবনের। সেজন্য এই সন্ধিক্ষণেই অশুভ শক্তির প্রতীকরূপে ‘পশুবলি’ দেয়ার নিয়ম।

আজ কুমারী পূজার দিন।
সপ্তমী, অষ্টমী ও নবমী তিথিতে ষোলো বছরের কম বয়সের কুমারীকে দেবীজ্ঞানে পূজা করার রীতি অনেক দিনের।
বৃহদ্ধর্মপুরাণ বলছে, দেবী অম্বিকা কুমারী কন্যারূপে দেবতাদের সামনে আবির্ভূতা হয়ে বেলগাছে বোধন করতে নির্দেশ দেন। তৈত্তিরীয় আরণ্যকেও দেবী কুমারী হিসেবে পরিচিত।
দক্ষিণ ভারতের কন্যাকুমারী মন্দিরে কুমারী প্রতিমার পূজা ভারতীয় ঐতিহ্যের স্মারক। কারণ, কুমারী পূজা তান্ত্রিক মতের প্রতিফলন। সারা ভারতের সব শক্তিপীঠেই কুমারী পূজা হয়।

১৮ অক্টোবর, ১৯০১। বেলুড় মঠে অষ্টমী তিথিতে প্রথম কুমারী পূজা করেন স্বামী বিবেকানন্দ।

কুমারী পূজায় বিভিন্ন বয়সের কন্যাকে ভিন্ন ভিন্ন নামে পূজা করা হয়। যেমন, এক বছরের কন্যা সন্ধ্যা, দুই বছরে সরস্বতী, তিন বছরে ত্রিধামূর্তি, চার বছরে কালিকা, পাঁচ বছরে সুভগা, ছয় বছরে উমা, সাত বছরে মালিনী, আট বছরে কুঞ্জিকা, নয় বছরে কালসন্দর্ভা, দশ বছরে অপরাজিতা, এগারো বছরে রুদ্রাণী, বারো বছরে ভৈরবী, তেরো বছরে মহালক্ষ্মী, চৌদ্দ বছরে পীঠনায়িকা, পনেরো বছরে ক্ষেত্রজ্ঞা ও ষোলো বছরে অম্বিকা। ঋতুমতী না হওয়া পর্যন্ত এসব পরিচয়ে পূজিত হবে। কুমারীকে অনেক সন্মান দিয়েছে শাস্ত্র। বলা হয়েছে- একজন কুমারীকে খাওয়ালে বিশ্বভুবনকেই খাওয়ানো হয়।

পুনশ্চ : আজ অষ্টমীর দিনে দেবীদুর্গার সাথে অন্য দেবদেবীও অর্ঘ্য পান। বিশেষ করে নবদুর্গা, চৌষট্টি যোগীনি, কোটি যোগীনি, ভৈরব, ক্ষেত্রপালসহ আরো অনেকে অর্ঘ্য পান ভক্ত হৃদয়ের।
এএইচএস/ এসএ/